somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ কানা গলি

১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ বিকাল ৩:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আবছা অন্ধকারে গলির শেষটি দেখা যাচ্ছে না। শীতের শেষ বিকেল। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। একটু কুয়াশা পরেছে এদিকটায়। বড় রাস্তা থেকে রিকশার টুং টাং শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। গলির দুপাশে তিন চার তলা দালান। নীরব গলির একধারে কয়েকজন কলেজ পড়ুয়া ছেলে আড্ডা দিচ্ছে।

তিন তলার এই বাসার নীচ তলাতে বীথিরা থাকে। এতক্ষন সে তার বোনের সাথে বসে চুল বাঁধছিল আর চিনা বাদাম খাচ্ছিল। সাধারনত বাদাম খেতে মজাই লাগে, তবে শেষ বাদামটি পচাঁ ছিল , খাওয়ার মজাই শেষ হয়ে গেছে। ওরা দুজনেই অনার্সে পরে, একই ইয়ারে। ওদের ভীষন ভাব। হা হা হি হি চলছে সেই দুপুর থেকে। তবে সন্ধ্যা থেকে সে উদাস হয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। জানালার কাঁচে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। বাইরের শীতের ধারালো আক্রমন আর বাসার ভেতরের গরম হাওয়া জানালাতে একটি অসচ্ছ আবরন তৈরি করেছে। ঐ আবরন ভেদ করে বাইরেটা বেশ রহস্যময় লাগছে। বাইরে থেকে দেখা না গেলেও ভেতর থেকে সবই দেখা যাচ্ছে। বীথির হঠাৎ মনে হল শেষ বিকেলের এই আলো ছায়াতে, ও যদি কারো হাত ধরে এই জানালাতে দাড়িয়ে সন্ধ্যা নামাটা দেখতে পারত। এগুলো কি ছাই মাথা ভাবছি- বীথি লজ্জা পেল। মানুষ কি বিচিত্র, কি সব অদ্ভুদ কথা ভাবে। ওর এই মুহুর্তের ভাবনা কেউ জানতে পারলে কি লজ্জায়ই না পড়তে হত। তবে ওকে আশ্চর্য করে দিয়ে গলির মাথাতে একটি রিকশা এসে থামল। রিকশা থেকে সুমন ও বাবু নামল। বীথির মুখটি লজ্জায় লাল হয়ে গেল। ওর মনে হল ওর ভাবনাগুলো মেঘের ডানা মেলে শহরের প্রান্তে প্রান্তে পৌছে গেছে। বিকেল থেকেই মন হচ্ছিল আজ ওরা আসবে। একথা ভাবতে ভাবতে বীথি ভেতরে চলে গেল সাজতে।

ঢাকা শহরের কত গলি আছে, কেউ কি জানে। এরকম গলির একটা সাধারন বৈশিষ্ট্য থাকে। গলিগুলো সরু হয়, ড্রেনের দুর্গন্ধ থাকে, এবং ভয়ংকর সব কুকুর ঘোরাঘুরি করে। এগলিতেও কয়েকটি নিরীহ কুকুর জুলু জুলু চোখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখানে আরেকটি বৈশিষ্ট্য যোগ করা যায়- গলিটর একটি মাথা বন্ধ, অর্থাৎ কানা গলি। শীত একটু একটু করে বাড়ছে। এখন আলো কমে সন্ধা নেমেছে।

ওরা এখনই ক্যাম্পাস থেকে ফিরল। সুমনের খুব অস্বস্তি হচ্ছে। এভাবে কারো বাসার সামনে সে দাড়িয়ে থাকতে অভ্যস্ত নয়। অথচ প্রায় এক ঘন্টা ধরে ওরা এই তিন তলা বাসটি থেকে একটু দুরে কায়দা করে দাড়িয়ে আছে। এমন ভাবে দাড়িয়ে থাকলে টেনশন হয়। তখন একটা সিগারেট ধরালে টেনশন কমে। অথচ এলাকার সবাই ওদের ভাল করে চেনে। দেখে ফেলতে পারে। তখন আবার আরেক ঝামেলাতে পরতে হবে।

চুন কাম উঠে যাওয়া দেয়ালের গায়ে মলিন টিউব লাইটের আলো কয়েকটি জীবন্ত অদ্ভুদ ক্যারেকটার তৈরি করেছে। দেয়ালের ছবিগুলো জীবন্ত মনে হচ্ছে।
- স্যার এখানে দাড়িয়ে কি করছেন? - ছবিগুলো কথা বলছে।
- তাতে তোমাদের কি দরকার?
- না মানে আমাদের একটু দরকার ছিল, আমাদের গায়ে সবাই দুনম্বরটা করে কি না- দেয়ালের ছবিগুলো মুখ ভেঙ্গানো ভাব করল।
- করলে ভাল ব্যাটা - নীরস মুখে সুমন জবাব দিল।
- কি যে বলেন স্যার। আমরা খুবই সাধারন দেয়াল। ইউনিভার্সিটির দেয়াল হলে, কত সুন্দর কথা ডিজাইন করে লেখা থাকত। যেমন ধরেন স্যার - " এক দফা এক দাবি - এরশাদ তুই কবে যাবি"। -ছবিগুলো কথা বলেই যাচ্ছে।

-এই সুমন , সুমন - বাবুর ঝাকুনিতে সুমনের সম্বিৎ ফিরল। ভাবনার জগত থেকে সুমনের প্রস্থান হল। এখানে এলেই এরকম সমস্যা হয়- ও খেয়াল করে দেখেছে।

বাবু ,চল চল আটটা বেজে গেছে- সুমন তাড়া দিল।
-আরে দাড়া, এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই, একটা সিগারেট খেয়ে নেই।

আজ এ বাড়িতে আসার কোন প্লানই ছিল না। কদিন পড়ার ভীষন চাপ গেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং এর সব জটীল হিসেবে মাথা তালগোল পাঁকিয়ে গেছে। আজ একটু আড্ডা দিতে পারলে ভালই লাগবে। সপ্তাহান্তে মনের চাপটি কমতো, হয়তো চোখের ও। হঠাৎ মনে হল একটি রেলগাড়ি হুইসেল বাজিয়ে সুমনের বুকের মাঝ দিয়ে চলে যাচ্ছে। এরকম সব সময়ই হয় এই গলিতে এলে, এই বাড়িতে এলে।


যখন দরজায় কড়া নাড়ল, তখন নয়টা বেজে গেছে।

- কি খবর তোমাদের - বিথী বলল, সাজলে ওকে পরীর মত দেখায়।
- ভাল- বাবু হাসিমুখে জবাব দিল।
- একটা কাজে এসেছি, বেশিক্ষন থাকব না- সুমন যোগ করল, একথা বলে সে একটি খাম বাড়িয়ে দিল।
- বীথি ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে জিগ্সাসা করল - এটা কি?
- রেখে দাও- পরে এসে নিয়ে যাব -বাবু বলল।
- কেন?
- ওটাতে কিছু দরকারি কাগজ আছে, যেটা আমার কাছে থাকাটা নিরাপদ না।
কিচ্ছু না ভেবেই বীথি খামটি নিয়ে বলল- আচ্ছা।
- বাবু, মা তোমার সাথে কথা বলবে। বাবু ভেতরে চলে গেলে ঘরে নীরবতা নেমে এল। বীথিরা বাবুকে ছোটবেলা থেকেই চেনে। সমবয়সী ওরা। তবে সুমনের সাথে বীথির আজ নিয়ে মাত্র কয়েকবার দেখা হয়েছে।

- এত দিন পরে এলে?
- পড়াশুনার চাপ ছিল।
- ফোন করতে পারতে একটা।
- "কয়েন" ছিল না- একথা বলে সুমন হাসল।
- হা হা। ইউনিভার্সিটির খবর কি?
- কয়েকদিন পরপরই হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে- কবে পাশ করব জানি না- একথা বলে সুমন হাসল।
- তবে তো ভালই হয়। হল বন্ধ হলেই এখানে চলে আসবে- একথা বলেই বীথি লজ্জা পেল।
- শোন আমি ঠিক করেছি এদেশে থাকব না।
- তাহলে কোথায় যাবে?
- এদেশে চাকরী নেই, তবে সমস্যা একটা আছে- একথা বলে সুমন দুস্টমি ভরা চোখে তাকাল।
- কি সমস্যা?- বীথি হাত নাড়াল।
- বিদেশে তোমার মত গল্প করার কাউকে পাওয়া যাবে না।
- তাহলে আমিও যাব।
- আর ইউ শিউর?
- হা।

রাতে খেয়ে ওরা চলে গেল। যাওয়ার সময় ওদের কেমন বিষন্ন দেখাল। হয়ত ওরা ক্লান্ত। জানালার পাশে দাড়িয়ে বীথি ওদের চলে যাওয়া দেখল। আধা ভাঙ্গা চাঁদের শহুরে জোছোনাতে ওরা হারিয়ে যাওয়ার আগেই দুচোখে জলের প্লাবন এল।

ক্লান্ত পায়ে ধুলোর রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সুমন ভাবছিল শহুরে প্রেম কি হারিয়ে যেতে পারে এই সুন্দর জোছোনায়, তা সে যতই রূপকথার মত অবাস্তব হোক না কেন, তা সে যতই কানা গলির মতই গন্তব্যহীন হোক না কেন। আজকের রাতটি তো সত্যি। সে ফিরে চেয়ে দেখে তিন তলা বাড়িটি যোজন থেকে যোজন দূরে চলে যাচ্ছে, ক্রমশ, এই সুন্দরী রাতের ছায়াতে।



--------------------------------------

পাদটীকা : ছবিটি আমার তোলা
ছোট গল্পে কাহিনী লিখা যায় না। কিছু টুকরো অনুভুতি কেবল প্রকাশ করা সম্ভব।
গল্পের সময়কাল নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন।
গল্পের চরিত্ররা কাল্পনিক।
আমার মতে এই "গল্প" কিছুই হয়নি।

সর্বশেষ এডিট : ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ বিকাল ৩:৪১
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×