এবার কঙ্গোর সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে আরও দুই কলম লিখলাম ।একদিন বিকেল বেলা গ্রামে ঘুরতে গিয়ে দেখি একটা গির্জার মধ্যে প্রার্থনা চলছে যেখানে সব প্রার্থনাকারী হচ্ছেন মহিলা । জানতে চাইলাম প্রার্থনায় কোন পুরুষ লোক নেই কেন ? একজন জবাব দিল - কারন পুরুষ লোকরা মদ্য পান করতে পছন্দ করে । তাই তারা এখানে তেমন একটা আসে না । কয়েকদিন আগে এক ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম তাকে সুন্দর শার্ট প্যান্ট জোড়া কে কিনে দিয়েছে । সে বলল মা কিনে দিয়েছে। আবার জিজ্ঞেস করা হল বাবা কিনে দেয় না ? সে লজ্জা পাচ্ছিল। সঙ্গে দাঁড়ানো তার বন্ধুটি বলল কারন তিনি বোতল ধ্বংসে ব্যস্ত থাকেন। বোতল ধ্বংস করা মানে ভেঙে নষ্ট করা টাইপের কিছু নয় । এটা আসলে অলস বসে বসে অন্ন ধ্বংস করার মতো কাজ । বুঝানো হচ্ছে অকর্মণ্য ছেলেরা যেমন বাবার হোটেলের অন্ন ধ্বংস করে এখানের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী মদমত্ত বাবারা মায়ের হোটেলের বোতল ধ্বংস করে । আমাদের শ্রদ্ধেয় আব্দুল বারী স্যার বললেন তাই নাকি ? তারপর দিনই দেখলেন আসল চিত্র । পাহাড় পর্বত পেরিয়ে প্রচুর মহিলা ও মেয়েরা মাথায়, পিঠে জ্যারিক্যান বা কন্টেইনার বোঝাই করে স্থানীয় ‘বাংলা (?)’ পানীয় নিয়ে যাচ্ছে বাজারে।উদ্দেশ্য হচ্ছে ঘরের চাহিদা মিটিয়ে বাহিরে বিক্রি করে দু পয়সা আয় করা। পুরুষগণ সম্মানিত ক্রেতা তাই কলা দিয়ে তৈরি ক্যাছিক্স , ভুট্টা দিয়ে তৈরি কানিয়াঙ্গা রসের বিক্রি ভালো চলে । এক বোতল পান করার পর ঝিমুনি আসে আর তাতে যে সুখ পাওয়া যায় বৃদ্ধ লোকও সুযোগ ছাড়তে চায় না। তাই দেখা হলে দু একজন একটা বোতলের দাম আবদার করে বসে । নিজে বেরসিক স্বভাবের লোক বলে তাদের রসের আবদার মিটাতে পারিনি কখনো ।
মনে হতে পারে বোতলসেবীদের এত সমালোচনা কেন । কড়া স্বাদের দেশী, বিদেশী বোতলজাত পানীয় (হার্ডড্রিংসের বাংলা অর্থ জানি না) গলাদকরনে বেতাল স্বামীরা দেখি মাঠ ঘাঁটের সমস্ত কাজ কর্মে নারীদের বাধ্যতামূলক অংশ গ্রহন নিশ্চিত করেছে। জমিতে ফসল লাগানো থেকে শুরু করে বাজারে বিক্রি পর্যন্ত, সকল গৃহস্থালি কাজকর্ম থেকে শুরু করে পরিবারের শান্তি ও মঙ্গল কামনায় প্রতি বিকেলে গির্জায় প্রার্থনা পর্যন্ত সবই করে থাকেন মহিলারা । তারপরও পুরুষরা পরিবারের প্রধান যারা দাবি করেন পরিবারের উন্নতির জন্য তারা অন্যান্য কাজ কর্ম করে থাকেন । এ যুক্তিটা হয়ত আংশিক সত্য ।
নারীদের পর সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় আছে ছোট্ট ছেলে মেয়েরা । সংঘাতপূর্ণ এলাকায় এদের অবস্থা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ । এই শান্তির সময়ে নতুন উৎপাত শুরু হয়েছে আফ্রিকার অন্যতম বড় শহর এবং কঙ্গোর রাজধানী কিনশাসায়। বিবিসি নিউজ আফ্রিকার বিশ্লেষণ অনুযায়ী ২০ হাজারের বেশি শিশুকে শিশু ডাইনী অপবাদ দিয়ে পরিবার থেকে রাস্তায় বের করে দেয়া হয়েছে । সামাজিকভাবে ভবঘুরে ও যুদ্ধে এতিম হয়ে যাওয়া ছেলে মেয়েরা ভুক্তভোগী বেশি। কারো মৃত্যু হওয়া,চাকরি যাওয়া,অসুস্থ হওয়ার মতো ঘটনাকে ডাকিনী বিদ্যার কাজ বা ডাইনিদের অশুভ প্রভাব বলে সাধারণ লোকদের বুঝানো হয়। এ কাজটি করছে ইভাঞ্জেলিক্যাল/ অ্যাংলিকান চার্চের যাজকগণ। ইউ এন ওয়েবকাস্টের নিউজে দেখলাম একজন যাজক বলছিলেন কিভাবে ভুতে ধরা একটি ছেলে বিস্কুট খাওয়ার পর পেটে গিয়ে মানুষের মাংসে পরিণত হয়ে গেছে ,কিভাবে রাতের বেলা সে ভূত হয়ে উড়ে বেড়ায়। অশুভ আত্মা দূর করার জন্য প্রতি সপ্তাহে হাজার হাজার যাজক কিনশাসায় নির্মম ও ভয়ানক আচার অনুষ্ঠান করে থাকেন। দুই তিন বছরের ছোটো ছোটো বাচ্চাদের উপর ভূত তাড়ানোর(এক্সরসিজম) নামে এমন নির্যাতন চালানো হয় দেখে গা শিউরে উঠল আমার। বড় কালো চোখ আর বড় পেটের বাচ্চাদের ভূতের আছর করেছে বলে ধরে নেয়া হয়। তাই পেট ,কপাল কেটে দেয়া , আগুনের ছ্যাঁক দেয়া, পিটানো ইত্যাদি আচারের মাধ্যমে ডাইনী তাড়াতে যাজকগণ নেন মাত্র পঞ্চাশ ডলার। বাড়িতে বানানো মদ সহজলভ্য হওয়ার কারনে ছোটো ছেলেমেয়েদেরকেও খেতে দেখেছি । আমার ধারণা সে কারনে হয়ত পেটের সমস্যা হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশেও এ ধরনের বুজরুকি টাইপের কবিরাজি আছে । টিভিতে দেখছিলাম টাইগার বাবা নামের এক ভণ্ড কবিরাজ পোলিও রোগী, বাতের রোগী,মানসিক প্রতিবন্ধীদের সরিষার তেল মেখে কিল ঘুষি চড় থাপ্পর মেরে চিকিৎসা দিচ্ছে । এ রকম কতো ভণ্ড পীর,কবিরাজ যে আছে সারাদেশে আল্লাহ্ মালুম। সারা দুনিয়া সাম্প্রতিক আর্থিক মন্দায় কাত হয়ে গেছে কিন্তু এ ধরনের লোকদের জমজমাট ব্যবসার কিছু হয়নি। কর্মকাণ্ডের মিল দেখে মনে হল উপরের যাজক আর কবিরাজ এরা একই বনের নেকড়ে।
ফিরে আসি আগের গল্পে । আমাদের হাসপাতালে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক এসেছেন চিকিৎসা নিতে। ডাক্তার বিজয় স্যার অসুখের বিস্তারিত শুনেই বললেন ‘লোকাল ড্রিংকস খেয়ে তো এর নাড়ি ভুঁড়ি জ্বলে গেছে।’ জীবনযাত্রার মান সেই মান্ধাতার আমলে পড়ে থাকলেও তা থেকে উন্নতি করার কোন চেষ্টা তেমন একটা দেখা যায় না ছেলে/পুরুষদের মধ্যে । বাক্যালঙ্কার বা উপমা পড়ার সময় বইতে পড়ছিলাম ‘বোতলেই ছেলেটির সর্বনাশ করিল।’ এদের অনাগ্রহ ও অলসতা দেখে আমার সে কথাটাই মনে পড়ে।
( কাউকে ছোটো করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয় । মজা করার জন্য নিজের অভিজ্ঞতা সবার সাথে শেয়ার করা হল)
জহিরুল কাইয়ুম
গনতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র থেকে ।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



