গাড়িতে সবেমাত্র উঠে একটা সিগনাল পার হচ্ছেন রেবেকা। এখনো সিগন্যাল ছাড়েনি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অপেক্ষা করছেন কখন ছাড়বে গাড়ি। হঠাৎ চোখ গেল পাশের একটা গলিপথের দিকে। একটা মেয়ে, তারই বয়সী কিংবা আরো কমই হবে বয়স। মাথাটা নিচু করে হন হন করে ত্রস্তপদে গলিটা অতিক্রম করে বাসায় ঢুকে গেল। গলির মোড়ে চায়ের দোকান থেকে কিছু তীর্যক মন্তব্য যেন মেয়েটাকে অনুসরন করে ঢুকে গেল ছয়তলা দালানটায়। মেয়েটা দ্রুত বাড়ির ছোট্ট গেটটা ঝন ঝন শব্দ করে লাগিয়ে দিল। কিন্তু গেটের ঝনঝন আওয়াজ ছাপিয়ে শোনা গেল হো হো হাসির শব্দ আর আরো কিছু বেসুরো গলার অশ্লিল গান আর শীষ। ওই শীষ আর অশ্লিল গানের তীর্যক লাইনগুলোকে আটকাতে পারলো না বাসার লোহার গেটটাও। অন্তত রেবেকার তাই মনে হল। এরপর মানষচক্ষে দেখতে পেল সিড়ি বেয়ে মেয়েটা উঠে যাচ্ছে তার ফ্ল্যাটের দিকে। হয়তো মনে মনে রাগে ফুসছে। ক্ষোভে দু চারটি গালিও বেরিয়ে আসছে মেয়েটার মুখে। কিন্তু গুমোট মনের সেই শব্দ বাতাসে নতুন কোনো কম্পন যুক্ত করছে না। সেই শব্দগুলো হয়েতো ঠোটের কোনায় কম্পন তুলে কখনো বের হবে না। মেয়েটা হয়তো বাসায় ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে খুব মন খারাপ করে বসে আছে এতক্ষণে। রেবেকার গাড়িটাও ঢাকা শহরের বিখ্যাত ট্রাফিক জ্যামের মধ্যেই আবার এগোতে শুরু করেছে। মেয়েটার কথা ভাবতে ভাবতে রেবেকার মনে হল, আচ্ছা মেয়েটার ফ্ল্যাট যদি দোতলা বা তিনতলায় হয় তখন কী হবে। এই তীর্যক বাক্যবাণ তো তার ঘরেও তাকে স্বস্তি দেবে না। সে হয়তো বিছানায় গুমরে কাঁদবে। ভাবতে ভাবতে যেন ছবিটা পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে রেবেকা। মনোবিজ্ঞানের তরুন শিক্ষিকা রেবেকা মেয়েটার মনের ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করছে কল্পনায়। আচ্ছা কি নাম হতে পারে মেয়েটার? একটা নাম না থাকলে তার মনোরাজ্যে বিচরণটা স্বস্তিকর হয় না। মেয়েটা দেখতে বেশ মিষ্টি। রেবেকা ভাবলো আচ্ছা একটা নাম দেয়া যাক। উম, কি নাম হতে পারে, আচ্ছা, নিজের সঙ্গেই মিলিয়ে রাখা যাক নামটা! রাইনা? নাহ, রাইসা। ছোট্ট করে ডাকলে রাসু। আচ্ছা রাসুর মনোজগতে ঢোকা যাক এবার। আচ্ছা রাসু কী করে? ধরা যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সেটাই ভালো। দেখতে বেশ মিষ্টি মেয়েটা। শান্তশিস্টই হবার কথা। কেমন চুপচাপ মাথা নিচু করে হেটে গেল। রাসু নিশ্চয়ই ক্লাসে গিয়েছিল। সেখান থেকেই ঢোকা যাক তার মনের ভেতর। ক্লাস থেকে বেরিয়ে রিক্সা নিয়ে বাসায় ফিরছে রাসু। মনের চোখে দেখছে রেবেকা। এইতো আরো কত মেয়েই যাচ্ছে রাস্তা ধরে। কিছু মানুষজন কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। এই দৃষ্টিটা খুবই উৎকট। রাসুকে নিশ্চয়ই এমন কয়েক ডজন দৃষ্টির সামনে দিয়ে আসতে হয়েছে বাসা পর্যন্ত। কেউ যখন রাসুর দিকে এভাবে তাকায় তার খুব খারাপ লাগে। নিশ্চয়ই লাগে। সেও হাত পা নাক চোখ বিশিষ্ট মানুষ। যারা তাকাচ্ছে তারাও। তবু ওদের চোখগুলো পশুর মতই লাগে রাসুর। হুট করে রেবেকা যেন রাসু হয়ে যায়। সে দেখতে পায় এই পশুর মত চোখগুলোর সামনে রাসু কেমন করে মাখা নিচু করে ফেলছে। এই অবসরে রেবেকা রাসু হয়ে যায়। রাসুর চিন্তাগুলো তার মাথায় ঢুকে পড়ে। মানুষ এত খারাপ কেন? আচ্ছা তারিফও কি রাস্তা দিয়ে যাবার সময় অন্য মেয়েদের মাথাগুলো এভাবে নিচু করতে বাধ্য করে নাকি তার কঠোর চাউনির তীব্রতা দিয়ে? আজই জিজ্ঞেস করতে হবে। বাসায় ফিরেই জিজ্ঞেস করতে হবে। আহ বাসা! বাসার সামনে রিক্সা থেকে নেমে গলিপথটুকু যেন পুলছেরাত। দিনরাত এত (অ)মানুষ যে কোথা থেকে আসে। আচ্ছা ভালো করে খেয়াল করে দেখতে হবে তো রোজই কি একই গ্রুপ বসে নাকি আলাদা আলাদা গ্রুপ? নাহ একই গ্রুপ হলে চিনতে পারতাম। দোকানে তো বহু মানুষ আসে। প্রতিদিন মনে হয় ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি আসে। কিন্তু সব মানুষগলোর গলায় একই শীষ কেন বাজে? কীভাবে? একটা দিনও তো মিস হয় না। প্রতিদিন এভাবে মাথা নিচু করে গলিটা পার হতে ভালো লাগছে না আর। আব্বুকে বলতে হবে বাসা বদলাতে। কিন্তু অন্য পাড়ায়ও যদি একই রকম একটা দোকান থাকে? এই শহরটায় তো প্রতি পাড়ায়ই একটা চায়ের দোকান মাস্ট। ওই যে রাস্তার পাশে আরেকটা চায়ের দোকান। উফ! আবারো সেই পশুদের চাহনি। মাথাটা নিচু করে ফেলাই ভালো। যাক বাবা পার হয়েছি। আহ,ভালো লাগে না। আরে! কি সুন্দর ফুল। রাস্তার পাশে ফুটপাতের নার্সারিটায় তো ভালো ফুলের কালেকশন এসেছে। কাল কিনতে আসতে হবে। কিন্তু এখানে মাঝপথে রিক্সা থামিয়ে ফুল কিনতে গেলে দুইবার রিক্সাভাড়া দিতে হবে। ফুটপাতে দাঁড়ালে কিছু লোক গায়ের ওপর উঠে পড়তে চায়। খুব বিরক্ত লাগে। ক্রিপি সব। নাহ থাক লাগবে না ফুল। ঘরে কিছু ফুল থাকলে ভালো হতো। বারান্দায় একটু সবুজের সঙ্গে কিছু রঙিন ফুল মনটা জুড়িয়ে দেয়। ফুলের পাতায় আলোর নাচনটা বেশ। বাবাকেই বলতে হবে। কিন্তু বাবা যেই ব্যস্ত। সময় করে আর মনে রেখে ফুল কি এনে দিতে পারবে। ঠিক আছে, তারিফকেই বলবো। ও ঠিক এনে দেবে। আচ্ছা তারিফ কোথায় এখন। একটা ফোন দেই। না থাক রিক্সা থেকে নেমে বাসায় ফিরেই দেই। যাক এসে পড়েছি। আহ যে গরমটা পরছে বাবা। অস্বস্তি লাগতেছে। বাসায় ফিরেই ঝুপ করে গোছলটা সেরেই বিছানায় ডুবে যাবো। আবার সেই গান। গা ব্যাটা, যে সুর তোদের, গান শুনলে কুত্তাও দৌড়ে পালাবে। তোদের গলায় গলগণ্ড হোক। আওয়াজ আরো বেসুরে হোক। সিগারেটের ধোাঁয়াটা অসহ্য। কেমন অসভ্যের মত ধোয়াগুলো ফু মারছে এদিকে। মরবি একদিন ক্যান্সার হয়ে ব্যাটারা। মাথা নিচু করে যাচ্ছি বলে হাসতেচিস না! তোদর মাথায় বাজ পড়ুক। উফ! কী অসভ্য গান। আহ গেটটা এত দুরে কেন! পথটুকুর কি শেষ নেই। পেছন থেকে নিশ্চয়ই শুয়োরগুলো ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছে। এস পড়েছি। বাচলাম। ওহ। আবার সিড়ি বাওয়া। আরে জুতালো পা থেকে খুলছে না কেন। এই জুতাজোড়া দিয়ে ব্যাটাদের গালগুলোতে সপাসপ মারতে পারলে শান্তি লাগতো। রোজ এই যন্ত্রণা নিতে আর ভালো লাগতেছেনা। কেন আমি এই যন্ত্রণা সহ্য করবো। আমিও তো মানুষ নাকি। ব্যাটারা আবার গান ধরেছে। মনে হচ্ছে গরম পানি ছুড়ে মারতে পারলে গায়ের জ্বালাটা মিটত। চারতালার মিলি আপু মনে হয় ফিরতেছে। তাকে দেখেই গান ধরেছে। আচ্ছা মিলি আপুকে বললে উনি কী একটা ব্যবস্থা নিতে পারবেন? একদিন দুজনে মিলে দোকানে গিয়ে সবগুলোকে শাসিয়ে আসতে পারলে ভালো হত। একটু যে বারান্দটায় দাড়াবো তারও শান্তি নেই। ভাইয়াকে বলে লাভ নেই। সে তো সেদিন বলেই দিয়েছে বারান্দায় না দাড়ালেই তো আর দেখবে না। আরে! আমার বারান্দা আমি দাঁড়াবো না কেন? পুলিশে খবর দিলে কেমন হয়। উহু। হাঙ্গামার ব্যাপার। শেষে মান ইজ্জত নিয়ে টানাটানি পড়বে। আচ্ছা সেদিন ফেসবুকে দেখলাম নারী নির্যাতন বিরোধী কি একটা হেল্পলাইন নাকি খুলেছে। নেটে সার্চ করে দেখি। ও আচ্ছা এইতো। ১০৯। টাকা কাটবে নাকি কে জানে। একটা কল দিয়ে দেখি। একটা ব্যবস্থা নেয়া দরকার। ধুর ছাই কি ছাতার হেল্প লাইন! মেশিন ভয়েসের পর ৫ মিনিট ধরে তো খালি দেখি টুংটাং ই বাজতেছে। কেউ তো কল ধরে না। আবার লিখে রাখছে ২৪ ঘন্টার সার্ভিস। কী যে আজব এক দেশ। ধ্যাত। ইশ এমন কি দিন আসবে না যেদিন হেল্পলাইন এ কল দিলেই ধরবে। অভিযোগ করার সাথে সাথে পুলিশ এসে এই জানোয়ার গুলোকে ধরে নিয়ে যাবে থানায়। আচ্ছা পিটুনি দিয়ে ছেড়ে দেবে। তারপর পাড়ার চায়ের দোকানে আমি আর মিলি আপু গিয়ে দাড়িয়ে চা খেয়ে ওদের ভোতা মুখগুলো দেখে হা হা হো হো করে হেসে আসবো। ওই যে আবার হাসির শব্দ উঠছে। ইশ গানের কি ছিরি! গা শালারা গা। গলার রগ ফেটে মরবি তোরা। আল্লাহ্ মাথাটা এত ব্যাথা করছে কেন। আম্মা ডাকতেছে রান্না ঘরে। এখন গেলেই হাজারটা প্রশ্ন করবে। মুখ গোমড়া কেন? কি হইছে, কে কি করছে, নাকি বলেছে? কি বলবো! পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানের আড্ডার মানুষের গান শুনে মন খারাপ এসব বললে আম্মাই বা কি করবে। থাক বলে আর কি করবো। মাথাটা যন্ত্রণায় টনটন করছে। উফ একটু ঘুমাতে চেষ্টা করি। রাসুর সঙ্গে যেন ঘুমিয়েই পড়েছিলেন রেবেকাও। জেগে দেখে বাসার কাছাকাছি একটা সিগনালে গাড়িটা আটকে আছে। একটা বাচ্চা মেয়ে ফুল বিক্রির আশায় কাঁচের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে আর কি যেন বলছে। ফুল খুব ভালোবাসেন রেবেকা। পথশিশুদের এই বেলি-বকুলের ঘ্রাণটাও বেশ ভালো হয়। কাঁচ নামিয়ে একজোড়া বেলিফুল কিনলেন তিনি। মেয়েটার নামও জিজ্ঞেস করলেন। মেয়েটা টাকা নিয়ে সংক্ষেপে জানিয়ে গেল তার নাম ফুলি। বাহ সুন্দর নাম। ফুল, ফুলওয়ালী ফুলি। ফুলওয়ালী দেখলে বেশ খুশিই হন রেবেকা। কিন্তু আজ এই বাচ্চা মেয়েটাকে দেখে তার রাসুর কথা মনে হল। রাসু একটা ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তার ই যদি এই অবস্থা হয় আহা বেচারি ফুলওয়ালী আরেকটু বড় হলে না জানি কত যন্ত্রণা সইতে হবে তাকে। তার তো ঘরেরও ঠিক নেই। আর দিনের বেশিরভাগ সময়টাই তো কাটে রাস্তায় রাস্তায়। ভাবতে ভাবতে সিগনাল ছাড়িয়ে তার এলাকায় ঢুকলো গাড়ি। এখানেও একটা চায়ের দোকান। আর সেই অশ্লীল গান। বস্তি থেকে রাজধানী একটি অভিজাত আবাসিক এলাকা, পার্থক্য কোথায়! গাড়ি থেকে নেমে সিড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছেন রেবেকা। লোহার গেট পেরিয়ে তার পিছু নিয়েছে গলির সেই শীষ আর অশ্লিল গানের একটা কলি -হাইট্টা যায়, ফাইট্টা যায়। রেবেকার মুখ থেকে একটা গালি বের হয়ে বাতাসে কাপন তুললো- ক্রিপি বাস্টার্ডস। গলির মুখে চায়ের দোকানে বসে আশ্লীল বাক্যে আর গানে মেয়েদের মাথা নিচু করে দেওয়া লোকগুলোর কানে এই আওয়াজটা পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব পাঠকদেরই নিতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০১৮ ভোর ৪:৩৯