ছোটবেলায় (যদিও এখনো যথেষ্ট বড় হইনি) আমাদের বাসায় একটা সাদাকালো টেলিভিশন ছিল । সেই টেলিভিশনটি মোটামুটি পারিবারিক ঐতিহ্য হিসেবেই বাসায় স্থান করে নিয়েছিল । টেবিল চেয়ার থেকে শুরু করে অনেক কিছুই বদলাতো কিন্তু সেই টেলিভিশন বদলাতোনা । বদলানোর প্রয়োজনও ছিলোনা । একটা জিনিষ চলছে, চলুক । আমরা দু ভাই বোন পরম স্নেহ মমতায় সেই ‘ঐতিহ্যকে’ লালন পালন করতাম এবং একি সাথে প্রার্থনা করতাম যেন টেলিভিশনটা দ্রুত নষ্ট হয়ে যায় । নতুন একটা রঙ্গিন টেলিভিশন কেনার ‘উসিলা’ আরকি !!
ডিশের কানেকশন তখনো সজলভ্যতা পায়নি । বিনোদনের জন্য বাসায় একটা ক্যাসেট প্লেয়ার ছাড়া আর কিছু ছিলও না । বাধ্য হয়েই আমরা বিটিভি দেখতাম । ‘বাধ্য’ বললে অবশ্য ভুল , ‘ব্যাপক উৎসাহ’ নিয়েই দেখতাম । বিটিভির অনুষ্ঠানমালা শুরু হতো বেলা তিনটায় । দেখা যেতো দুপুর আড়াইটার দিকে আমি টেলিভিশন চালু করে বসে আছি । আধাঘন্টা বসে বসে টেলিভিশনের পর্দায় ঝির ঝির দেখতাম । খারাপ লাগতো না । তিনটা বাজার সাথে সাথে অনুষ্ঠানমালা শুরু , আমার চোখে মুখে আনন্দ । সেই আনন্দ চলতো বিকাল পর্যন্ত । এরপর খেলাধুলার বিরতি । তারপর আবার সাতটা থেকে শুরু, চলতো রাত এগারোটা পর্যন্ত । মাঝে মাঝে সাড়ে এগারোটায় জাতীয় সঙ্গিত বাজা না পর্যন্ত থামতাম না । জাতীয় সঙ্গীতের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে আর তারপর আবারো মিনিট পাঁচেক ঝির ঝির দেখে ঘুমাতে যেতাম ।
সে সময়ে টেলিভিশনের প্রধান আকর্ষণ ছিল রাত আটটার খবরের পর নাটক অথবা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান । আমি আর আমার বড় বোন প্রধান দর্শক । একসাথে বসে সেই অনুষ্ঠান গুলো হা করে দেখতাম এবং প্রায় প্রতিদিন বসার জায়গা নিয়ে মারামারি করতাম । আমাদের পরিবারের সদস্য চারজন । একমাত্র টেলিভিশনই চারজনকে একত্রিত করার ক্ষমতা রাখতো । আমার একটা প্রিয় অভ্যাস ছিল মুড়ি খেতে খেতে টেলিভিশন দেখা । রাত আটটার দিকে টেলিভিশনের রুম মোটামুটি পরিষ্কার থাকলেও রাত দশটার দিকে পুরো রুম মুড়িতে সয়লাব হয়ে যেতো । গর্হিত এই অপরাধে আমাকে প্রায় প্রতিদিন শাস্তি পেতে হতো । আমি শাস্তি মাথা পেতে নিতাম তারপরেও মুড়ি খাওয়া ছাড়তাম না ।
৯৮ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল চলার সময়ে ঘটনা । কোয়ার্টার ফাইনাল চলাকালীন সময়ে ধুম করে টেলিভিশন নষ্ট হয়ে গেল । ব্যাক্তিগতভাবে আমি প্রচণ্ড মন খারাপের ভান করলাম । মনে মনে ধরে নিয়েছিলাম এবার একটা নতুন টেলিভিশন চলে আসবে । বিশ্বকাপ ফুটবল বলে কথা । পাশের বাসায় গিয়ে খেলা দেখার সুযোগ ছিলো , কিন্তু ভাব নিলাম নিজেদের টেলিভিশন ছাড়া কি খেলা দেখে মজা পাওয়া যায় ? সবার কপালে তো আর সুখ সয়না । তিনদিন পর সেই টেলিভিশনটা নিজে থেকেই আবার ঠিক হয়ে গেল । এবার সত্যিকারের মন খারাপ হল !
আরেকবার আমাদের বাসায় চুরি হল । চুরি না বলে ছোটখাটো ডাকাতি বলা যায় । রাতে বাসায় কেউ না থাকার সুবাদে চোরেরা মনের মাধুরি মিশিয়ে চুরি করলো । সোনাদানা, টাকা পয়সা , দামী দামী সব শাড়ি কিছুই বাদ রাখলোনা, এমনকি আমার পড়ার টেবিলে বিশ টাকার একটা নোট ছিল, সেটাও নিয়ে গেল । রাতে তারা চা বানিয়ে খেলো, বিস্কুট খেলো । পরদিন বাসায় ফিরে আমরা হতভম্ব ! পুরো ঘর ওলট পালট । এরি মাঝে আমরা আবিস্কার করলাম চোর অনেক কিছু নিয়ে গেছে কিন্তু টেলিভিশন নিয়ে যায়নি । এ দৃশ্য দেখে আমি আর আমার বোন প্রচণ্ড হতাশ । চোর চুরি করেছে এতে আমরা দুইভাই বোন তেমন দুঃখ পাইনি কিন্তু চোর টেলিভিশন নিয়ে যায়নি বলে আমরা সে তুলনায় কয়েকগুন বেশী দুঃখ পেলাম । ‘টেলিভিশন’ না নেওয়ার অপরাধে রাতে শুয়ে শুয়ে দুইজনে মিলে চোরকে অভিশাপও দিলাম ।
সেই টেলিভিশন চলতে চলতে একটু আধটু ঝামেলা করতো তারপর নিজে থেকেই আবার ঠিক হয়ে যেত । আমি পড়ালেখা বাদ দিয়ে গভীর মনোযোগ সহকারে রাত আটটার সংবাদ দেখতাম, দশটার ইংরেজি সংবাদে ফড়ফড় ইংরেজি বলা দেখে চোখ কপালে তুলতাম । সন্ধ্যায় চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চট্রগ্রাম কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বিরক্তিকর সব অনুষ্ঠান দেখতাম । প্রচণ্ড ধৈর্য নিয়ে ‘সুর লহরী’ নামক উচ্চাঙ্গ সঙ্গিতের অনুষ্ঠানও দেখতাম । কিছুই বাদ দিতাম না, সবি দেখতাম । অনুষ্ঠানের মান হয়তো খারাপ ছিল কিন্তু মনে ছিল অসীম আনন্দ । টেলিভিশন ছিল সাদাকালো কিন্তু মন ছিল রঙ্গিন ।
‘শকুনের দোয়ায় গরু মরে না’ । আমাদের দুই ভাইবোনের কোন দোয়াতেই টেলিভিশনের কিছু হলোনা । মেড ইন জাপান ‘ন্যাশনাল টেলিভিশন’ শেষ পর্যন্ত বহাল তবিয়তে টিকে রইলো । তবে আমাদের আন্দোলন সংগ্রামের ফলে একদিন ঘরে ‘টুকটুকে’ রঙ্গিন টেলিভিশন এলো । ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে ডিশের কানেকশন দেওয়া হলো । সাদাকালো টেলিভিশনটা আমাদের ঘরের কাজের মহিলাকে ‘বিশেষ পুরস্কার’ হিসেবে দিয়ে দেওয়া হল । রঙ্গিন টেলিভিশনের রিমোট চেপে আমরা আনুষ্ঠানিক ভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশের সূচনা করলাম ।
কিন্তু তিন নাম্বার দিন রাতে আমরা ভাইবোন আবিস্কার করলাম আমাদের দুইজনেরই মন খারাপ এবং এই মন খারাপের কারন পুরাতন সেই সাদাকালো টেলিভিশন । আমার বোনের ‘অদ্ভুত’ বক্তব্য ছিল ‘বেচারা সাদাকালো টেলিভিশন এতদিন আমাদের সাথে ছিল , অথচ ‘নতুন মানুষ’ পেয়ে আমরা তাকে ঘর থেকে বের করে দিলাম । আমাদেরকে ফেলে বেচারা টেলিভিশনের নিশ্চয়ই অনেক মন খারাপ হচ্ছে !!’টেলিভিশনের মন খারাপের কথা ভেবে আমাদেরও মন খারাপের মাত্রা বাড়তে থাকলো । যন্ত্রের কোন মন থাকেনা সেটা বোঝার বয়স তখন দুইজনেরই ছিল । তারপরেও আমরা আমাদের পরিবারের পঞ্চম সদস্য সাদাকালো টেলিভিশনের কারনে মন খারাপ করে বসে রইলাম।
#
সেই দিন গুলো অনেক আগেই হারিয়ে গেছে । বোনের বিয়ে হয়ে গেছে । এখন বাসায় মানুষ আমরা তিনজন আর টেলিভিশন দুটো । যার যার পছন্দের চ্যানেল আলাদা । আম্মার পছন্দের অনুষ্ঠানের সময় আব্বা মুখ গোমড়া করে বসে থাকেন আবার আব্বার পছন্দের অনুষ্ঠানের সময় আম্মা মুখ গোমড়া করে বসে থাকেন । টেলিভিশন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তাদের ঐক্যমত কখনই হয়না । আমার পছন্দের তেমন কিছু নেই । দুই সেকেন্ড পর পর চ্যানেল বদলে বদলে দেখতে থাকি । একা একা দেখতে হয় বলে তেমন কিছুতেই আনন্দ পাইনা । আবার আমার বোন যখন বাসায় আসে তখন আবার স্টার প্লাসের যন্ত্রনা সহ্য করতে হয় । চোখ-কান বন্ধ করে থাকা ছাড়া উপায় থাকেনা ।
এখন চাইলেও সবাই একসাথে বসে একটা অনুষ্ঠান দেখা হয়না । টেলিভিশনের চ্যানেল আমাদের মাঝে দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে । মাঝে মাঝে মনে হয় ছোটবেলার মনের রঙ এখন টেলিভিশনের কাচের ভেতরে বন্দী ।
হারানো দিনগুলো সবসময়ই আনন্দের হয় । এমন না যে আবার সাদাকালো টেলিভিশন কিনে ফেললে সব কিছু আগের মত হয়ে যাবে । আমরা বড়রা (আমার বেলায় বড় না হয়ে হবে ‘মাঝারি’) ছোটবেলাকে খুব মিস করি । আর যারা ছোট তারা বড় হওয়ার জন্য প্রতিদিন আপ্রান চেষ্টা করে । ছোটরা একদিন বড় হয় ঠিকই আর তখন তারা একটা কঠিন সত্য আবিস্কার করে, ‘চাইলেও আর কোনদিন ছোটবেলায় ফিরে যাওয়া যাবেনা...’
আলোচিত ব্লগ
দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া
১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন
ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন্যায়ের বিচার হবে একদিন।

ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন
আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন
মিশন: কাঁসার থালা–বাটি
বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন
আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।