১। গিঁট
গ্রামে যেদিন আগুন দিলো সেদিনই তালেব উধাও হয়ে গেলো। গ্রামের আর-দশজন যুবকের সাথে সেও গেল। তালেব তখন হাওরে ক্ষেতমজুরির কাজ করছিল। ওখান থেকেই সোজা চলে যায়। গ্রামের লোকজন বলাবলি করে সে মুক্তিসেনাদের দলে যোগ দিয়েছে। গ্রামের মানুষ মুক্তিসেনাদের সংক্ষেপে মুক্তি বলে ডাকে।
ঐদিন থেকেই আমেনার দিন গুনা শুরু। রোজ ভোরে লেবুগাছের ডালে বাধা দড়িতে একটা করে গিঁট দেয়া তার কাজ। নাওয়া খাওয়া ভুল হয়, কিন্তু দড়িতে গিঁট দিতে ভুল হয় না।
তালেব সত্যি সত্যি মুক্তিতে গেছে, এ খবরটি আমেনা নিশ্চিত হয় আরো কয়েকদিন পরে। এ গ্রাম থেকে বেশ ক'মাইল দূরে একটি ছোট বাজার আছে। সেই বাজারে আস্তানা গেড়েছে রাজাকাররা। কয়েকজন পাকসেনাও আছে সেখানে। এক রাতে তালেবরা ঐ বাজারে এম্বুশ করে। তখন এই গ্রামেরই জইতিশ মোল্লার সাথে দেখা হয়ে যায় তালেবের। জইতিশ মোল্লা মে#লভীদের মত পোশাক পরে। তাই গ্রামের মানুষ তাকে মোল্লা ডাকে। জইতিশ মোল্লাই খবরটি এসে আমেনাকে দেয়। তালেব বলেছে - তার জন্য চিন্তা না করতে। বেশিদিন লাগবে না, দেশ স্বাধীন হবে। দেশ স্বাধীন করে তবে ঘরে ফিরবে। এ খবর দিয়ে জইতিশ মোল্লা দা^ড়িয়ে থাকে। দুই আঙুলে টেনে টেনে পান্জাবির খু^ট ঠিক করে। অকারণে ফোকলা দা^তগুলো বের করে হাসে। বাসি রসগোল্লার মত চোখ দু'টি এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখতে থাকে। খুক খুক করে গলা পরিস্কার করে। বলে দেশ কি সত্যিই স্বাধীন হবে। দেশতো স্বাধীনই আছে। আমেনার অস্বস্তি লাগে। শরীরের লোমগুলোতে কেমন জানি শির শির করে। আমেনা বলে কষ্ট করে খবরটা দেওনে খুব খুশি হইছি। আল্লাহ আপনার ভালো করুক। আর কথা না থাকলে আপনি এখন যান। আমেনার কথা শুনে জইতিশ মোল্লা ইতস্তত করে। কিন্তু কিছু বলতে পারে না। চলে যায়।
আমেনার গিঁট দেয়ার পালা চলতেই থাকে। রোজ ভোরে ঘুম থেকে উঠে দড়িতে একটা গিঁট। তারপর অন্যান্য কাজ। স্বামী নাই। আয় রোজগারও নাই। ঘরে যা ছিল তাও শেষ। আশেপাশের কচু ঘেচু লাউয়ের ডগা সব উজাড়। দু'বছরের মেয়েটাকে নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখে আমেনা। এদিকে হয়েছে আরেক জ্বালা। জইতিশ মোল্লা নানা অছিলায় রোজ আসে। দা^ড়িয়ে থাকে। ঠেলে বিদায় না করলে যেতে চায় না।
ইরফান মিয়ার বা^ধা মজুর ছিল তালেব। ইরফান মিয়া সাত গাওয়ের মোড়ল। ইদানীং ইরফান মিয়ার পাওয়ার আরো বেড়েছে। প্রায় রোজ দিন মিলিটারির জিপ আসে ইরফান মিয়ার বাড়িতে। আরো কত লোকজন আসে ইরফান মিয়ার বাড়িতে। খানাপিনা আমোদ স্ফূর্তি লেগেই থাকে দিন রাত।
আমেনা যায় ইরফান মিয়ার বাড়িতে। ইরফান মিয়া তাকে কাছে ডেকে নেন। চুপি চুপি বলেন - তালেব মুক্তি হইছে। এটা জানতে পারলে মিলিটারিরা আর আস্ত রাখবে না। তুইতো মরবি, তোর মেয়েটারও সর্বনাশ হইবো। খবরদার কাউকে বলবি না। তোদের প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে। ফেলে তো দিতে পারি না। তুই আমার এখানে থেকে যা।
আমেনা এতোসব ঘুরপ্যাচ বোঝে না। সে খুশিই হয়। তার আর তার মেয়ের একটা ব্যবস্থা হয়েই গেল। তার উপর ঐ জইতিশ মোল্লার কু-নজর থেকেও বা^চার একটা উপায় হলো। আমেনা ঝু^কে ইরফান মিয়ার পা ছুয়েঁ সালাম করে। তারপর সোজা রান্নাঘরে যায়। ভোর থেকে রাত। শুধু কাজ আর কাজ। নিজের মেয়েটাকেও একটু আদর করার সময় নাই। মজুরি না থাক পেট ভরে খেতে তো পারছে। টাকার আর কি দরকার। ইরফান মিয়ার নাতি-পুতি আর বে#-ঝি’দের পুরান কাপড়ে মা-মেয়ের হয়ে যায়। তার আলতা স্নো’র দরকার নাই। স্বামী ফিরে এলে সাধ আহ্লাদ যা আছে হবে।
প্রতিদিনের মত সেদিনও ভোরে দড়িতে গিঁট দিচ্ছে আমেনা। অদূরে কয়েকজন লোক কথা বলতে বলতে যায়। কান পেতে শোনার চেষ্টা করে আমেনা। বুঝতে পারে না। দেখে আরো মানুষ। দলে দলে মানুষ। অবাক হয়ে যায় সে। মানুষগুলো কথা বলছে, চিuকার করছে। কেমন জানি এক খুশির ঢেউয়ে দুলছে সবাই। আমেনা কান পাতে। এক ফালি বাতাস কানে এসে জানিয়ে যায় দেশ স্বাধীন হয়েছে। শত্রুরা পালিয়েছে।
একছুটে আমেনা ঘরে যায়। মেয়েকে কোলে নেয়। কি করবে ভেবে পায় না। পাখির কাকলি সে স্পষ্ট শুনতে পায়। ঝিরঝিরে বাতাস তার চুল নেড়ে যায়। বাতাসের সাথে হালকা মিহি একটা সুর ভেসে বেড়ায়। যে সুরের মূর্চ্ছনায় পুনরায় জেগে ওঠে এক মৃত জনপদ। ফিরে আসে হারিয়ে যাওয়া সে চঞ্চলতা। মেঘলা আকাশে চমকানো বিদ্যুতের ন্যায় ঝিলিক খেলে যায় আমেনার দেহ মনে।
সম্বিত ফিরে আসতে আমেনা ঘর দোর সাফ সুতরো করতে লেগে যায়। ঘর ভর্তি শুকনো পাতা লতা ধূলা তার চোখে পড়ে। বা^শের খুটে ঝুলে থাকা ধুলো আর মাকড়সার ঝুল জড়ানো তালেবের লুঙ্গি গামছায় হাত দিতেই সেগুলো জেগে ওঠে। লাউয়ের মাচায় লতাগুলো হঠাu যেন সজীব লকলকে হয়ে যায়। লাউয়ের মাচায় একটি কচি লাউ দোল খায় যার বোঁটায় হলুদ ফুলটি এখনও লেগে আছে। এতদিন তার চোখে পড়েনি। একঝাঁক বাচ্চা নিয়ে কালো মুরগিটি পায়ের কাছে খুট খুট করে। মনে পড়লো তার একটি কালো মুরগি ছিল। আমেনা অবাক চোখে দেখে চারদিকে কেমন জানি সবকিছু জেগে জেগে উঠছে। আমেনা ভাবে ইরফান মিয়া কি খবরটা জানেন? হয়তো শুনেছেন।
আমেনা ছুটে যায় ইরফান মিয়ার বাড়িতে। খবরটা দিতে হবে তাকে। কিন্তু সেখানে গিয়ে হতাশ হয় আমেনা। বাড়িতে কেউ নেই। শুধু কাজের অন্য লোকেরা আছে। এখন আমেনাও আছে তাদের সাথে। ইরফান মিয়া পরিবারের সবাইকে নিয়ে চলে গেছেন শহরে। খুব ভোরে দুইটা গাড়ি ভরে তারা চলে গেছেন। কবে আসবেন, কেন গেছেন এসব কিছুই কারো জানা নেই। একজন বললো দেশ শান্তি হলে তারা ফিরে আসবেন। এ কথার কোন মানে খু^জে পায় না আমেনা।
যাওয়ার সময় ইরফান মিয়া নাকি বলে গেছেন আমেনা যেন কাজে থাকে। বয়স্ক কাজের লোকের মুখে একথা শুনে আমেনার মন কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে। সে কাজে লেগে যায়। এখন রান্নাঘরের কাজ কম। বাড়ি ঘর সাফ ছুতরো রাখা। ধান ঝাড়াই, শুকানো, গরু ছাগলের যত্ন, হা^স মুরগি খোয়াড়ে উঠানো এসবই এখন প্রধান কাজ। এভাবে চলতে থাকে।
সময় গড়ায়। চারপাশের সবকিছু বদলে যায়। গ্রামের যে সকল যুবকেরা মুক্তি হয়েছিল তারা ফিরে আসে। কিন্তু কেউ কেউ ফেরে না। তালেবও ফেরে না। কিছুদিন বাদে ইরফান মিয়াও ফিরে আসেন। প্রথমে ইরফান মিয়া একা পরে বাড়ির সবাই ফিরে আসেন। অমেনা খুশি হয়। বাড়িটি আবার জম-জমাট হয়ে ওঠে। আগের মতো রান্না ঘরের চুলার আগুন আর নেভে না। অনির্বান শিখার মতো জ্বলছে তো জ্বলছেই। আগে যারা আসা যাওয়া করতেন তারা আসছেন। বাদ যায় শুধু মিলিটারি জিপটি। তবে নতুন নতুন বড় কর্তা বড় নেতাদের গাড়ির আনাগোনা বাড়ে।
আমেনা বিকেলের আকাশের দিকে তাকায়। শীতের পাখিরা ঝা^ক বে^ধে উড়ে যায়। আমেনা ভাবে পাখিরা নিশ্চয় নীড়ে ফিরছে। যত পাখি আকাশে উড়েছিল তত পাখি ফিরছে কি না আমেনা মনে মনে ভাবে। যারা মুক্তিতে গিয়েছিল তারা সবাই একসাথে ফেরেনি। কেউ কেউ পরেও ফিরেছে। আমেনা আশায় বুক বা^ধে একদিন তালেবও ফিরবে। লেবুগাছে দড়িটি ঝুলানো থেকে যায়। আমেনা প্রতিদিন ভোরে একটি করে গিঁট দেয় ঐ দড়িতে।
২। গিঁট পাগলি
এক সময় প্রতি বুধবারে এখানে হাট বসতো। এই ক'বছরে সেটি এখন বাজারে রূপান্তরিত হয়েছে। সম্ভবত একারণে বাজারটির নাম বুধবারি বাজার। এখন বেশ কয়েকটি স্থায়ী দোকানও হয়েছে। সবসময় চলে। মাছ তরকারির বাজারও প্রতিদিন বসে। তবে বুধবারে জমে বেশি।
বাজারের এক প্রান্তে একটি প্রাচীন বটবৃক্ষ। একসময় এটি বাজারের মধ্যখানে ছিল। অর্থাu এটিকে কেন্দ্র করেই হাট বসতো। হাট থেকে বাজারে রূপান্তরিত হওয়ার ফলে এটি এখন বটের ছায়া ডিঙ্গিয়ে আরো বড় হয়েছে। ক্রমে উত্তরে বেড়ে এসেছে বড় রাস্তার দিকে। বটবৃক্ষটি দা^ড়িয়ে আছে কালের স্বাক্ষীর মশাল জ্বালিয়ে। মাছ, সবজি, পান, সুপারি এসব নিয়ে বিক্রেতারা বসে ঐ বটের তলায়। বেশ ক’টি পশারি দোকানও হয়েছে। কে কার চেয়ে কত সুন্দর করে দোকানের তাকে জিনিশ সাজিয়ে রাখতে পারে, এনিয়ে দোকানিদের মধ্যে এক নীরব প্রতিযোগিতা চলে। ছোট একটি ওষুধের দোকানও আছে। প্রতি বুধবারে একজন ডাক্তার এসে বসেন ওষুধের দোকানে। তাও অনিয়মিত। চায়ের দোকান, পশারি দোকানের ঝলকানি, তরুণ যুবকদের আড্ডা। সব মিলে একটা শহর শহর ভাব। এছাড়াও আছে একজন নরসুন্দরের অস্থায়ী দোকান আর হোমিও ডাক্তারের একটি চেম্বার। হোমিও ডাক্তার প্রতিদিনই বসেন তার চেম্বারে। ইনি এখনও এলাকাবাসীর ভরসা। ঘটনাটি ঘটলো এই হোমিও ডাক্তারের চেম্বারে, যার চাক্ষুষ স্বাক্ষী নরসুন্দর। এখন আর স্বাক্ষী প্রমাণের দরকার নেই। কারণ এলাকার মানুষের বিশ্বাসের কে#টায় তা স্থান করে নিয়েছে।
বটের ছায়ায় নরসুন্দরের দোকান। দোকান বলতে বটের ঝুরিতে ঝুলানো একটি বড় আয়না । একটি টুল। অতি পুরনো এক টুকরো সাদা কাপড়। আর চুল কাটার যন্ত্রপাতি রাখা একটি কাঠের বাক্স। নরসুন্দরের হাত-দু’এক দুরে যেখানে বটের ঝুরি ঘন হয়ে নেমেছে সেখানে এক পাগলি। তার মাথার চুলগুলো দেখতে বটের ঝুরির ক্ষুদ্র সংস্করণের মতো। দিন শেষে সবকিছু গুটিয়ে নিয়ে নরসুন্দর বাড়িতে চলে যায়। কিন্তু পাগলির ঘরবাড়ি এই বটের তলায়। কি এক অদৃশ্য টানে নরসুন্দর পাগলির প্রতি বেশ সহানুভূতিশীল। নরসুন্দর তার খাবার থেকে পাগলিকে কিছু দেয়। এই ই যথেষ্ট। পাগলির আর কোন চাহিদা নেই। কোন উuপাu নেই। কারো প্রতি কোন বিদ্বেষ নাই। দিন রাত একই কাজ। হাতের কাছে যা পায় তাতে গিঁট দেয়। আশেপাশে অসংখ্য দড়ি দাড়া লতা কাপড়ের টুকরো ইত্যাদি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। সবগুলোতে অসংখ্য গিঁট দেয়া। রোজ সকালে এই বাজারের মাঝ দিয়ে অনেক শিশু স্কুলে যায়। তারা অতি উuসাহে দড়ি লতা নিয়ে আসে এবং গিঁট পাগলিকে দিয়ে যায়। পাগলি খুশি হয়।
এক দুপুরে নরসুন্দর একজন বৃদ্ধ লোকের চুল কাটছিলো। পাগলি বসে এক টুকরো দড়িতে গিঁট দিচ্ছিল। ঠিক সামনে হোমিও ডাক্তারের চেম্বার। চেম্বারে রাখা রোগি বসার জন্য একটি ছোট বেঞ্চ। বেঞ্চের উপর বসে আছেন একজন মহিলা। সাথে সাত আট বছরের মেয়ে। মেয়েটির খুব শ্বাসকষ্ট। ডাক্তার সাহেব চেম্বারে নেই। রোগি দেখতে বাইরে গেছেন। কখন ফিরবেন কেউ ঠিক করে বলতে পারে না। মেয়ের অবস্থা দেখে মহিলার উদ্বেগ বেড়ে যায়। পাশের দোকানি য়খন আন্দাজ করে বললো বিকালের আগে ডাক্তার সাহেবের ফেরার কোন সম্ভাবনা নাই, তখন মহিলাটি হাউমাউ করে কে^দে উঠলেন।
মহিলার কান্না শুনে পাগলি সেখানে ছুটে যায়। মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে। মহিলাটি দারুণ ভয় পান। কি করবেন ভেবে পান না। পাগলির হাতে এক টুকরো চিকন দড়ি। তাতে কয়েকটি গিঁট দেয়া হয়েছে। পাগলির হাতে আরো গিঁট পাওয়ার অপেক্ষায় আছে। সেই দড়ির টুকরোটি ঐ মেয়ের হাতে বে^ধে দেয় পাগলি। ইতোমধ্যে ঘটনার চারপাশ জুড়ে একটি ছোটখাটো জটলা জমে যায়। অবাক চোখে সবাই দেখে মেয়েটির শ্বাসকষ্ট কমে গেল। মেয়েটির মা আনন্দে পাগলিকে জড়িয়ে ধরতে চান। কিন্তু পাগলি ছুটে যায় বটের ঝুরির ছায়ায়।
এই ঘটনার কথা পাগলা হাওয়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। সাথে যোগ হয় আরো অনেক নতুন কথা এবং প্রতিদিন আরো আরো নতুন কথা। সবই রহস্যময় আর অলে#কিক। দূর-দুরান থেকে মানুষ আসে পাগলিকে একনজর দেখতে। পাগলিকে উপহার দেয়ার জন্য দড়ি সুতলি ইত্যাদি এবং নানা ধরনের ফল ও খাবার নিয়ে আসে সবাই। নগদ টাকা পয়সাও উঠে অনেক। পাগলি এসব ছু^য়েও দেখে না। ভাগ্য খুলে যায় নরসুন্দরের। নগদ টাকা পয়সার সাথে খাবার দাবার। আর কি চাই। সারা জীবনের চেষ্টায়ও এতো কিছু পাওয়া সম্ভব হতো না। বাজারের অন্য কেউ এতে ভাগ বসাতে চাইলে পাগলি ক্ষেপে যায়।
নরসুন্দর এখন আর বটের ঝুরিতে আয়না ঝুলিয়ে বসে না। সেখানে ঝুলানো থাকে অসংখ্য রং বেরং এর সুতলি। বাজারের অন্যান্য দোকানেও এসব সুতলি বিক্রি হয়। চা-বিস্কুট সুতলির ব্যাপক চাহিদা মেটাতে আরো কিছু অস্থায়ী দোকান বসে। দোকানগুলোতে বিস্কুট তিলু বাতাসা নকুলদানা এবং ফলও পাওয়া যায়। এসকল দোকান থেকে সুতলি ও অন্যান্য খাবার কিনে মানুষ পাগলিকে দেয়। সুতলিতে গিঁট দেয়া হলে পরে বাড়িতে নিয়ে যায়। কেউ পানিতে ভিজিয়ে রোগিকে খাওয়ায়। কেউ শিশুদের হাতে বা^ধে। এতে শিশুদের মঙ্গল হয়। কেউ বা ঘরে ঝুলিয়ে রাখে। তবে নরসুন্দরের কাছে উদ্দেশ্য জানালে সে ব্যবহারবিধি বাuলে দেয়।
৩। ফেরা
বুধবারি বাজারের বটতলায় যে মাজারটি, তার খাদেম নিয়ে মামলা চলছে বেশ কদিন ধরে। বাজার কমিটির সভাপতি কাশেম মিয়া মামলাটি করেছেন। বিবাদি করা হয়েছে মাজারের কথিত খাদেম নরসুন্দরকে। নরসুন্দরের এখন অনেক বয়স হয়েছে। সবসময় মাজারে আসতে পারেন না। তার ছেলে সব দেখাশুনা করে। বাদি তার আরজিতে বলেছেন নরসুন্দর ধর্মগতভাবে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী। সে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হয়ে কিভাবে একটি মাজারের খাদেম হতে পারে। উপরন্ত মাজারটি বাজারের মধ্যে অবস্থিত। অতএব মাজারের খাদেমগিরীর দায়িত্ব বাজার কমিটির প্রাপ্য। নিম্ন আদালতে একবার রায় হয়েছে এবং তা বাজার কমিটির পক্ষে গিয়েছে। বাজার কমিটি একবার মাজারের দখল নিতে চেয়েছিল। এ নিয়ে বেশ লাঠালাঠিও হয়েছে। তবে বর্তমানে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ আছে।
এলাকার অর্থনীতিতে মাজারের গুরুত্ব এখন পাকাপোক্ত। সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এর প্রভাব সুস্পষ্ট। মাজারকে উপলক্ষ্য করে প্রতিদিন বাইরে থেকে অনেক লোকের আগমন ঘটে। ফলে বাজারে ব্যবসাপাতির প্রসার ঘটেছে। এমনকি দু’টি আবাসিক হোটেলও গড়ে উঠেছে এখানে। পার্শ্ববর্তী গ্রামের লোকজন এসকল ব্যবসাপাতির সুযোগ গ্রহণ করছে বেশি। ফলে মাজারের প্রতি তাদের বিশেষ আকর্ষণ আছে। খাদেম নিয়ে যে কোন টানা পোড়েনে গ্রামবাসী আদি খাদেম নরসুন্দরের পক্ষাবলম্বন করে।
মিস রেহানা গবেষণাকর্ম উপলক্ষ্যে এর আগেও দু’বার ঘুরে গেছেন। সাবেক চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে তার নিয়মিত চিঠি যোগাযোগ আছে। এবার আসছেন এমন এক সময় যখন মাজারের খাদেমগিরী নিয়ে চলছে সঙ্কট। এলাকার জন্য একটি উন্নয়ন প্রকল্প Ðতরি করে নিয়ে অসছেন তিনি। মিস রেহানার কাছে সকল তথ্যই রয়েছে। তার বাবা কৃষিশ্রমিক তালেব আলী যেদিন মুক্তিযুদ্ধে গেলেন, সেদিন থেকে তার নিরক্ষর মা আমেনা একটি দড়িতে গিট দিতে শুরু করেন। উদ্দেশ্য দিনের হিসাব রাখা। তালেব যেদিন ফিরে আসবেন সেদিন গুনে দেখবেন মোট কত দিন হলো। যুদ্ধ শেষ হলো। সবাই ফিরে এলো। কিন্তু কেউ কেউ ফিরলো না। তালেবও না ফেরাদের দলে রয়ে গেল। অনেক দিন পার হলো। তালেবের আর কোন খবর নাই। আমেনা শেষ পর্যন্ত অপ্রকৃতস্থ হয়ে যান। যে প্রাচীন বট বৃক্ষের ছায়ায় হাট বসতো সেই বটবৃক্ষের নিচে আশ্রয় নেন। এক সময় তার অলে#কিক ক্ষমতা আছে বলে প্রচার পায়। তার মৃত্যুর পর সেখানে গড়ে ওঠে মাজার। গিঁট পাগলির মাজার নামে সর্বত্র পরিচিত। রেহানার ঠা^ই হয় অনাথ আশ্রমে। সেখান থেকে আমেরিকা।
আমেরিকায় বর্তমানে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ গবেষক হিসেবে কর্মরত আছেন রেহানা। পোষাকে-আশাকে চলনে-বলনে পুরোদস্তুর আমেরিকান। আমেরিকায় তাকে হরেক নামে ডাকা হয়। রিয়ানা রেহান রন রিহান নানা নামে। তার নামের বাংলা উচ্চারণ রেহানা। এটাও গবেষণা করেই তাকে বের করতে হয়েছে। কত বড় বড় বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে করতে একসময় আপন শেকড়ের সন্ধানে নামেন তিনি। অতি কঠিন আর দুরূহ পথ পাড়ি দিতে হয় তাকে। শেষ পর্যন্ত তিনি পে#^ছাতে সক্ষম হন আপন ঠিকানায়। অনাথ আশ্রমে ঠা^ই পাওয়ার সময় তuকালীন চেয়ারম্যান সাহেবের দেয়া সার্টিফিকেটই হয় রেহানার ঠিকানা খু^জে পাওয়ার প্রথম এবং সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্র। শিশুকালের আবছা কিছু স্মৃতি এখনও মনে আছে রেহানার।
জেলা শহরের ছোট্ট বিমান বন্দর। অপেক্ষাঘরে বসে আছেন দুই বয়োবৃদ্ধ। সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আর নরসুন্দর। সাবেক চেয়ারম্যানের নাতি আর নরসুন্দরের ছোট ছেলে ছাড়াও এলাকার আরো কয়েকজন আছেন। বিমান আসতে দেরি করছে। সঙ্গে নিয়ে আসা ফুলের তোড়া দুটো শুকিয়ে যাচ্ছে দেখে চেয়ারম্যান আর নরসুন্দর দু’জনেরই উদ্বেগের শেষ নেই। তারা বারবার ওগুলোতে পানি ছিটা দিতে তাগাদা দিচ্ছেন।
বিমান থেকে নেমে অন্য যাত্রীদের সাথে এগিয়ে আসছেন রেহানা। চেয়ারম্যান আর নরসুন্দর অস্থির হয়ে ওঠেন। চেয়ারম্যান সাহেবের নাতি আর নরসুন্দরের ছেলে দু’জনকেই তারা ফুলের তোড়া নিয়ে এগিয়ে যেতে তাগাদা দেন। মিস রেহানা কাছাকাছি আসতেই তারা দু’জনে দু’দিক থেকে দু’টি ফুলের তোড়া তুলে দেন তার হাতে। চেয়ারম্যান সাহেব আর নরসুন্দর দু’জনই লাঠি ভর দিয়ে একসাথে উঠে দা^ড়ান। পরমজনকে কাছে পাওয়ার আনন্দে সবার চেহারা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষে তারা মাজারে গেলেন। চেয়ারম্যান নরসুন্দর আর গ্রামের আরো অনেক মানুষ। বয়োবৃদ্ধ চেয়ারম্যান আর নরসুন্দর ধীর গতিতে চলেন। রেহানা বারবার তাদের পেছনে ফেলে সামনে চলে যান। রেহানা ভালো বাংলা শিখেছেন। বাউল ফকির মাজার ইত্যাদি সম্পর্কে রেহানা অনেক কথা বলেন। যার কিছু কিছু সঙ্গীরা বুঝেন, আবার অনেক কিছু বুঝেনও না। তবুও মাথা নাড়েন। হ্যা^ হু^ বলেন। বাউল ফকিরদের মধ্যে কোন জাত ভেদাভেদ নাই। তারা মনে করেন সকল মানুষের আদি পিতা মাতা এক। পৃথিবীর সকল মানুষ এক। নিজেকে জানো। নিজে করে সকল বিষয়ে জ্ঞান লাভ কর। কে হিন্দু কে মুসলমান উচ্চ নীচ ধনী গরিব বিবেচনার বিষয় নয়। প্রচলিত শ্রেণীভাগের মধ্যে তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। ত্যাগি কিংবা গৃহস্ত কোন ভাগেই তারা পড়েন না। তাদের নিজেদেরও কোন সমাজ নেই। হিন্দু কিংবা মুসলমান উভয় সমাজেই তাদের বসবাস।
মাজারের চার কোনায় মিনারের নমুনায় চারটি স্তম্ভ। মাঝখানে লাল সালু ঢাকা মাজার। মাজার ঘিরে দা^ড়িয়ে আছে ছোট একটি দল। রেহানা মাজারের খাদেম নরসুন্দর সাবেক চেয়ারম্যান এবং আরো কিছু মানুষ। টিএনও সাহেব কর্তৃক পাঠানো দু’জন পুলিশ সদস্যও আছেন। একজন দুজন করে ভক্তরা আসছেন। এখানে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের কোন একক পদ্ধতি নেই। আগর বাতি জ্বালিয়ে, গোলাপ জল ছিটিয়ে, কেউ একা দাঁড়িয়ে মনে মনে পাঠ করছেন। আবার কেউ লাল সালুতে চুমু খাচ্ছেন। নজর নেয়াজও দিচ্ছেন অনেকে। বটের ঝুরিতে হেলান দিয়ে একজন বাউল গান ধরেছেন যখন তুমি ভবে এলে / তখন তুমি কী জাত ছিলে / কী জাত হবে যাবার কালে ... গানের সাথে এক তারার টুং টাং।
পড়ন্ত বেলায় সূর্য হেলে পড়েছে একেবারে পশ্চিমে। আলো আঁধারির টানাপোড়েনে ধীরে নেমে আসে নীরবতা। এক কোনের একটি মিনার ধরে নীরবে দা^ড়িয়ে থাকেন মিস রেহানা। এক সময় আলতো করে কপাল ঠেকান মিনারের শরীরে। একটি কালো কাক অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে দক্ষিণের মিনার চূড়ায়। এবার বোধ হয় তার নীড়ে ফেরার সময় হলো। দিগন্তে রক্তিম আভা ছড়াতে থাকা সূর্যের দিকে ডানা মেলে উড়াল দেয়। উড়তে উড়তে বহু দূরে কালো বিন্দু হয়ে যায়। কারো মুখে কোন কথা নেই। মিস রেহানার চেহারা দেখা যায় না। মিনারে কপাল ঠেকিয়ে আড়াল করছেন তিনি। থেমে থেমে তার পিঠ কে^পে ওঠে। এখানে দা^ড়িয়ে থাকা কারো চোখ তা এড়ায় না।