somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সতের শতকে ঢাকা

১৪ ই নভেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৬৩৯ খৃস্টাব্দে শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র সুলতান মুহাম্মদ সুজা বাংলার শাসনকার্যে নিযুক্ত হন। দীর্ঘ ৩০ বছর পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার সাথে এদেশের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তার আমলে বিহার আলাদা একটি রাজ্যরূপে গণ্য হয়। সুলতান মুহাম্মদ সুজা বাংলায় এসে প্রথমে ঢাকা থেকে নিজামতের দপ্তর রাজমহলে নিয়ে যান। তিনি সুসজ্জিত দালান কোঠা তৈরী করে ওই এলাকাকে আরো বেশি সুসজ্জিত করে তোলেন। কথিত আছে যে, সুলতান মুহাম্মদ সুজা রাজমহলে উপস্থিত হলে মিঃ বাটন তার সেবা করার সৌভাগ্য লাভ করেন। ঘটনাচক্রে শাহজাদার কোনো এক মহিলা কঠিন রোগে আক্রান্ত ছিলেন। মিঃ বাটনের চিকিৎসার সুখ্যাতি জানতে পেরে শাহজাদা তাঁকে ওই মহিলার চিকিৎসা করার নির্দেশ দেন। মি: বাটনের চিকিৎসায় মহিলা আরোগ্য লাভ করায় মিঃ বাটন আরো বেশি অনুগ্রহ ও অতিরিক্ত মর্যাদা লাভ করেন। এ সেবার পুরস্কারস্বরূপ শাহজাদা ইংরেজ দলকে হুগলী ও বালেশ্বরে ব্যবসা-বাণিজ্যের ভিত্তি স্থাপনের অনুমতি প্রদান করেন। সুলতান মুহাম্মদ সুজা পিতার প্রতি শ্রদ্ধাবনত ও অনুগত থেকে ৮ বছর ধরে বাংলার শাসনভার পরিচালনা করার পর কাবুলের সুবেদার পদে নিযুক্ত হন। দু'বছর ওখানে কাটানোর পর আবার বাংলায় ফিরে আসেন। এবার ৯ বছর ধরে এদেশের শাসনকার্যে বহাল থাকেন। তিনি ঢাকায় রাজধানী স্থাপন করেন। এখনো ঢাকায় তার অনেক ইমারত আছে।
এ সময় পূর্বের চাইতেও এদেশের বহুল পরিমাণে শ্রীবৃদ্ধি হয়। অধিকাংশ কাজের উন্নতি হয়। নানা রকমের কৌশলী-কারিগর ও শিল্পী এখানে এসে বসতি স্থাপন করে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তার লাভ করে। পূর্বে অর্থাৎ ১৫৮২ খৃস্টাব্দে দেওয়ান রাজা টোডরমলের আমলে বাংলার রাজস্ব এক কোটি সাত লাখ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। সুলতান মুহাম্মদ সুজার সময়ে তা এক কোটি একত্রিশ লাখ পর্যন্ত পৌঁছে।
১৬৪৭ খৃস্টাব্দে সম্রাট শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়েন। চারজন শাহজাদা সুলতান মুহাম্মদ সুজা, দারাশিকো, সুলতান মুরাদ ও আওরঙ্গজেব সকলেই শাহী সিংহাসনে বসার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। সুলতান মুহাম্মদ সুজা বাংলা থেকে সৈন্য নিয়ে বেনারস পর্যন্ত পৌঁছেন। ওই দিকে দারাশিকো তার পুত্র সুলতান সোলায়মানকে এক পরাক্রান্ত বাহিনী নিয়ে সুজার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য পাঠান। পরাজিত হয়ে সুজা বাংলায় ফিরে আসেন। দিল্লীতে তিন শাহজাদা পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। সকলকে পরাজিত করে এবং শাহজাহানকে বন্দি করে আওরঙ্গজেব দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন।
আওরঙ্গজেবের সিংহাসনে আরোহণ ও শ্রদ্ধেয় পিতাকে বন্দি করার খবর শুনতে পেয়ে সুলতান মুহাম্মদ সুজা অত্যন্ত চিন্তিত ও বিষণ্ণ হলেও আওরঙ্গজেবের নিকট অভিনন্দনবাণী পাঠান এবং প্রার্থনা জ্ঞাপন করেন যেন তাঁকে বাংলার শাসনকার্যে বহাল রাখা হয়। আওরঙ্গজেব তা মেনে নেননি। তাই সুলতান মুহাম্মদ সুজা অত্যন্ত রেগে এক সেনাবাহিনী নিয়ে দিল্লীর দিকে রওয়ানা হন। কচুয়া নামক স্থানে পৌঁছলে আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনীর সম্মুখীন হন। উভয় বাহিনীর মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ হয়। শুরুতে সুজার সেনাবাহিনী জয়লাভ করে, কিন্তু পরে আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীরজুমলার সুব্যবস্থার দরুণ সুজা পরাজিত হয়ে পশ্চাদপসরণ করেন এবং বাংলার দিকে ফিরে আসেন। প্রথমে রাজমহলে, পরে ওখান থেকে টান্ডায় এসে সেনাবাহিনীকে সুবিন্যস্ত করেন। অপরদিকে মীর জুমলাও এক শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে টান্ডায় উপস্থিত হন। আবার যুদ্ধ হয়। সুজা পরাজিত হয়ে ঢাকার দিকে পালিয়ে আসেন। মীরজুমলা তার অনুসরণ করে ঢাকা পর্যন্ত আসেন। এখানে এসে সুজা দেড় হাজারের বেশি লোক সংগ্রহ করতে পারেননি। তাই রাজত্বের আশা ত্যাগ করে বায়তুল হারাম মক্কা শরীফে গিয়ে বাকি জীবন ওখানে কাটাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে চট্টগ্রামের দিকে চলে যান। দুর্ভাগ্যবশত আরব দেশে যাওয়ার মতো কোনো জাহাজ সংগ্রহ করতে পারেননি। শত্রু সৈন্যের অনুসরণের ভয়ে অবশেষে আরাকান রাজার আশ্রয় গ্রহণ করেন।
আরাকান রাজ প্রথমে অনেক সম্মান ও মর্যাদার সাথে তাকে গ্রহণ করেন এবং যথোপযুক্ত আতিথেয়তা প্রদর্শন করেন। কিন্তু কিছুদিন পর শয়তানের প্ররোচণায় তার সাথে দুর্ব্যবহার ও অনাদর শুরু করেন। সুজার কন্যাকে লাভ করার লোভে হতভাগা শাহজাদাকে পরিবার-পরিজনসহ ডুবিয়ে মারেন। এই দুরাত্মা তার সম্মানহানি করতে চায়। সুজার কন্যা তা বুঝতে পেরে তীক্ষ্ণ ধারালো খড়গ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
সুলতান মুহাম্মদ সুজার সপরিবারে নিহত হওয়ার খবর আওরঙ্গজেবের নিকট পৌঁছলে ১৬৬০ খৃস্টাব্দে আওরঙ্গজেব মীরজুমলাকে মুয়াজ্জম খান খানান উপাধি দিয়ে বাংলার সুবেদার নিযুক্ত করেন। সুবেদার নিযুক্ত হয়ে মীরজুমলা আবার রাজমহল থেকে সুবেদারীর দফতর গড়ে তোলেন এবং উঁচু ইমারত ও নিত্যনতুন কলকারখানা স্থাপন করে আরো সুসজ্জিত করে তোলেন।
এ সময় কুচবিহারের রাজা প্রচুর সৈন্য-সামন্ত নিয়ে বাংলার উত্তর ভাগের অনেক এলাকা দখল করে নেন এবং ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে সেনাবাহিনী নিয়ে ঢাকার নিকট এসে পৌঁছেন। ১৬৬১ খৃস্টাব্দে তাকে উচিত শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে মীরজুমলা এক পরাক্রান্ত বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করেন। তিনি রাজার বাহিনীকে পরাজিত করে কুচবিহার পর্যন্ত অগ্রসর হন এবং সে দেশ দখল করে নেন।
কুচবিহার জয়ের পর মীরজুমলা আসাম জয় করার উদ্দেশ্যে সৈন্য নিয়ে বের হন। সে দেশ আক্রমণ করে জয় করে অনেক লুণ্ঠিত দ্রব্য, নগদ টাকাকড়ি ও মালমাত্তা লাভ করেন। কিন্তু তার সেনাবাহিনীর লোকেরা অসুস্থ হয়ে পড়ার দরুন সেখানে অবস্থান করতে না পেরে ফিরে আসেন। পথে তিনি নিজেও অসুস্থ হন। কথিত আছে যে, মীরজুমলা অসুস্থ অবস্থায় ঢাকায় পৌঁছে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার সাথীরা কর্পুরের সিন্দুকে করে তার মৃতদেহ জন্মভূমি ইস্পাহানে নিয়ে যান।
বাংলার সুবেদারদের মধ্যে মীরজুমলা খুবই প্রসিদ্ধ। মীর জুমলার নির্মাণ কাজের জন্য এখনো তাকে সকলে স্মরণ করে। আরাকানী লুটেরাদের প্রতিরোধ ও শাস্তি দেয়ার জন্য তিনি ঢাকার আশপাশে প্রায় এলাকায় দুর্গ নির্মাণ করেন। ওই নিদর্শনাবলী এখনো দেখতে পাওয়া যায়। যেমন নারায়ণগঞ্জের নিকট হাজীগঞ্জের মুন্সীগঞ্জের এদ্রাকপুরে, মেঘনা নদীর পূর্বে দাউদকান্দি প্রভৃতি জায়গায় তিনি দুর্গ নির্মাণ করেন। শহরের ভেতরে ও বাইরে প্রায় জায়গায় পুল ও বড় বড় সড়ক নির্মাণ করেন। পাগলার পুল ও টঙ্গীর পুল এ সময়ে তৈরি হয়। কথিত আছে যে, টঙ্গী শাহ নামে এক ফকির টঙ্গীরপুল নির্মাণ করেন।
আরাকানী মগদের তাড়ানো ও ভয় দেখানোর জন্য মীরজুমলা বড় বড় কামান সংগ্রহ করে দুর্গ স্থাপন করেন। সবচেয়ে বড় দু'টি কামান শহরের দক্ষিণ দরজায় নদীর দিকে স্থাপন করেন। একটি কামান চকে রাখা হয়েছে। আরো বড় একটি কামান নদী ভাঙনের দরুন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। মীরজুমলার আমলে ঢাকার জনসংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পায় এবং এখানে বেশি করে লোকবসতি স্থাপন করে। নানা ধরনের বাড়ি এবং সব প্রকারের কলকারখানা চালু হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের খুব প্রসার হয় এবং সকল দেশের ব্যবসায়ীরা এখানে আগমন করেন। (সংকলি,নিষ্কাম মিত্র)
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাজাকার হিসাবেই গর্ববোধ করবেন মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৮


একজন রাজাকার চিরকাল রাজাকার কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা নয় - হুমায়ুন আজাদের ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হতে চলেছে। বিএনপি থেকে ৫ বার বহিস্কৃত নেতা মেজর আখতারুজ্জামান। আপাদমস্তক টাউট বাটপার একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে কোন প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত? ১৯৭১ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাবনা

লিখেছেন মুনতাসির, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৩

বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রশ্নটি প্রায়ই ব্যক্তি বা দলের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি অনেক বেশি প্রজন্মভিত্তিক রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ এর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭


ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে চাঁদগাজীর নাম দেখাচ্ছে। মুহূর্তেই আপনার দাঁত-মুখ শক্ত হয়ে গেল। তার মন্তব্য পড়ার আগেই আপনার মস্তিষ্ক সংকেত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×