পৃথিবীর অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মত হাজার হাজার বছর ধরে নানা নৃতাত্ত্বিক এবং ধর্মীয় গোষ্ঠী ও শাখা-গোষ্ঠী, নানা শ্রেণির মিলন, পারস্পরিক প্রভাব এবং সমন্বয়ের ফলে গড়ে উঠেছে বঙ্গীয় সংস্কৃতি। সুলতানি আমলের 'বাঙলা' রাজ্য অথবা বাংলা ভাষা গড়ে ওঠার মুহূর্ত থেকে বাঙালি সংস্কৃতির জন্ম হয়নি। বঙ্গীয় সংস্কৃতির ভিত্তি গড়ে উঠেছিলো আরো অনেক আগে থেকে। ধারণা করা হয় বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস প্রায় চার হাজার বছর পুরনো। এক সময় ভারত উপমহাদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালিরা নেতৃত্ব দিয়েছে। বাঙলা ছিল উপমহাদেশীয় সংস্কৃতির রাজধানী। এজন্য ভারত উপমহাদেশে বাঙালি সংস্কৃতির অনেক প্রভাব ছিল; যা এখনো আছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসাম এলাকা নিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির বিস্তৃতি ছিল। এছাড়া ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, মনিপুর, মেঘালয়, বিহার, ঝাড়খন্ড ও ঊড়িষ্যা রাজ্যের কিছু অংশে বাঙালি সংস্কৃতির প্রভাব আছে।
সংস্কৃতি বা কালচার হলো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষের মধ্যে দীর্ঘ দিন থেকে গড়ে উঠা এক প্রকার অভ্যাস; যা মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক বিচরণের ক্ষেত্রে বেশ প্রভাব বিস্তার করে। বিশদ অর্থে সংস্কৃতি হলো মানুষের আচার-আচরণ, রীতিনীতি, বিশ্বাস, নীতিবোধ, চিরায়ত প্রথা, সমষ্টিগত প্রভাব ও সামাজিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি। মানুষের ব্যক্তি জীবনে সংস্কৃতির প্রভাব অপরিসীম। অন্যভাবে বলতে গেলে মানুষ তার অভ্যাস বা কালচার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত হয় প্রতিনিয়ত। এককথায়, মানুষের আত্মপরিচয় বা মর্যাদার বাহ্যিক রূপই হচ্ছে সংস্কৃতি।
মোতাহার হোসেন চৌধুরী সংস্কৃতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, "সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে বাঁচা, প্রকৃতি-সংসার ও মানব সংসারের মধ্যে অসংখ্য অনুভূতির শিকড় চালিয়ে দিয়ে বিচিত্র রস টেনে নিয়ে বাঁচা, নর-নারীর বিচিত্র সুখ-দুঃখে বাঁচা, বিচিত্র দেশ ও বিচিত্র জাতির অন্তরঙ্গ সঙ্গী হয়ে বাঁচা, প্রচুরভাবে, গভীরভাবে বাঁচা, বিশ্বের বুকে বুক মিলিয়ে বাঁচা।"
একটা সময় ছিল যখন যোগাযোগ ব্যবস্থা আজকের মতো এত সহজ ছিল না, ইন্টারনেট ছিল না। তখন দূরের সংস্কৃতি বা বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাব আমাদের সমাজে কম ছিল। এই ভারত উপমহাদেশেও দূরত্বের কারণে দক্ষিণ ভারতের চেন্নাই, ব্যাঙ্গেলোর, কেরালা ও হায়দ্রাবাদের সাথে বাঙালি সংস্কৃতির অনেক অমিল ছিল। এছাড়া পশ্চিম ভারতের মুম্বাই ও গুজরাট; উত্তর ভারতের দিল্লি, হারিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, উত্তর খন্ড, রাজস্থান এবং পাঞ্জাবের সাথেও বাঙালি সংস্কৃতির অনেক পার্থক্য ছিল। ভারতের ঊড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড, ছত্রিশগড়, বিহার, মেঘালয়, মিজোরাম ও মনিপুর আমাদের প্রতিবেশী হওয়ায় এসব এলাকায় বাঙালি সংস্কৃতির প্রভাব আজও স্পষ্ট। গৌড়, রাঢ়, সমতট, বরেন্দ্রী, হরিকেল, বঙ্গ ইত্যাদি রাজ্য নিয়ে বাঙলা গঠিত হয়েছিল।
আর্যরা বঙ্গে আগমনের পর থেকে আমাদের সংস্কৃতির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্যে ছেদ পড়া শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে সেন বংশের রাজত্ব, তুর্কি, আফগান ও মুঘল আমলে বাঙালি সংস্কৃতির মাঝে বিজাতীয় (বিদেশি) সংস্কৃতির ব্যাপক মিশ্রণ ঘটে। ইংরেজরা ভারত উপমহাদেশ দখল করার পর অন্যান্য অঞ্চলের মত আমাদের বঙ্গেও বৃটিশ সংস্কৃতি ঢুকে পড়ে। তাদের দুইশত বছরের শাসনামলে বঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক অগ্রগতি হয়, ফলে আমাদের হাজার বছরের চিরচেনা সংস্কৃতিতে অনেক পরিবর্তন আসে। স্পেনিশ ও পর্তুগীজরা দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো দীর্ঘদিন শাসন করার ফলে সেসব দেশে আজ স্পনিশ ও পর্তুগীজ সংস্কৃতির প্রভাব ব্যাপক। ব্রিটিশ শাসিত অস্ট্রেলীয়া ও নিউজিল্যান্ডের অবস্থাও ঠিক তাই; তবে এ দু'টি দেশের স্থানীয় সংস্কৃতি খুব একটা সমৃদ্ধ ছিল না। তবে আমাদের উপমহাদেশের হাজার বছরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ফলে আজও সগৌরবে তা ঠিকে আছে।
খৃষ্টান (Christianity), মুসলিম (Islam) ও ইহুদি (Judaism) ধর্মের উৎপত্তি বঙ্গভূমি থেকে বহু দূরে হওয়ায় এসব ধর্ম আদি ও অকৃত্রিম রূপে আমাদের বঙ্গে আসেনি; এসব ধর্মে আরব সংস্কৃতির প্রভাব স্পষ্ট। অপরদিকে হিন্দু (Hindusim), বৌদ্ধ (Buddhism) ও শিখ (Sikhism) ধর্মের উৎপত্তি ভারত উপমহাদেশে হওয়ায় এসব ধর্মের রীতিনীতিতে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব স্পষ্ট। শিখ ধর্মে ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরখন্ড, রাজস্থান ও গুজরাটের সংস্কৃতির আধিপত্য রয়েছে। এছাড়া চায়নিজ 'টাও' (Taoism) ও 'ফালুন' (Falun Gong); জাপানের 'শিন্ত' (Shinto) ধর্মের বেলায়ও স্থানীয় সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে। এজন্য ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে স্থানীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটে মাত্র; ফলে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারিদের মধ্যে আজও ধর্মীয় আচার-অনুষ্টানে এলাকা ভিত্তিক বিভিন্ন প্রথা অনেকটা নীরবেই যুক্ত হয়ে যায়।
দশম শতাব্দীতে রচিত বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদে গ্রামের কোনো উল্লেখ নেই। নিরাপত্তা এবং উৎপাদনের জন্যে লোকেরা তখন ‘পুরী’ এবং ‘নগরে’ বাস করতেন। বসতির এই বৈশিষ্ট্য উপ-নাগরিক সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠার সম্ভবত প্রধান কারণ ছিল। আর নৃতাত্ত্বিক দিক দিয়ে বেশির ভাগ বাঙালিই অস্ট্রো-এশিয়াটিক। কিন্তু দ্রাবিড় গোষ্ঠীও এর মধ্যে মিশিছে। এই দুটি প্রধান নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী ছাড়া, বাঙালিদের মধ্যে তিব্বতী-চীনা এবং সেমেটিক রক্তেরও সংমিশ্রণ ঘটেছে।
বখতিয়ার খলজি ১২০৪ খৃষ্টাব্দে লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বঙ্গে মুসলিম শাসন প্রবর্তন করলে আমাদের সংস্কৃতিতেও তার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। এ সময় আরব ও পারস্য থেকে অনেক সুফি ইসলাম প্রচার করতে আসেন। তখন পীর দরবেশরা যে ভক্তিমূলক ধর্মের প্রচার করেছিলেন তা সমাজকে বেশ প্রভাবিত করেছিল। ইতিহাসবিদদের মতে এ সময় হাজার হাজার নিম্নবর্ণের হিন্দু ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। পাশাপাশি হিন্দু ধর্মেও কিছু পরিবর্তন আসা শুরু হয়ে। এ সময় প্রচুর আরবী ও ফার্সি শব্দ বাঙলা ভাষায় যুক্ত হয়ে আমাদের ভাষা সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে। ফলে মুসলমানদের মধ্যে আরব ও ফার্সি সংস্কৃতির প্রভাব বাড়তে থাকে। বাঙ্গালা নামে পরিচিত এই বিরাট এলাকায় ছিলো অনেকগুলি রাজ্য-গৌড়, রাঢ়, দক্ষিণ রাঢ়, সুহ্ম, বরেন্দ্রী, হরিকেল, সমতট এবং বঙ্গ। এছাড়া, বিভিন্ন সময়ে আরও ছোটোখাটো রাজ্য ছিল। ১৩৫০-এর দশকে গৌড়ের সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁ জয় করে ‘শাহ-ই বাঙালিয়ান’ অর্থাৎ বাঙালিদের শাহ উপাধি গ্রহণ করেন। বৃহত্তর ‘বাঙ্গালা’র জন্ম তার আগে হয়নি।
ঊনিশ শতকে বাঙালি কবি ও সাহিত্যিকদের মধ্যে ইংরেজি সাহিত্যের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। বাঙলা সাহিত্যের বিষয়বস্তু ও ভাবধারা এ সময় বদলে যায়। বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে এটা একটি যুগান্তর ছিল। প্রকৃতপক্ষে মানবতাবাদী এই সাহিত্য দিয়েই বঙ্গীয় রেনেসাঁর জন্ম হয়। এতে বিরাট অবদান রাখেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধূসুদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এ সময় ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাবে নতুন আঙ্গিক নিয়ে লেখা হয় মহাকাব্য, পত্রকাব্য, সনেট, খন্ড কবিতা, নাটক, উপন্যাস, ছোট গল্প ও প্রবন্ধ। রবীন্দ্রনাথের সময়ে বাঙলা সাহিত্য বিশ্ব সাহিত্যের আসন লাভ করে।
ঊনিশ শতকের মাঝামাঝিতে কলকাতায় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম মঞ্চ নাটকের যাত্রা শুরু হয়। তখন মূলত ব্যক্তিগত উৎসাহে নাটক নির্মাণ ও মঞ্চায়ন করা হতো। দিনদিন মঞ্চ নাটক বাঙালি সমাজে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠে। যা এখনও অব্যাহত আছে। তবে মঞ্চ নাটকের জনপ্রিয়তার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল ইংরেজি সাহিত্যের। টেলিভিশন আবিষ্কারের পর টিভি ও সিনেমার ব্যাপক প্রচার শুরু হয় এই বঙ্গে। যদিও আমাদের থিয়েটার কখনো বিশ্বমানের ছিল না। তারপরও স্থানীয় মানুষের আবেগ-অনুভূতি, সামাজিক ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব, জমিদারদের শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস এসব নাটকের উপজীব্য ছিল। ইংরেজদের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে নাটকের ভূমিক ছিল ব্যাপক।
ব্রিটিশদের আমলে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিকভাবে বঙ্গে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে অর্থনৈতিক অসমতা দেখা দেয়। এ সময় মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক ও পশ্চিমাদের দ্বারা পরিচালিত শিক্ষা অর্জনে আগ্রহ কম ছিল। ফলে হিন্দুরা শিক্ষা অর্জনে মুসলমানদের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে যায়। মুসলমানরা এ সময় ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি বেশি মনযোগী ছিলেন। ফলে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্কের ফাটল ধরে। একে অন্যের মধ্যে ভূল বোঝাবোঝি শুরু হয়। এর আগেও এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ তাকলেও এর ভয়াবহতা এত বেশি ছিল না। তবুও তারা শত শত বছর থেকে একে অন্যে সমাজে সব সময় মিলে মিশে ছিলেন।
সাতচল্লিশে দেশ ভাগের সময় বাঙলা স্থায়ীভাবে দুইভাগে বিভক্ত হলে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর এর একটা ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এ সময় পূর্ববঙ্গ থেকে অনেক উচ্চ বর্ণীয় হিন্দু এবং হিন্দু জমিদাররা ব্যাপক হারে পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। শিক্ষা ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমে যে মুসলমানরা হিন্দুদের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছিলেন তারা রাতারাতি সর্বত্রই বিনা প্রতিযোগীতায় উন্নতির পথে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পান। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ আমর্ত্য সেন বলেন, সাতচল্লিশে দেশভাগের ফলে পূর্ববঙ্গে একটি শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণী তৈরী হয়েছিল। যার ফলে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় পূর্ববঙ্গে অর্থনৈতিক ভারসাম্য আসে। তিনি আরো বলেন বাংলাদেশের মানুষ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের চেয়ে এগিয়ে যাওয়ার পেছনে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উল্লেখ্য, আমর্ত্য সেন বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জন্মগ্রহণ করেন।
মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস, শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ফলে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আসে। সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন আসে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে। ধর্মগুলো যে অঞ্চলে আবির্ভূত হয় সেসব অঞ্চলের কৃষ্টি-কালচার ধর্মটিকে বেশ প্রভাবিত করে। এজন্য হিন্দু ধর্মের মধ্যে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব স্পষ্ট। বৌদ্ধ ধর্ম দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে শুরু হওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষের কালচার বৌদ্ধ ধর্মে বেশ প্রচলিত। ইসলাম ধর্মেও ঠিক তেমনি আরব সংস্কৃতির প্রভাব স্পষ্ট। এজন্য আমাদের সংস্কৃতিতে ধর্ম বিশ্বাসের তফাতের কারণে সাংস্কৃতিক চর্চায়ও ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ধর্মগুলো কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় বহুল প্রচলিত অনেক সংস্কৃতি পালনে নিষধাজ্ঞা আরোপ করে, তবে যদি তা ধর্মগুলোর মূল নীতির সাথে সাংঘর্ষিক হয়। ফলে আমাদের সমাজে ধর্মভিত্তিক রীতিনীতি প্রত্যক্ষভাবে মানুষের সাংস্কৃতিক চর্চাকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে।
ইদানিং "বিজাতীয় সংস্কৃতি" এবং "অপসংস্কৃতি" নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। বিজাতীয় সংস্কৃতি হচ্ছে ভাড়া করা কালচার, যা আগে কোনদিন এ অঞ্চলে ছিল না। আর অপসংস্কৃতি হলো সমাজে দীর্ঘ দিন থেকে প্রচলিত কিছু ধ্যান ধারণা ও চর্চিত বিষয় যা সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিজাতীয় সংস্কৃতি এবং অপসংস্কৃতি ভিন্ন দু'টি ধারা হলেও অনেকে না বুঝে এগুলোকে একই ধারায় গুলিয়ে ফেলেন। ধর্মভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় স্থানীয় অনেক কালচারকে বিজাতীয় ও অপসংস্কৃতি হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়। তবে এগুলোর কোনোটি হয়তো অপসংস্কৃতি হতে পারে, তবে তা বিজাতীয় সংস্কৃতি নয়।
বিশ্বায়নের এ যুগে আইন করে বা বাধ্য করে কাউকে দমিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এজন্য ইদানিং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি আমাদের সমাজকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য কিছু ভাল কালচারের সাথে বেশ কিছু অপসংস্কৃতিও আমাদের সমাজটাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের সমাজে এমন কিছু কৃষ্টি-কালচার যুক্ত হয়েছে যা আমাদের সংস্কৃতির সাথে মানানসই নয়। বিশেষ করে তরুণ ও যুব সমাজ এর ক্ষতিকারক বিষক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। তবে বিজাতীয়/বিদেশি যে সংস্কৃতি আমাদের সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে তা অবশ্যই গ্রহণ করা যায়। আর যা আমাদের সমাজটাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে তা পরিত্যাগ করতে হবে। এগুলো অপসংস্কৃতি।
এজন্য ঢালাও ভাবে বিজাতীয়/বিদেশি সংস্কৃতি বর্জন করলে লাভের চেয়ে আমাদের ক্ষতিই বেশি হবে। বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ব আমরা। কারণ বর্তমান সময়ে মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক আদান প্রদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর অপসংস্কৃতি, তা দেশী হোক অথবা বিদেশী তা অবশ্যই বর্জনীয়। যেমন- মঞ্চ নাটক আমাদের বাঙালি সমাজে দীর্ঘ দিনের সংস্কৃতি চর্চার একটি অংশ, কিন্তু মঞ্চ নাটকের নামে নারীদের শরীর প্রদর্শন ও অশ্লীল নৃত্য পরিবেশন করলে তা হবে অপসংস্কৃতি। দুঃখজনক হলেও সত্য ভারতীয় টিভি চ্যানেলের কিছু সিরিয়াল, অনুষ্ঠান ও আইটেম সঙ আমাদের সমাজকে প্রতিনিয়ত ক্ষত-বিক্ষত করছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকারের পাশাপাশি আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। এ বিষয়ে আমাদের নিজেদের পরিবারকেও সচেতন করা প্রয়োজন।
আমাদের দেশের মতো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শত শত বছর থেকে বিভিন্ন উৎসব চলে আসছে। এগুলো তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ। এসব উৎসবে মানুষ স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ করে। কারো পছন্দ না হলে চুপচাপ থাকে। জোর করে অন্যদের আগ্রহকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে না। পৃথিবীর কোথাও কোন উৎসব শতভাগ মানুষের কাছে পছন্দনীয় হয় না। আর তা প্রত্যাশা করা অনুচিত।
পৃথিবীর কয়েকটি বিখ্যাত উৎসবের মধ্যে অন্যতম হল- হারবিন স্নো এন্ড আইস ফেস্টিভাল (চায়না); রিও কার্নিভাল (ব্রাজিল); লন্ডন নটিংহিল কার্নিভাল (ইংল্যান্ড); হোলি (ভারত); কাসকামোরাস (স্পেন); ভেনিস কার্নিভাল (ইতালি); অরুরো কার্নিভাল (বলিভিয়া); ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগো কার্নিভাল (ক্যারিবিয়ান); মার্ডি গ্রাস (যুক্তরাষ্ট্র); ভিঞ্চে কার্নিভাল (বেলজিয়াম); সঙ্করান ওয়াটার ফেস্টিভাল (থাইল্যান্ড) এবং বোরইয়েং মাড ফেস্টিভাল (দক্ষিণ কোরিয়া)।
সুস্থ ধারার যে কোন সাংস্কৃতিক চর্চাকে আমাদের উৎসাহিত করা প্রয়োজন। এটি বিদেশি বা স্বদেশী যাই হোক না কেন। আমরা যে নীতি ও আদর্শ বিশ্বাস করি তা আমাদের নিজস্ব ব্যাপার, এতে সমাজের কিছু যায় আসে না। সমস্যা দেখা দেয় তখনই যখন আমরা নিজের ইচ্ছাকে জোর করে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করি। এটা অন্যায়। এতে সমাজে বিভাজন দেখা দেয়। হিংসা-বিদ্বেষ বেড়ে যায় ফলে সমাজে শান্তি বিনষ্ট হয়। একুশ শতকের বিশ্বায়নের এ যুগে জোর করে নিজের পছন্দ-অপছন্দ অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। মানুষ তা শুনতে বাধ্য নয়।
কালচার/সাংস্কৃতিক চর্চাটা আসে মানুষের ভালবাসা ও দীর্ঘ দিন থেকে সমাজে প্রচলিত অভ্যাস থেকে। এজন্য জোর করে কোন কালচার/সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়া যায় না, আবার জোর করে মানুষের নিজস্ব কালচার/সংস্কৃতি থেকে বের করে আনা যায় না। সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা ও বিনোদন মানুষের বুদ্ধিভিক্তিক জ্ঞানকে বিকশিত করে, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক দৃঢ় করে। সমাজকে পরিশুদ্ধ করে। পৃথিবীর উন্নত ও সভ্য দেশগুলো এভাবেই আজ এগিয়ে যাচ্ছে আরো উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে। তারা নিজেদের মতামত কারো উপর চাপিয়ে দেয় না; বরং অন্যের পছন্দ অপছন্দকে সম্মান দেয়, সহযোগিতা করে। এতে সমাজে পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা অটুট থাকে।।
ধর্ম যার যার, ধর্মীয় উৎসবগুলোও যার যার। তবে ব্যক্তিগত ভাবে কেউ অন্য ধর্মের উৎসবগুলে পালন করলে এটা হবে তার ব্যক্তি ইচ্ছা। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় ধর্মীয় আচার-অনুষ্টান ও রীতিনীতি গুলো অন্য ধর্মের মূল নীতির সাথে যায় না, অনেকটা সাংঘর্ষিক। এজন্য যাদের ধর্মীয় বিশ্বাস পুরোপুরি আছে তারা এ থেকে বেরিয়ে এসে অন্য ধর্মের উৎসবে যোগ দেওয়া সম্ভব নয়। যেমন- মুসলিমদের কোরবানীর ঈদে যদি বলা হয় হিন্দুদেরও উৎসব করতে তা কী সম্ভব? কারণ গরু হচ্ছে হিন্দুদের দেবতা, পূজনীয়। ঠিক হিন্দুদের কালি পূজা ও স্বরস্বতিপূজাও মুসলিমদের পালন করা সম্ভব নয়। কারণ এগুলো ইসলামের মৌলিক নীতির সাথে সাংঘর্ষিক। তবে অন্য ধর্গুলো যাতে নিরাপদে ও সহজে তাদের ধর্মীয় উৎসবগুলো স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে পালন করতে পারে সেজন্য সবার সহযোগিতামূলক মানসিকতা থাকাটা আবশ্যিক।
এমন কিছু উৎসব আছে যেগুলো কোন নির্দিষ্ট ধর্মের নয়, এগুলো শত শত বছর থেকে চলে আসা সামাজিক প্রথা/উৎসব। এগুলোর সাথে ধর্মীয় রীতিনীতি সম্পৃক্ত নয়, সে সকল উৎসব সার্বজনীন। যেমন- পহেলা বৈশাখ, নিউ ইয়ার, বসন্ত উৎসব, পিঠা উৎসব ইত্যাদি। তবে এগুলো মানা না মানা ব্যক্তির ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। তবে যারা তা পালন করে তাদেরকে মুক্তমনে পালন করতে দেওয়া উচিৎ। এটা আমাদের সামাজিক দায়িত্ব। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভাল লাগা-মন্দ লাগার সাথে স্থানীয় সংস্কৃতি চর্চার কোন সম্পর্ক নেই।
তথ্যসূত্র -
বাঙ্গালীর ইতিহাস, নীহাররঞ্জন রায় (২০০১,কলকাতা)
হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, গোলাম মুরশি(২০০৬)
বাঙ্গালীর সংস্কৃতি, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৯৯৮)
প্রথম আলো (১৩ এপ্রিল, ২০১৭)
Ethnic Groups of South Asia and the Pacific
(James B. ২০১২)।
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
চাইলে পড়তে পারেন-
আমার সবচেয়ে পঠিত পোস্ট।
সবচেয়ে লাইকপ্রাপ্ত গল্প-ধূমকেতু
ধর্ষণ ও ধর্ষক (বাংলাদেশ/বহির্বিশ্ব)
অনুবাদ গল্প-(দি নেকলেস)
দি গিফট অফ দ্যা ম্যাজাই
গল্প লেখার সহজ পাঠ
সবচেয়ে পঠিত প্রবন্ধ।
আধুনিক কবিতার পাঠ (সমালোচনা)
আলোচিত ফিচার 'দি লাঞ্চিয়ন'।
ব্রিটেনের প্রবাস জীবন- স্মৃতিকথা।
সবচেয়ে পঠিত গল্প।
ছবি ব্লগ (লন্ডনের ডায়েরি-১)।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৫৩