পুরান ঢাকায় শ্যাম বাজার এলাকায় মুক্তধারা প্রকাশনীর একটি বড় প্রেস ছিল। প্রতিদিন এই প্রেসের পাশ দিয়ে হেঁটে স্কুলে যেতাম। এই প্রেসের মুখে একটি বিরাট লোহার গেট ছিল। এখান দিয়ে যাওয়ার সময় সব সময়ই ভেতরে যেতে ইচ্ছে করতো। কিন্তু মোটা মোছে দারোয়ান দেখে অন্তর শুকিয়ে যেত। ভেতরে ঢোকার প্রশ্নই ওঠে না।
তখন মুক্তধারার অনেক নামডাক। প্রতি বছর স্কুলের পাঠ্য বইয়ের তালিকায় মুক্তধারার বেশ কয়েকটি বই থাকত। এছাড়া, গল্প উপ্যনাসের বই গুলোও এখানে প্রকাশ হত। বিশেষ করে কলকাতার লেখকদের বেশ বড় একটি অংশ মুক্তধারা থেকেই বই করতেন। সুনীলের কবিতার বই, বা সমরেষ মজুমদারের গোয়েন্দা কাহিনী সবই পাওয়া যেত।
বাংলা বাজারে এই বই গুলো পাওয়া যেত। নতুন বই কিনে প্রথম যে কাজটি করতাম সেটি হল- নতুন বইয়ের ঘ্রাঁন গ্রহন করা। কতকাল বাংলাদেশের সেই পুরোনো পরিচিত বাংলা বইয়ের দোকানে যাওয়া হয়নি সেটি আজ আর মনে পড়ে না। তাই নতুন কোথাও গেলে লাইব্রেরী খোজ করি। মানুষ বোধ হয় সব সমই তার সুখের স্মৃতিতে ফিরে যেতে পছন্দ করে। সে জায়গাটি থেকেই এবার যখন নিউইয়র্কে গেলাম, খুঁজতে থাকলাম এখানে কি কোন বাংলা লাইব্রেরী আছে কি না। একজন বলেছিল এখানে মুক্তধারার একটি লাইব্রেরী আছে, জ্যাকসন হাইটসএ।

[ছবি: ইন্টারনেট সার্চ রেজাল্ট]
এখানে একদিন সকাল সকালে জ্যাকসন হাইটসে গেলাম সেই লাইব্রেরীর সন্ধানে। ইচ্ছে করেই গুগোল ম্যাপ ইউস করলাম না। এখানে কি নেই , একেবারে ঢাকার নিউ মার্কেট। সবই পাওয়া যায়। কয়েকটি দোকান ঘুরে কিছু প্রোয়জনীয় জিনিস কিনে, পথে একজন দোকানীকে খোজ করলাম মুক্তধারা লাইব্রেরীর কথা।
ভদ্রলোক বাংলাতে কথা বলেন, বয়স ষাটের মত।
-চাচা, এখানে একটি বাংলা লাইব্রেরী আছে না? সেটি কোথায়।
-আমি জানি না, বিরশমুখে আমার দিকে তাকিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘোড়ালেন।
-আপনি কতদিন এখানে ব্যাবসা করছেন?
-তা প্রায় ১০ বছর।
আমি বেশ অবাক হলাম।
এরপরে একজন রোস্তরার বেয়াড়াকে বললাম, ভাই এখানে না একটি বাংলা বইয়ের দোকান আছে? সেটি কোথায়?
না বাই, এইহানে এই নামে কোন দোহান নাই, আমাগোর এইহানে ম্যালা খাওনের দোহান আছে।
এরপর একজন লোকাল বাসিন্দার কাছে জানতে চাইলাম। সে একজন অল্প বয়স্ক তরুণী। বাংলাতে বললেন, সরি, আমি জানি না, আপনি ফোনে সার্চ করলেই পেয়ে যাবেন। একথা বলেই সময় নস্ট না করে, দ্রুত হেটে চলে গেলেন। তখন বুঝলাম, আধুনিক শহুরে মানুষের ব্যাস্ততা অনেক বেশী। বই পড়ার সময় কোথায় তাদের। লাইব্রেরী তো সে অনেক পরের ব্যাপার। নাকি এটি শুধু বাংলাদেশী মানুষের বেলায় প্রযোজ্য- কে জানে?
পশ্চিমা দেশের শহর গুলোতে লাইব্রেরী কত বিশাল ভাবে বানানো হয়। মনে পড়ে একটি লাইব্রেরীতে গিয়েছিলাম, যেখানে, আটতলা ছাদে বিশাল ওক গাছ দেখেছিলাম, যার নিচে বসে কফি খাওয়ার ব্যাবস্থা আছে। একথা ভাবতে ভাবতে গুগোল ম্যাপে মুক্তধারার ঠিকানা দিয়ে, হাটতে লাগলাম। একটু সামনেই পেলাম দোকানটি। একটি ব্যাস্ত রাস্তার ধারে সরু অন্ধকার সিড়ি উঠে গেছে দোতালায়। উপরে উঠে বোঝার উপায় নেই দোকানটি কোথায়। শেষ পর্যন্ত যখন সারি সারি বইয়ের তাকের কাছে নিজেকে দাড় করালাম, মনে হল এই ব্যাস্ত নিউ ইয়র্ক শহরে, আমার এক টুকরো সোনালী অতীতকে খুঁজে পেলাম। সেই একই নতুন বইয়ের গন্ধ, সেই একই নতুন ধারনা। প্রতিটি বই যেন একটি মনকে মুক্ত করার নতুন একটি পথ। আমি ছোটবেলার মুক্তধারা এভাবেই এখানে খুজে পেলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ১:১২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



