রাষ্ট্রে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় এবং গণতন্ত্রের চলমান গতিকে আরও বেগবান করার ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভুমিকা বলার অপেক্ষা রাখেনা। প্রায় হাজার বছর আগে থেকে চীন ও গ্রীস সাম্রাজ্যে শুরু হওয়া এই বাহিনী বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন রাজ্যে, বিভিন্ন নামে এবং প্রায় একই কাজে দায়িত্ব পালন করে আসছে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই বাহিনী হয়েছে পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত ও আইন দ্বারা সুশৃঙ্খলিত এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছে সমাজ তথা রাষ্ট্রের আইন ও শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার রক্ষাকবচ হিসাবে।
আধুনিক যুগের প্রথম দিকেই এই বাহিনীর দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যাবহারের প্রবণতার প্রকাশ পায়। উদাহারন স্বরূপ, ১৮৫৪ সালে ব্রুকলিনের হ্যারি গ্রস নামে একজন জুয়া ব্যবসা পরিচালনাকারী প্রতিবছর ২০ মিলিয়ন ডলারের অবৈধ জুয়া ব্যবসা পরিচালনার জন্য পুলিশকে ১ মিলিয়ন ডলার অর্থ অবৈধ ভাবে প্রদানের প্রমাণ মিলে ( The New York Times 24th September, 1986 ) যা দীর্ঘ তদন্তে বের হয়ে আসে। বর্তমানে যে কোন দেশে এ ধরনের দুর্নীতির উদাহারন অপ্রতুল নয়। কল্যাণকামী রাষ্ট্রে দ্রুতই এই সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু আমাদের মতো দেশে এই সংক্রামক রোগের কি অবস্থা, এবং এই কুযাত্রার গতি-প্রকৃতি কিরুপ তা জানা প্রয়োজন।
১৭ জানুয়ারী একটি দৈনিক খবরের কাগজের একটি খবর দেখে বুক আঁতকে ওঠে “৬ দিনের ব্যবধানে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও যাত্রাবাড়ীর মীরহাজারিবাগে পুলিশের হামলার শিকার হলেন দুই ব্যক্তি”। কে কে হামলার স্বীকার হলেন তা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং কাকতালীয় ভাবে দুজনই ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা। এমন খবর কিন্তু খুব একটা দেখা যায়না, কারন যারা খবর করে তাদের ওতো রুটি-রুজির ব্যাপার আছে। সে যাইহোক, হয়ত প্রতিনিয়ত এমন অনেক ঘটনাই ঘটে যায় যার খোঁজ কেউ কোনদিন পায়না, অথবা নিরাপত্তার স্বার্থে ভিকটিম নিজেই চেপে যায়। বহুল ঘটিত এমন ঘটনা হয়ত একটু ভাটা পড়ে তখন, যখন ঐ নির্দিষ্ট বাহিনী কোন রুই-কাতলা গোছের কাউকে হামলা করে বসে। রুই-কাতলাদের চাপে বড় সাহেবরা তখন নোড়েচোড়ে বসতে বাধ্য হয়, যদিও সেই নড়াচড়া শুধু কিছু দিনের জন্য সাসপেন্ড বা মৃদু ভৎস্বর্ণার ভিতরেই সীমাবদ্ধ থাকে। তবে আমার আপনার মত সমাজের টেংরা-পুঁটি এমন ফান্দে পড়ে জীবনের মহা গুরুত্বপূর্ণ কিছু হারালেও স্বাধীন সংবাদ মধ্যমের দৃষ্টিতে পড়া দুস্কর, বড় সাহেবদের সাহায্য পাওয়া তো অনেক দূরের কথা।
বহুল ঘটিত এমন ঘটনা অহরহ ভাটা পোরে যায়, মাত্র একটা বলিঃ ধানমণ্ডিতে বসবাসরত একজন গবেষক (বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষক) তার একটি প্রকল্পের টাকা তুলতে ব্যাংকে গিয়েছিল, ১০০/২০০ গজ দূরে গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছিল তার মা...ব্যাংক থেকে বের হতেই সাদা পোষাকে দুইজন লোক, একজন অস্ত্র তাক করে আমরা পুলিশের গোয়েন্দা বাহিনীর লোক আপনাকে ঘিরে ফেলেছি আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে ...আপনারা ভুল করছেন, আমি না। ৩০/৪০ সেকেন্ডের মধ্যেই লোকটিকে ঐ বাহিনীর গাড়ির ভিতরে ঢুকিয়ে চোখ বেধে সিটের নিচে (পা রাখার জায়গায়) শুইয়ে দেওয়া হল। রাস্তার কিছু লোক নির্বাক নিথর হয়ে শুধু তাকিয়ে, কিচ্ছু বলার ছিল না। ওরা ওদের উপরের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলছিল...একটু পর, “তোর ফোন থেকে তোর বাসায় কল দে আর ৫ লাখ টাকা আনতে বল না হলে তরে ক্রস ফায়ারে দিয়া দিব” এই বলতে বলতে লোকটির টাকা রাখা কাঁধের ব্যাগটি এখনো কাঁধের রয়ে গেছে ওরা ঐ ব্যাগটি খুলে নিল আর ভিতরের ৩ লাখ টাকা দেখে খুবই অবাক হয়ে গেল (লোকটি ওদের কথা শুনে এমনটি মনে হয়েছে)। যাইহোক, লোক গুলা আরও কিছুক্ষণ টাকার জন্য চাপ দিল এরপর হঠাৎ মাথায় আর ঘাড়ে কিল-ঘুসি মারা শুরু করল এর পর বলল তোর সব ঠিকানা আমাদের জানাআছে এটা নিয়ে যেন কোন ধরনের ঝামেলা না হয় আর গাড়ি থেকে নেমে জাওয়ার পর যতক্ষণ গাড়ির শব্দ শুনবি মাথা নিচু করে রাখবি নাইলে গুলি, ওরা মোবাইল ফোনটাও লোকটির পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছিল, আর বাড়িয়ে লাভ নাই (খুব সংক্ষিপ্ত করলাম) ।
হ্যাঁ এই লাগামহীনতার সুস্পষ্ট কারন রয়েছে। এই বাহিনী বুঝে ফেলেছে যে তাদের ছাড়া সরকার শুধু একটি জল ছাড়া খালি কলসি মাত্র, বিদ্যমান দুর্বল ও নামমাত্র গণতন্ত্রের কর্ণধারদের যে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার মুরদ এখন প্রায় শূন্যের কোঠায় এবং সম্পূর্ণ বাহিনী নির্ভর তা খুবই স্পষ্ট । তাই নির্বাহী ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য চাই সঠিক অস্ত্রের সঠিক ব্যবহার, আর এক্ষেত্রে দুর্বল চরিত্রের একটি নির্দিষ্ট বাহিনীর জুড়ি নেই।
২০১৫ সালের Transparency International (TI) এর দুর্নীতি সূচক গবেষণায় এই বাহিনীর অবস্থান ছিল দ্বিতীয়, উল্লেখ্য ৯০% মানুষের মতামত এরা দুর্নীতি গ্রস্ত।
দুর্নীতির ফলাফল হিসাবে এই বাহিনীর কর্মকর্তারা প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে যার সামাজিক প্রভাব হিসাবে তৈরি হচ্ছে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা এবং (Elite Circulation)। পরিষ্কার করে বলতে গেলে এই বাহিনী প্রতিনিয়ত (কিছু ভাল সদস্য বাদ রেখে) প্রচুর অর্থ মজুদ করছে, যার ফলশ্রুতিতে , বাংলাদেশে পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমত, এলিট হওয়ার জন্য চাই অর্থ তা তারা সংগ্রহ করে ফেলেছে, দ্বিতীয়ত দেশের প্রাণ কেন্দ্র ঢাকায় ও অন্যান্য বড় শহরে জমি ও ফ্ল্যাট এর মালিক হওয়া এবং তৃতীয়ত একটি দামী গাড়ির মালিক হওয়া।
এই জিনিস গুলো থাকলে এ দেশে একটি লোকের স্ট্যাটাস অনেক উপরে উঠে যায়, লোকজন তাকে স্যার না বললে নিজেরাই বিব্রত হয়, এমন প্রতিপত্তি নিয়ে কেউ যদি গ্রামে যায় তাহলে গ্রামবাসী তাদেরকে আকাশের চাঁদ বা তারা মনে করে। এই স্যার সম্বোধন ও চাঁদ, তারার মর্যাদা তাকে মাসলোর চাহিদা সোপানের দিকে ধাবিত করে। একইভাবে প্রাথমিক চাহিদাগুলো পুরন শেষে প্রাকৃতিক নিয়মেই আত্মপূর্ণতার চাহিদা সামনে চলে আসবে সুতরাং এই গ্রুপ তখন চাহিদা সোপানের সর্বচ্চো পর্যায়টিই দখল করার দিকে মনোনিবেশ করবে অর্থাৎ ক্ষমতা দখল।
অর্থ-সম্পদ হলেই ক্ষমতা দখল করতে হবে বেপারটা তেমননা। এই বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহনের উচ্চাভিলাষীতার পেছনে শুধুই ক্ষমতা গ্রহনের আবেগ জড়িত থাকবেনা থাকবে বাস্তবসম্মত ভিত্তি কারন প্রথমত, এদেশে এরা কেন্দ্রীয় ক্ষমতার খুব কাছে অবস্থান করে। দ্বিতীয়ত, এদের শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ ক্লাব বা সংগঠন রয়েছে যা অনেক সময় চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হিসাবে কাজ করে। তৃতীয়ত, দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও দুর্বল রাজনৈতিক দল ব্যবস্থা সম্পর্কে এই বাহিনীর গভীর জ্ঞানের উপস্থিতি। সর্বশেষ, বর্তমান সময়ে সরকারের ঐ বাহিনীর উপর অধিকতর নির্ভরশীলতা।
এটি একটি অপ্রত্যাশিত বিষয়ের দুশ্চিন্তা। তবে ভয়ের বিষয় হচ্ছে রাজনৈতিক বা সরাসরি বলা যায় গণতান্ত্রিক অবস্থা যদি বর্তমানের ন্যয় আরও এক দশক/যুগ চলতে থাকে তাহলে এ বাহিনী তাদের অবস্থান সম্পর্কে আরও পরিনত ধারনা লাভ করবে সাথে সাথে উপরোক্ত কারনগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এই পরিস্থিতিতে উক্ত বাহিনী যদি অন্য কোন বাহিনী বা গোষ্ঠীর সাথে গোপন আঁতাত করে ক্ষমতা দখলের অপচেষ্টা করে তখন কিন্তু গনতন্ত্রের সুকন্যা বা রাজকন্যা বা রাজপুত্রের কিচ্ছু করার থাকবে না এটা আমি নিশ্চিত।
এই নব্য বিপদের সম্ভাবনা থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য দরকার কার্যকর গনতন্ত্রের চর্চা করা সেই সাথে গণতান্ত্রিক ধারার শক্তিশালী সরকারের কল্যাণকামী রাষ্ট্র পরিচালনা এবং বহুদলীয় রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা ও তা বজায় রাখা এবং স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ নিয়ন্ত্রিত, বিশ্বস্ত ও দুর্নীতিহীন সরকারি বাহিনী।
[ বিষয়টি একান্তই আমার একটি দুশ্চিন্তা, দয়াকরে অন্যভাবে নিবেননা, "ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়" ]
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:৩৬