রাত। খুব গভীর নয়, তবুও রাত। আধমরা ষ্ট্রীটল্যাম্পের প্রানপন চেষ্টায় অন্ধকার কিছুটা কমলেও রাতের রহস্যময় ভাবটা তাতে বেড়ে গেছে বহুগুন। আধো অন্ধকার ফুঁড়ে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হেটে আসছিল লুবনা। কালো ভ্যানিটিব্যাগটা শক্ত হাতে আকড়ে ধরা। হাটছে একটু দ্রুত পায়ে; কারন মেইন রোড যেখানে বাক খেয়ে ঢুকে গেছে গলিতে, মাসুদ সেখান থেকেই লুবনার পিছু নিয়েছে। প্রথমে বুঝতে পারে নি, খানিক আগে মোড় ঘোরার সময় টের পেল লুবনা। হাটার গতি তখন তার আপনা আপনি বেড়ে যায়। হেটে যেতে যেতে সে অবশ্য আড় চোখে একবার দেখে নেয় মাসুদকে। গায়ের রং ফরসা। দেখতে উঠতি প্রেমিকদের মতন মার্জিত ও ভদ্র। চেহারা সুরত দেখে মনে হচ্ছে ভার্সিটিতে পড়ে। টিউশনি শেষ করে ফিরছে হয়তো। লুবনার মনে তাই একসঙ্গে অনেক রকম ভাবনা খেলে যায়। তার কিছুটা ভয়ের, কিছুটা আতঙ্কের, আর বাকিটা যে কিসের, সে নিজেও জানে না। মাসুদ আগের চেয়ে দ্রুত হাটতে হাটতে এক সময় লুবনার পাশাপাশি চলে আসে। আর একপলক দেখে নিয়ে লুবনা ভাবে, ছেলেটা দেখখেতো মন্দ না। এখন শুধু কথাবার্তা ভালো হলেই হয়। ক্ষতি কি একটা ছেলে যদি এত রাতে তার পাশে থাকে!
যেন হঠাৎ দেখতে পেয়েছে, এমন একটা ভঙ্গি নিয়ে কথা শুরু করে মাসুদ-
- উহুমমম...উহুম... এতো রাইতে আপনের মতন একটা সুন্দরী মেয়ে একা একা হাটতেছেন; এইটা কি ঠিক?
লুবনা একটু হতাশ হল। এই ছেলেতো দেখি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে না। তবু সে জবাব দিল -
‘কেন ঠিক না কেন?’
চারপাশটা একবার দেখে নেয় মাসুদ। বলে-
- না মানে মানুষ কি আর আগের মতন আছে বলেন? দেখেন না চারপাশে কত কি ঘটতেছে।
এইবার লুবনাও একটু ভড়কে যায়।
- কি ঘটছে চারপাশে?
- চুরি, ডাকাতি,ছিনত্যাই, খুন- আরও কত কি! এইতো সেদিন ওই মোড় থেকে এক মহিলারে একলা পাইয়া গয়নাগাটি নিয়া গেল একটা ছেলে।
- বলেন কি?
- হ্যাঁ...। কারে বিশ্বাস করবেন, বলেন? কে যে কেমন, সেইটা বোঝার কোনো উপায় নাই। ভদ্র চেহারা সুরত নিয়ে লোকে চুরি ছিনতাই করে আজকাল।
লুবনা ভয় পেয়ে যায়। আর ভয় পেলেই তার আবার তোতলামি শুরু হয়ে যায়।
‘দেখুন আ...মার কিন্তু ভয়...ভয় লাগছে।’
- আরে ধুর! ভয়ের কি আছে? আমি আছি না সাথে। কিন্তু আপনেতো মনে হইতেছে কঠিন পেরেশানির মধ্যে পইড়া গেছেন। আগে এই সব কিছু শোনেন নাই, নাকি?’
‘হু, তাই তো!’
মাসুদ জিভ দিয়ে ঠোটে একটা চাটা দেয়-
‘তাইলে তো আপনার কপালটা খুব ভালো।’
‘কেন কপাল ভালো কেন?’
চারপাশটা শেষবারের মতো দেখে নিয়ে মাসুদ বলে-
‘না...আজকে এক্কেবারে প্র্যাকটিক্যাল দেখতে পাবেন তো, সেই জন্য।’
বলতে বলতে একটা চকচকে ক্ষুর উঠে আসে মাসুদের হাতে। সে খানিকটা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে-
‘দ্যান, কানের দুল আর গলার লকেটটা খুইল্যা দ্যান।’
লুবনা হতভম্ব হয়ে যায়। গোল গোল চোখে তাকিয়ে থাকে কতক্ষন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করে কানের দুল আর লকেট। মাসুদ গয়নাগুলো হাতে নিয়ে
ভ্যানিটিব্যাগটার দিকে নজর দেয়-
‘ব্যাগে মোবাইল আছে না? ওইটাও দিয়া দেন।’
লুবনা ভ্যানিটিব্যাগের ভেতর হাত ঢোকায়। এদিক- সেদিক হাতড়ে জিনিসটা বের করে আনে। তারপর তাচ্ছিল্যের একটা হাসি খেলে যায় তার মুখে। বলে ু
‘কথাটা তুমি ঠিকই বলেছিলে। কে যে কেমন, বাইরেটা দেখে সেটা বোঝার কোন উপায় নেই। দাও, আমার জিনিসগুলো ফেরত দাও। সাথে তোমার হাতঘড়ি আর মানিব্যাগটাও দিয়ো। আমার হাতেরটা দেখেছো? পেড্রো বেরেটা ৩২। বিচি লোড করা আছে। বেশি হাংকিপাংকি করলে চান্দি ছ্যাদা করে দেবো।’
কথা কয়টা শুনে মাসুদের মুখ আমসত্বের মতো হয়ে গেল। গয়নাগুলো হাতেই ছিল তখনো। পকেট হাতড়ে সে মানিব্যাগ বের করে আনলো। হাতের ঘড়িটাও খুলে দিল। সবকিছু ব্যাগে ভরে চলে যাওয়ার আগে ঘুরে দাড়াল লুবনা-
‘ক্ষুর দিয়ে আজকাল আর কাজ চলে না বুঝলে? আর শোনো, তোমার প্যান্টের চেন খোলা; চেনটা লাগাও। জানো তো, এ লাইনে ফিটফাট থাকাটা খুব জরূরী!’