somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বন্ধু আমার

১৭ ই জুন, ২০১০ দুপুর ২:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বন্ধু আমার
সত্যকাহিনী অবলম্বনে



বরুণ ছিল আমার ক্লাসমেট। বুদ্ধিসুদ্ধি কম ছিল। লেখাপড়া পারত না। বরুণের পূর্ব ইতিহাসটা একটু বলা আবশ্যক। দু’বছর বয়সে বরুণের বাবা টাইফয়েড জ্বরে মারা যায়। বরুণের মা স্বামীর ভিটাঁ আকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু বরুণের মামারা তা হতে দেয়নি। জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। বরুণের মা কোনোভাবেই রাজি হয়নি। অগত্যা শর্তে রাজি হয়েছিল যে, বরুণ যতদিন ইচ্ছা মার কাছে থাকতে পারবে। বরুণের দ্বিতীয় বাবা ছিল ঐ এলাকার মেম্বার। জায়গা জমি প্রচুর। প্রতাপও যথেষ্ট। লোকজন যথেষ্ট সম্মান করে। সুতরাং তার ছেলে পড়ালেখা করে মানুষ হতেই হবে, যেভাবেই হোক। একছেলে, মানুষ না হলে ইজ্জ্বত বাচে না। সুতরাং যেভাবেই তাকে দিয়ে পড়াশোনা করানো হত। মাথায় তেমন ধরত না বলে, না পারলে শারীরিক নির্যাতন পোহাতে হত। বরুণ যখন ক্লাস সেভেনে-এ পড়ে, তখন ওর মায়েরখুজলির মতো হয়। অসহ্য চুলকানি হত। গ্রামের কবিরাজ ও টোটকা চিকিৎসা করানো হয়েছিল। বরুণের বাবা বড়লোক হলেও যথেষ্ট কৃপণ ছিল। ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাত না। একদিন চুলকানি সহ্য না করতে পেরে পায়ের ঘায়ে এনড্রিন ঢেলে দিয়েছিল, যাতে চুলকানি কমে। কিন্তু ফল হল অন্য রকম। রক্তের মধ্যে বিষক্রিয়া শুরু হয়ে মারা যায়। তখনই নেমে আসে বরুণের জীবনে এক কালো মেঘের ভয়াল ছায়া। ওর জীবন গেল পাল্টে। বছর না ঘুরতেই ওর বাবা আবার বিয়ে করে। বরুণের সৎ মা-ও ছিল গতানুগতিক চরিত্রের। ভালোবাসার মত বরুণের আর কেউ থাকল না। সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম বরুণকে দিয়ে করানো হত। ইতিমধ্যে বরুণের দ্বিতীয় ভাই জন্ম নিয়েছে। এতে বরুণের মার আরও দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল। কারণ বরুণের বাবার জমির মালিকানা যদি বরুণ পায়, এই ভয়। ক্লাস নাইনে ওঠার পর বরুণকে হোস্টেলে এনে রাখল। আমি আর বরুণ একই রুমে থাকতাম। বরুণ সর্বক্ষণই মনমরা হয়ে থাকত, ক্লাসে পড়া পারত না। আমাদের এক বায়োলজীর শিক্ষক, নাম ধরে নিলাম আনোয়ার স্যার, প্রচন্ড বদরাগী ছিলেন। প্রত্যেকদিন বরুণকে কোন না কোন অজুহাতে পেটানো ছিল তার অভ্যাস। আর সবার সামনে দাড়িয়ে একশবার কানে ধরে ওঠবস করাতেন এবং সারাক্ষণ এক পায়ে দাড়িয়ে থাকতে হত।
অন্যান্য ছাত্ররা সবাই খুব হাসাহাসি করত। আর আমি অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে যেতাম একজন শিক্ষকের নিষ্ঠুরতা দেখে। কল্পনাও করতে পারতাম না, মানুষ এতো নিষ্ঠুর হয়। গরুকে যেভাবে পেটানো হয়, বরুণকেও ঠিক একইভাবে দুই বেত একসাথে করে পেটানো হত। যন্ত্রণায় সে মাটিতে গড়াগড়ি খেত, তবুও রেহাই পেত না। আমি তখন ভাবতাম, শিক্ষার কোন সংবিধান এরকম শাস্তির কথা লেখা আছে! আর এরকম শাস্তি দিয়ে কি সত্যিই কাউকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায়?
একদিন বরুণকে পেটানো দেখে আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। দাড়িয়ে উঠে বললাম, স্যার, সবার মেধা সমান থাকে না। সবাই লেখাপড়া করতে পারে না। ওকে মারবেন না। সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ার স্যার গর্জন করে বললেন, কি বলছ? এত বড় সাহস তোমার? এদিকে আসো। আমি বিন্দুমাত্র ভ্রক্ষেপ না করে এগিয়ে গেলাম। সযার আমাকেও পেটানো শুরু করলেন। আমি টু শব্দটিও করলাম না। নির্বিকারভাবে দাড়িয়ে রইলাম। আমার চোখে এক ফোটাও জল আসল না। এত মার খাওয়ার পরও আমি খুশি হলাম এ কারণে যে, একটা অন্তত অন্যায়ের প্রতিবাদ তো করতে পারলাম।
এদিকে বরুণের সকালের নাস্তার জন্য এক মাস পর পর এক টিন ভরে চিড়া ও গুড় দিয়ে যেত ওর বাবা। ওই চিড়ায় এক মাস চলত না বলে সকালে হাফ প্লেট খেত আর আমরা হোস্টেলে গিয়ে পরটা আর মাংস খেতাম। বিকালে আমি বিস্কিট খেতাম। ওকে সাধাসাধিকরেও খাওয়াতে পারতাম না। অত্যন্ত অভিমানী ছেলে ছিল। খেতে বললে বলত, খিদে নেই। অথচ ওর শুকনো ম্লান মুখটা দেখে আমার অন্তরটা হুঁ হুঁ করে উঠত।
অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষার আগের দিন ইচ্ছা করেই ব্লেড দিয়ে নিজের আঙুল কেটে ফেলল। স্যার জিজ্ঞেস করলে বলেছিল, পেন্সিল কাটতে গিয়ে এ অবস্থা। সুতরাং পরীক্ষা সে দিতে পারল না।
ঈদের ছুটিতে বরুণ বাড়িতে গেল। বরুণদের পাশের বাসায় এক মেয়ে সিবা বরুণের জন্য নাড়ু ও সন্দেশ নিয়ে এসেছিল। বরুণের ঘরে বসে বরুণ খাচ্ছিল ও সিবা গল্প করছিল। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। এ সময় বরুণের মা ঘরে ঢুকে এ অবস্থা দেখে ফেলে। বরুরের বাবাকে ডেকে নিয়ে এসে এবং খাবারগুলো কেড়ে নেয়। বরুণের মা বলতে থাকে, "এতদিনে বুঝি এই কান্ড! এই মেয়ের সাথে প্রেম চলছে। হারামজাদা"। ইত্যাদি বলেই বাবা ও মা মিলে বরুণকে পেটায়। রাতে খাবার দেয়া হয় না। তিনদিন ঘরে আটকে রাখে। ঘর থেকে বের হয়ে আবোলতাবোল কথা বলতে থাকে। পাশের বাড়িতে এক কবিরাজ এসে বলে, "ওকে জীনে ধরেছে, জীন তাড়াতে হবে"। এই বলে বরুণের মাথার চুল কেটে শীতের সারা রাত পুকুরে দাঁড় করিয়ে রাখে। পরের দিন সকালে বরুণে নাক মুখ বন্ধ হয়ে সারা মুখ কাপড় দিয়ে পেচিয়ে জল ঢেলে দেয়া হয়, তারপর দুই কান ছিদ্র করে তাবিজ বেধে দেয়া হয়
পনেরো দিন পর হোস্টেলে ফিরলে ওর এই অবস্থা দেখে সবাই হাসাহাসি করতে থাকে। রাতে জিজ্ঞেস করলে সমস্ত ঘটনা আমাকে খুলে বলে। আমি ওকে সান্তনা দেবার কোন ভাষা খুজে পেলাম না। বার্ষিক পরীক্ষার আগের দিন দেয়ালে ইচ্ছা করে জোরে ঠুকে মাথা ফাটিয়ে রক্তারক্তি কান্ড ঘটিয়ে ফেলে। ওর বাবা আসে। সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে পারে। যথাসম্ভব ব্যান্ডেজ বেধে ওকে দিতেই হবে। পরীক্ষার আগের রাতে আমাকে বলল, পরীক্ষায় পাস করব না। ফেল করলে তো বাবা আমাকে মেরেই ফেলব। কি করব, এখন বল।
আমি বললাম, চিন্তা করিস না। পরীক্ষা দে, পরে যা হয় দেখা যাবে। বায়োলজী পরীক্ষার আগের দিন আনোয়ার স্যার ওর পকেট চেক করে এক টুকরো কাগজ পেল। আমি পরীক্ষা কোন রকম শেষ করে বরুণকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম।
রেজাল্টের আগের রাতে বরুণ আমাকে বলল, আমি তো নির্ঘাত ফেল করব, এখন উপায়? আমি বললাম, চিন্তা করিসনে, ঘুমিয়ে পড়। যা হয় আমি সামলাব। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ফ্যান-এর সাথে বরুণ ঝুলছে। আত্মহত্যা করেছে বরুণ। একটা চিঠি আমার টেবিলে ভাজঁ করে রাখা।


ইরাজ,
বন্ধু আমার। মা মারা যাবার পর ভালবাসা বলতে যা বোঝায় একটু হলেও তোর কাছ থেকে পেয়েছি। এ ঋণটুকু নিয়ে চলে গেলাম। তাছাড়া বেঁচে থাকলেও ঋণ শোধ করতে পারতাম না। তাই অনর্থক ঋণ বাড়িয়েই বা কি লাভ হত? ভাই আমার, জানি তুই দুঃখ পাবি। কিন্তু আমি বেঁচে থাকলে যে দুঃখ পোহাতে হত তা কি কোন অংশে কম হত, তুই বল? তুই ভাল ছাত্র। অনেক বড় হবি জীবনে। অসংখ্য বন্ধু বান্ধুবের মাঝে এই বরুণকে মুছে ফেলতে তোর বেশি কষ্ট হবে না। আমার দুঃখের কথা শুনে তোর চোখে জল এসে পড়ত। তোর চোখের জলটুকুই আমার সমস্ত জীবনের পাওনা ছিল। বন্ধুর কাছ থেকে বন্ধুর, এর চেয়ে আর বড় কি পাওনা হতে পারে, তুই বল? আত্মহত্যা করেছি বলে আল্লাহ হয়তো আমায় মা করবে না। অবশ্য মা আমিও চাই না। তবে একটা জিনিস শুধু জানতে ইচ্ছে হয়, আল্লাহর এমন কি লাভ হলো? যা হোক, তুই বড় হয়ে মানুষ হবি। আমি তোকে একটা শেষ অনুরোধ করব। আর যাই হোস, শিক্ষক হবি না কোন দিন। কারণ (যদিও তুই হবি না) আমাদের মত বরুণদের বেঁচে থাকতে দিলে এমন কি ক্ষতি হবে?






পরের দিন রেজাল্ট হলো। আমি ক্লাসে যাইনি। পরে শুনতে পেলাম বরুণও সব বিষয়ে পাশ করেছে, শুধু বায়োলজী ছাড়া, ফলে সে ফেল করেছে।

বি.দ্র : বরুণ হিন্দু



সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০১০ দুপুর ২:৪৭
৬টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাজাকার হিসাবেই গর্ববোধ করবেন মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৮


একজন রাজাকার চিরকাল রাজাকার কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা নয় - হুমায়ুন আজাদের ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হতে চলেছে। বিএনপি থেকে ৫ বার বহিস্কৃত নেতা মেজর আখতারুজ্জামান। আপাদমস্তক টাউট বাটপার একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে কোন প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত? ১৯৭১ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাবনা

লিখেছেন মুনতাসির, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৩

বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রশ্নটি প্রায়ই ব্যক্তি বা দলের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি অনেক বেশি প্রজন্মভিত্তিক রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ এর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭


ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে চাঁদগাজীর নাম দেখাচ্ছে। মুহূর্তেই আপনার দাঁত-মুখ শক্ত হয়ে গেল। তার মন্তব্য পড়ার আগেই আপনার মস্তিষ্ক সংকেত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×