somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এ যুগের পুকুর চুরি (ফিচার)

৩০ শে এপ্রিল, ২০১৮ ভোর ৪:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পুকুর চুরি নিয়ে বাঙালি সমাজে অনেক প্রবাদ-প্রবচন প্রচলিত আছে। প্রমাণ সাইজের বা বড় মাপের চুরি/দূর্ণীতি বোঝাতে এ বাগধারাটি বহুল প্রচলিত। বাস্তবে কি পুকুর চুরি করা সম্ভব? খোলা চোখে দেখলে ধারণাটিকে প্রায় অসম্ভব মনে হবে। কিন্তু বাস্তবে পুকুর চুরি করে এক্কেবারে গায়েব করে দেওয়া সম্ভব।

হ্যা, সব সম্ভবের এ দেশে খুবই সম্ভব!

পুকুর চুরি নিয়ে একটি গল্প আছে। গল্পটি এ রকম- এলাকায় একটি নতুন পুকুর কাটা হবে, এজন্য সরকার থেকে বরাদ্দ হলো কয়েক লাখ টাকা। টেন্ডার হল, টাকাটাও তুলে নেওয়া হল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। এক ফুঁটো মাটিও কোদালের আঘাতে রক্তাক্ত হয়নি! কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারকে জানালেন কাজটি কেমন হয়েছে দেখার জন্য কিছু দিনের মধ্যে ইন্সপেক্টর আসছেন।

তাই বিষয়টি ধামাচাপা দিতে স্থানীয় প্রশাসন ও ঠিকাদার এলাকাবাসীর পক্ষ (এলাকাবাসী পুকুর খননের বিষয়ে কিছুই জানে না) হয়ে আবেদন করলেন পুকুরটি তাদের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পঁচা পানিতে মশা উৎপন্ন হচ্ছে। মশার উপদ্রবে এলাকায় ডেঙ্গু মহামারি হিসাবে দেখা দিয়েছে। অতএব জনগনের স্বার্থে পুকুরটি অতি সত্বর ভরাট করা হোক!

কতৃপক্ষ আবেদনটি পেয়ে মহা বিপদে পড় গেল। কি করবে না করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। অনেক ভাবনার পর অবশেষে পুকুরটি ভরাট করতে আবারো কয়েক লাখ টাকা বরাদ্দ হলো। এক সময় ইন্সপেক্টর সাহেব পরিদর্শনে এলেন, দেখলেন কাজ এক্কেবারে পাকা হয়েছে। ফকফকা! পুকুরটা এমনভাবে ভরাট করা হয়েছে মনে হচ্ছে এখানে আদৌ কোন পুকুর ছিলই না। পরিদর্শক ঠিকাদার ও স্থানীয় প্রশাসনকে ধন্যবাদ দিলেন ভাল কাজের পুরষ্কার স্বরুপ!



গল্পটি অনেক বছর আগের। তথ্য প্রযুক্তিরর কল্যাণে আমরা টেকনিক্যালি এখন বেশ এগিয়ে গেছি। এ যুগের পুকুর চুরির গল্পটা হবে এমন-

এলাকায় একটি পুকুর কাটতে হবে। এজন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বড় নেতার স্বরণাপন্ন হলেন। নেতা রেগেমেগে বল্লেন,
-- কি প্রজেক্ট বানিয়ে এনেছ?
-- এক কোটি টাকায় পুকুর হয়?
ছয় কোটি টাকার প্রজেক্ট বানিয়ে নিয়ে আসেন।

প্রতিনিধি সাহেব নেতার কথামতো ছয় কোটি টাকার প্রজেক্ট বানিয়ে নিয়ে আসলেন। কাজের অনুমোদন হলো। পাঁচ কোটি টাকা নেতা মেরে দিলেন। এক কোটি গেল স্থানীয় জনপ্রতিনিধির পকেটে। পুকুর কাটা আর হলো না। পুকুর খননের জন্য টাকা বরাদ্দের খবরও এলাকার কেউ জানল না। সবার অগোচরে আস্ত একটা পুকুর হাওয়া হয়ে গেল, সহজ কথায় চুরি হয়ে গেল।

এবার নিশ্চয় পুকুর চুরি যে সত্যি সত্যি হতে পারে তা বুঝতে সমস্যা হয়নি!

আরেকটি গল্পের কথা মনে পড়ল। নরওয়ের এক ইঞ্জনিয়ার পেশাদারী কাজে একবার বাংলাদেশে আসলেন। কর্মসূত্রে বাংলাদেশের এক প্রকৌশলীর সাথে বেশ ঘনিষ্টতা হলো। একদিন বাংলাদেশী প্রকৌশলী বিদেশী বন্ধুকে বাসায় মধ্যাহ্ন ভোজের আমন্ত্রণ জানালেন। প্রসাদপম বাড়ি দেখে নরওয়েজিয়ান প্রকৌশলী প্রশ্ন করলেন,
-- তুমি কত বেতন পাও?
-- এতো দামী বাড়ি করলে কিভাবে?



জবাবে বাংলাদেশী প্রকৌশলী বাড়ির সামনের নদীটির দিকে ইঙ্গিত করে বল্লেন,
-- নদীর উপরের ব্রীজটি দেখতে পাচ্ছ?
জবাবে তিনি বল্লেন,
-- কই না তো! এখানে তো কোন ব্রীজ নেই।
দেখবে কি করে, এই ব্রীজের শতভাগ টাকা দিয়েই এ প্রসাদটি করেছি।

আমার পরিচিত একজন ঠিকাদার এ প্রসঙ্গে মজার একটি তথ্য দিলেন। তিনি জানান, কিছুদিন আগে গ্রামের একটি স্কুলের আসবাবপত্র মেরামতের জন্য টেন্ডার আসলে প্রকল্প পরিচালক তাকে জানালেন আপনাকে কিছুই করতে হবে না। যা করার আমি করবো। কোন কাজের প্রয়োজন নেই। টেন্ডারের দশ পার্সেন্ট আপনাকে দিয়ে দেব। শুধু বিলটা তুলে আমাকে দেবেন! আপনাকে এই পর্যন্ত করলেই চলবে। যান, এখন বাসায় গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমান!

এ তো গেল পুকুর চুরির গল্প। তেল চুরি, বিল চুরি, নদী চুরি, খাল চুরি ইত্যাদি হাজারো চুরি অহরহ ঘটছে আমাদের সমাজে। কোনটি বড় চুরি বলা মুশকিল।

সবচেয়ে সুবিধা হয় ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় নদীতে বালুর বস্তা, ইটের সুরকী, ব্লক ও পাথর ফেলার সময়। নদীর গহীনে কতটুকু কাজ হলো কেউ দেখবে না। প্রমাণ করার তেমন সুযোগও থাকে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নীরব এ বিপ্লব অনেটা আমাদের অগোচরে ঘটে। নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে যারা বাড়ি-ঘর, সহায়-সম্পত্তি হারিয়ে পথে বসেন তাদের কোন লাভ হয় না।

অনেক আন্দোলন ও সংগ্রামের ফলে আসা প্রকল্প সর্বনাশী নদীর মতো মানুষরূপী আরেক নদীর পেটে যায়। তারা প্রসাদপম বাড়ি বানায়। বিদেশে এই টাকা পাচার করে। ছেলেমেয়েকে বিদেশে পাঠিয়ে উচ্চশিক্ষিত করে। কিন্তু নদীতে বিলীন হওয়া পরিবারটির জন্য কুঁড়ে ঘরও জোটে না। একই চিত্র পাওয়া যায় নদীর ড্রেজিং ও খাল খননের বেলায়।

কিছুদিন আগে সুনামগঞ্জে হাওর উন্নয়নের নামে লুটপাটের অনেক সংবাদ দেশবাসী জানতে পারে। কোটি কোটি টাকার অনেক প্রকল্পের কাজ ঠিকাদাররা না করেই বিল তুলে নিয়ে গেছে। ফলস্বরুপ হাজার হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হল। ফসল হারিয়ে পথে বসল। শাস্তিস্বরুপ পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রকৌশলীদের বদলী করা হলো। হ্যা, শুধুই বদলী! দোষী টিকাদারদের লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করা হলো।



তবে আসল নাটের গুরুরা ধরা ছোয়ার বাইরে রয়ে গেল।

আচ্ছা প্রকল্পের এসব লুটপাটের হাজার হাজার কোটি টাকা কোথায় যায়? এত্তো টাকা বাড়ি গাড়ি ও ভোগ বিলাসে খরছ হওয়ার তো কথা নয়। ধারণা করা হয় এর একটি বড় অংশ ব্যাংকে নামে-বেনামে গচ্ছিত থাকে। দুদক মামার নজরে পড়লে এই টাকার একটি অংশ দিয়েই ম্যানেজ করা হয়। আর নগদ টাকা দেশের ব্যাংক উপচে পড়লে আছে বিদেশী ব্যাংক ও বিনিয়োগ কোম্পানী।

কেউ কোনদিন এসব টাকার কোন হাদিস পায় না। পাবে না।

বিদেশে টাকা পাচার বিষয়ে একটি ঘটনার কথা মনে পড়লো। আমি লন্ডনে যে বাসায় থাকতাম সে বাসায় বাংলাদেশের নামকরা একটি ব্যাংকের এমডি এক মাসের ব্যবধানে দুইবার গেলেন। প্রতিবার সপ্তাহেরও কম সময় ছিলেন। কৌতুহল বশত ফ্লাটের এক দাদাকে উনার আসার হেতু জিজ্ঞেস করলে শুধু মুচকি হাসলেন কোন উত্তর দিলেন না। তার হাসিটা আমার মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিল।

আরেকদিন খুব করে দাদাকে চেপে ধরলাম এবং নিশ্চয়তা দিলাম কাউকে এ বিষয়ে কিছু বলব না। তিনি যে তথ্য দিলন তা শুনে আমার আক্ষেল গুড়ুম হওয়ার যোগাড়। তার কথায় গত তিন বছরে এ ব্যাংকারের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে বারশে কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে নির্বাসিত এক বড় রাজনীতিবিদের কাছে বিভিন্ন চ্যানেলে এসেছে। শুনে থো মেরে দাদার মুখের দিকে ফেল ফেল করে চেয়ে রইলাম।

আঙ্গুলে গোনতে লাগলাম। ধ্যাত পারছি না, এত্তো টাকার হিসাব আমার ছোট ঘিলুতে ঢোকে না!!

এখন বুঝি কেন অর্থমন্ত্রী সোনালী ব্যাংকের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার দূর্ণীতিকে মামুলি বলেছিলেন। যেখানে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা দুদক ও সরকারের হাত ফসকে বিদেশে পাচার হচ্ছে, সেখানে পাঁচ-দশ কোটি টাকার নয় ছয় হিসাবের মধ্যেই আসে না। মিডিয়ার কল্যাণে এসবের সিকিভাগ মাঝে মাঝে প্রচার হয় বটে। তবে কিছুদিন যেতে না যেতেই অন্য বড় পুকুর চুরির সংবাদ আগেরটিকে মাটি চাপা দেয়।

টেক্কা দেয়। ল্যাং মেরে বঙ্গপোসাগরে ফেলে দেয়।।



বিদেশে পাচার করা টাকায় বঙ্গ সন্তানরা এভাবে লাক্সারি জীবন-যাপন করেন, বউ/গার্লফ্রেন্ড নিয়ে। আহা! মজাই মজা।

ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ৯:০৭
৩৫টি মন্তব্য ৩৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×