১৮৫৫ সালের ৩০ জুন সাঁওতাল কৃষকেরা বিদ্রোহ করেছিল ইংরেজ সরকার আর জমিদারী শোষণের বিরুদ্ধে। ৫০ হাজার সাঁওতাল তীর, ধনুক, টাঙ্গি, কুঠার নিয়ে বিহার, বীরভূম আর মুর্শিদাবাদের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ইংরেজ শাসন শূন্য করে ফেলেছিলেন। স্তম্ভিত ইংরেজ শাসককে সতর্ক করতে তাঁরা বলেছিলেন- “নেরা নিয়া নুরু দিয়া, ডিদা নিয়া বিঠা নিয়াঃ.” বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায় “আমরা আবার বিদ্রোহ করব, স্ত্রী-পুত্র কন্যার জন্য, ভূমির অধিকারের জন্য, ফসলের জন্য, পূর্বের মত সব ফিরে পাবার জন্য, আমরা আবার বিদ্রোহ করব।” তারপর গিয়েছে দেড়শ বছরের বেশি সময়। ব্রিটিশ গেল, পাকিস্তান গেল, কিন্তু বর্গীর হানা যেন বন্ধ হবার নয়। জমির জন্য আদিবাসী কৃষক হত্যা, ভয় দেখিয়ে দেশান্তরে বাধ্য করা, আদিবাসী নারীর অমর্যাদা যেন ললাট লিখন- খন্ডাবার নয়। নিজদেশেই তারা ভূমিহীন, পরবাসী, অসহায়, দুঃখী। ১৯৯৮ সালের ১৮ আগস্ট নওগাঁর ভীমপুরে সাঁওতাল নেতা আলফ্রেড সরেনকে ভূমিলোভীরা হত্যা করেছিল। এ নিয়ে নাট্যজন মামুনুর রশীদ নাটক বানালেন “রাঢ়াং”। কিন্তু শোষণমুক্তির সংগ্রাম তো শেষ হল না।
অশিক্ষা, দারিদ্র্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য রাষ্ট্র এবং নীতিনির্ধারকদের উপেক্ষা আর উদাসীনতা আদিবাসীদের জীবনকে দিন দিন আরও প্রান্তিকতায় ঠেলে দিচ্ছে। সব জায়গায়ই একই অবস্থা তা উত্তরাঞ্চলের সাঁওতালই হোক কিংবা সিলেটের মণিপুরীই হোক কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা-মারমা হোক আর ময়মনসিংহের গারো সম্প্রদায়ই হোক। হত্যা, ভূমিদখল, জোরপূর্বক উচ্ছেদ, সশস্ত্র হামলা, নারী অপহরণ-ধর্ষণ-শ্লীলতাহানি-জোরপূর্বক বিয়ে, বেকারত্ব, ন্যায় বিচারপ্রাপ্তিতে ব্যর্থতা এগুলো বেড়েই চলেছে। আদিবাসী নারীকে অমর্যাদা করে পুরো সম্প্রদায়কে শায়েস্তা করার হীন চক্রান্ত এবং মানসিক আদিবাসী নারীকে আরো অসহায় করে রেখেছে। বাংলাদেশের নারীরা এমনিতেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিভিন্ন মাত্রায় বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার এবং সেটা সমাজের সব শ্রেণীতে, সব পর্যায়ে। আদিবাসী নারীর অবস্থান আরও প্রান্তিকতায়। প্রথমতঃ নারী হিসাবে, দ্বিতীয়তঃ আদিবাসী সমাজে, তৃতীয়তঃ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর হাতে। আদিবাসীদের মধ্যে গারো ও খাসিয়াদের সমাজ মাতৃতান্ত্রিক হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আধিপত্য পুরুষের হাতেই।
মাতৃতান্ত্রিক আদিবাসী সমাজে নারীর আইনী উত্তরাধিকার থাকলেও তার প্রয়োগ বা চর্চা নেই। নেতৃত্বে নারীর অংশগ্রহণ ও সুযোগ অনিশ্চিত। আমাদের জাতীয় উন্নয়ন নীতি কিংবা অর্থনৈতিক পরিকল্পনায়, এমনকি শিক্ষানীতির কোথাও আদিবাসীদের প্রসঙ্গ নেই। যদিও একটু পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আদিবাসীরাও জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে, বিশেষত সম্পদ আর শ্রমের বিবেচনায় আদিবাসী নারীরা। আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী আদিবাসী নারীদের চাকরিতে নিয়োগ ও সমপরিমাণ মজুরি দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এমনকি ভূমির ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত অধিকারের প্রসঙ্গ গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু শ্রমের এই সুনির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি লঙ্ঘিত হচ্ছে সর্বত্রই।
সরকারি হিসাব মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে ৫০ লাখ একর খাস জমি রয়েছে। কিন্তু এই খাস জমি কোথায় কীভাবে আছে তা বিগত কোন সরকারই উন্মোচন করতে পুরোপুরি সক্ষম হয়নি। যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে উদ্ধার অভিযান শুরু হয়েছিল। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে খাস জমিতে বসবাসরত আদিবাসি অনেক পরিবারকে উচ্ছেদ করে ভূমিদস্যুরা তা দখল করেছে এমন খবর পত্র-পত্রিকায় এসেছে। আমরা দারিদ্র্য বিমোচনের কথা বলি। নতুন সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা খাস জমি উদ্ধার করে প্রকৃত ভূমিহীনদের দিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা তারা করবেন। যার জন্য একটি সমন্বিত ভূমি সংস্কার প্রয়োজন। আদিবাসীরাও যাতে তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত না হয় তা তারা দেখবেন বলে আমরা আশা করি।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





