somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গ্রিক পুরাণে প্রেমের কাহিনী: আফিয়ার্স ও ইউরিডিস

০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ১১:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আর্গোনটদের সাথে আফিয়ার্সের কাহিনীটি বলেছেন শুধু রোড্‌স দ্বীপের আপোলোনিয়াস, তৃতীয় শতকের গ্রীক কবি। কাহিনীর বাকী অংশ বলেছেন রোমান কবিদ্বয়, ভার্জিল ও ওভিদ। ফলত, দেবদেবীদের রোমান নাম ব্যবহৃত হয়েছে।
গ্রিক পুরাণ মতে পৃথিবীর আদিতম সঙ্গীতকাররা ছিলেন দেবতা্। এথিনা এই কলায় তেমন পারঙ্গমা ছিলেন না বটে, তবে তিনি বাঁশির আবিষ্কর্ত্রী। তিনি নিজে অবশ্য কখনো তাতে ফুঁ দেননি। হার্মিস বানিয়েছিলেন তারের যন্ত্র হার্প, দিয়েছিলেন এ্যপোলোকে। এ্যাপোলো নিজের জন্য তৈরি করেছিলেন রাখালীয়া বাশি। ততে তিনি তুলতেন অপূর্ব সুরধ্বনি। দেবতা প্যান তৈরি করেছিলেন নল খাগড়ার রেণু, যার ধ্বনিটি ছিল বসন্তের নাইটিঙ্গেল পাখির সুরের মতো সুমিষ্ট। মিউজ- কণ্যাদের নিজস্ব কোন বাদ্যযন্ত্র ছিল না; তবে তাঁদের কণ্ঠস্বরই ছিল অতুলনীয়, সকল গীতধ্বনির সেরা।

দেবতাদের পরেই ছিল কয়েকজন মরনশীল মানুষ যারা সঙ্গীতকলায় পারদর্শিতা দেখিয়ে প্রায় দেবতুল্য হয়ে উঠেছিলেন। এদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম আফিয়ার্স। মায়ের দিক দিয়ে অবশ্য দেবত্বের কিছুটা অংশীদার ছিল সে; তার মা ছিল মিউজদের একজন। পিতা জনৈক থ্রেস-দেশীয় রাজকুমার। গ্রীসের তাবৎ লোকদের মধ্যে থ্রেসীয়রা ছিল সর্বাধিক গীতপ্রিয়। দেবতারা ছাড়া আফিয়ার্সের আর কোন প্রতিদ্বন্দী ছিল না, না থ্রেসে না অন্য কোথাও। তার বাশি এবং গানের অসাধ্য কিছু ছিল না। কোন মানুষ, কোন কিছু দমাতে পারতনা তাকে।

থ্রেসীয় পর্বতমালার গভীর বনভূমিতে আফিয়ার্স তার শীতল বাঁশির সুরে তাঁড়িয়ে নিতেন বৃক্ষদের,বনের প্রাণীরা অনুসরণ করতো তার বাঁশির সুর।

আফিয়ার্স বাঁশি বাজাতে বাজাতে যেতেন, আর জড় ও জীব সবাই তার পিছনে পিছনে যেত। তিনি পাহাড়ে পাথর সরাতে পারতেন, নদীর গতিপথ পর্যন্ত পারতেন পাল্টে দিতে।
তবে সঙ্গীতের চেয়ে আফিয়ার্স বিখ্যাত ছিলেন বিয়ের জন্য: ইউরিডিসির সাথে সেই বিয়োগান্তক বিবাহের কাহিনী তাকে অমর করে রেখেছে। বিয়ের আগের জীবন সম্পর্কে বেশি কথা জানা যায় না। তবে একিট বিখ্যাত অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। জেসনের সাথে আর্গো জাহাজে চড়ে সেও স্বর্ণলোমের অভিযানে পাড়ি জমায়। দাঁড় বাইতে বাইতে অভিযাত্রিরা যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ত, তখন বাঁশি বাজাতো আফিয়ার্স । নাবিকরা পেত নতুন উদ্দ্যম: বাঁশির সুরে সুরে তারা দাঁড়ের আঘাতে সমুদ্রের ঢেউকে পাড়ি দিত। আবার যখন নাবিকদের মধ্যে যখন ঝগড়া লেগে যেত তখন আফিয়ার্স বাঁশির মধ্যে এমন সুর তুলতেন যে নাবিকরা শান্ত হতো এবং ক্রোধ ভুলে যেত । এভাবে নাবিকরা অনেক বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছে আফিয়ার্সের বাঁশির কারণে।

ইউরিডিসি নামের মেয়েটির সাথে কোথায় দেখা হয়েছিল আফিয়ার্সের, কাহিনীতে তা স্পষ্ট বলা নেই। তাদের বিয়ে হলো, কিন্তু দাম্পত্যসুখ টিকলো না বেশি দিন। বিয়ের রাতে কনে ইউরিডিসি সখীদের সাথে বাগানে হাঁটছিল। এক সাপ কামড় দিল তাকে, এবং সে মারা গেল। তখন আফিয়ার্স স্থির করল, পাতালে মৃত্যুপরীতে যাবে সে এবং ইউরিডিসিকে ফিরিয়ে আনবে। সে আপন মনে বলল,
আমার গানের সুরে
ভোলাবো ডিমিটারের কন্যারে
ভোলাবো মৃত্যুপুরীর রাজাকে
আমার সুরের ঝংকারে।
হেডিস থেকে ফিরিয়ে আনবোই তাকে।
পাতালপুরীর ভয়াল যাত্রায় পা রাখলো আফিয়ার্স । প্রেমের জন্য মর্ত্যের আর কোন মানুষ এতটা বিপদসংকুল পথে যাত্রা করেনি কখনো। আফিয়ার্স বাঁশিতে সুর তুললেন, সেই সুরে সমগ্র চরাচর স্তব্ধ হয়ে গেল। তিন মাথাআলা প্রহরী কুকুর পথ ছেড়ে দিল পাতালের, ইক্সিয়নের নিরন্তর ঘূর্নায়মান চাকা থেমে গেল, সিসিফাস তার পাথর ঠেলার কর্ম ভুলে বসে পড়ল পাথরের উপর, ট্যান্‌টালাস ভুলে গেল তার অনিবারণযোগ্য তৃষ্ণার কথাও। গান শুনে এই প্রথম পাতালের ভয়ংকর পিচাশদের ও চোখে জল এল। হেডিসের রাজা প্লুটো আর তার পত্নী প্রসার্পিনা মুগ্ধ হয়ে শুনলেন আফিয়ার্সের গান-

হে দেবতারা যারা অন্ধকার ও নীরব পাতালের অধীশ্বর

তোমাদের কাছে আসতেই হয় সবার, যারা নারীর সন্তান,

সকল সুন্দর বস্তুর অবশেষ লুপ্ত হয় তোমাদের মধ্যেই।

তোমরা সেই উত্তমর্ণ শুধতেই হয় যাদের ঋণ

পৃথিবীতে আমরা বাঁচি মোটে কয়েকদিন

তারপর আমরা তোমাদের, চিরকাল, চিরদিন

কিন্তু আমি এসেছি তার জন্য যে এসেছে অসময়ে,

ফুল ফোটার আগেই ছিড়ে নেয়া হয়েছে সে মুকুল।

আমি চেয়েছিলাম সে ক্ষতি সইতে পারিনি।

প্রেম তো শক্তিমান দেবতা , হে রাজা আপনি জানেন

মানুষের গল্পকথা সত্যি যদিও কিভাবে একদিন

পুষ্পগণ দেখেছিল প্রসার্পিনার অপহরণ।

তাহলে ইউরিডিসের জন্যে পুনরায় বয়ন করুন

জীবনের জটিল বুনট, তাতে থেকে যা খুলে নেয়া হয়েছে

খুব তাড়াতাড়ি। দেখুন, আমার সামান্য প্রার্থনা-

আপনি শুধু ধার দিন তাকে।

আয়ু নিঃশেষিত হলে আবার সে হবে আপনারই।

আফিয়ার্সের কণ্ঠ শুনলে তার আবেদন কেউ গ্রাহ্য করতে পারতেনা । প্লুটো ডেকে পাঠালেন ইউরিডিসিকে, প্রত্যার্পণ করলেন আফিয়ার্সের হাতে। কিন্তু একটি শর্ত দিলেন; ইউরিডিসি তার পেছন পেছন আসবে, কিন্তু উপর-পৃথিবীতে না পৌছা পর্যন্ত এক বারও পিছন ফিরে তাকাতে পারবে না।

দু জনে যাত্রা করল পৃথিবীর দিকে। হেডিসের বিশাল তোরণ পেরিয়ে চাড়াই পথ ডিঙিয়ে চলল তারা। আফিয়ার্স জানত তার স্ত্রী আসছে পেছনে কিন্তু তবু একবার পেছন ফিরে দেখে নিশ্চিত হওয়ার অদম্য ইচ্ছা হল তার। ইতোমধ্যে অন্ধকার ফিকে হয়ে এসেছে, অনন্দিত মনে দিনের আলোর চত্বরে পা রাখল আফিয়ার্স এবং ফিরে তাকাল পেছনে। ইউরিডিসি তখনো অন্ধকার গুহা পার হয় নি। আধা আলোতে অন্তর্হিত হল ইউরিডিসি-অন্ধকারে তলিয়ে গেল সে। আফিয়ার্স শুধু শুনতে পেল প্রিয়তম পত্নীর ক্ষীণ কণ্ঠে বলা- বিদায়।

আফিয়ার্স প্রাণপণে চেষ্টা করল ইউরিডিসিকে অনুসরণ করতে কিন্তু পারলনা । জীবিত মানুষকে দ্বিতীয়বার হেডিসে ঢুকতে দিলনা দেবতারা।

আফিয়ার্স মানুষের সঙ্গ ত্যাগ করল। থ্রেসের গহীন জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে লাগল, এই সময় তার একমাত্র সঙ্গী হলো তার বাঁশি। অবশেষের একদিন ঘটল দূর্ঘটনা- আফিয়ার্স পড়ল একদল উন্মত্ত মীনড্‌ এর হাতে। এরা রক্তপিপাসী, মত্ত ডিওনিসুস-ভক্তের দল। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গ্রীতিকার আফিয়ার্সকে তারা হত্যা করল। তার শরীর টুকরো টুকরো ফেলা হলো খরস্রোতা নদী হেব্রাসে। মিউরা সেটিকে পেয়ে দ্বীপের অভয়ারণ্যে সমাহিত করল ।আফিয়ার্সের হাড়গোর পেয়ে তার কবর দিল অলিম্পসের পদদেশে। আজকের দিনেও এই অরণ্যের নাইটিঙ্গেলরা পৃথিবীর অন্য যেকোন স্থানের নাইটিঙ্গেলদের চাইতে মধুর স্বরে গান গায়।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:৩৮
১১টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×