আমরা যখন একত্র হই, ভাঙা টুকরো টুকরো সময়কে জোড়া দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠি। প্রবীণদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ি পুরনো সময়ের রোদ লাগা পুকুরে। ডুবোতে থাকি বারবার; কাদার ভেতর হাতড়ে বেড়াই সোনালী পেটের বয়স্ক কই। কখনও বা পেয়ে যাই তাগড়া শিং, চেঁচিয়ে পাড়া মাত করে ফেলি; লোকজন ভাবে, পেয়ে গেছি বিশাল কোনও রুই-কাতলা। হয়তবা জালের ভেতর আটকা পড়ে বিরাট শোল বা রূপালী ফলির ঝাঁক। নারিকেলের দুধে কষানো শোলের নরম ছোট ছোট টুকরো, এখনও জেগে আছে সে স্বাদ; গন্ধ পেতে পুরনো হাত আবারও নাকের কাছে ধরি। কলার পাতে দেয়া হরেক ছোট মাছ, আঁচ লাগা গন্ধ, হঠাৎ নাক খুঁজে পায় পুরনো রান্নাঘর। মাটির হাঁড়ির বাসি ভাত সাথে মসলায় ভুনা বাসি বাইলা মাছ। জিভে জল আসে পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে।
চেয়ে থাকি অপলক। কার আগে কে বলবে? কে আগে ছোঁবে বাঁশতলায় বুড়ো গুঁইসাপের একচ্ছত্র রাজত্ব, ড্রাগনের মতো যার মুখ থেকে বের হত গনগনে লাল শিখা? লাউয়ের ডগার মতো সবুজ দেহের সাপটি- পাতার ফাঁক গলে যে লতা হয়ে ঝুলে থাকত, ভয়হীন ডাহুকের নিশ্চিন্ত ঝোঁপের আড়াল অথবা তাগড়া বেজির মুখে পা ছুঁড়তে থাকা হাঁসের ছানা? কোনটি রেখে কোনটি বলব? হইহই পড়ে যায়, নেশাগ্রস্তের মতো উল্লাসে ফেটে পড়ি, আমরা যেন কেউ কারও দিকে তাকাই না, শুধু অতীতের দিকে তাকাই, একটা সময়কে যেন তুলে এনে বসাতে চাই আমাদের মাঝখানে, এরপর যে যার মতো রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাই, শুষে আনতে চাই সমস্ত রস, নিংড়ে নিংড়ে সময়টাকে ছোবড়া বানিয়ে ফেলে রাখি একপাশে, আকণ্ঠ রস পান করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি। গলাগলি করে মাতালের মতো টলতে টলতে হাঁটি কিছুক্ষণ। আমরা সুঁইয়ের মতো অতীতে একফোঁড় দিয়ে বর্তমানে আরেক ফোঁড়, আবার অন্য এক ফোঁড় হয়ে অতীতে ফিরে যাই।
ওই তো, রোদে পুড়ে পুড়ে হয়রান মধ্য দুপুরের মেঠোপথ, ছুটতে থাকা বাছুরের লেজের মত এঁকেবেঁকে পড়ে আছে গাঁয়ের মাঝখানে। সাদা বুক জুড়ে তার নীরব দীর্ঘশ্বাস, ক্লান্ত এক বৃদ্ধ সে নৈঃশব্দ্যকে আরও বিষণ্ণ করে দিয়ে ধীর পায়ে বাড়ি ফিরছে। আচমকা এক চীলের আকাশ ফাটা চীৎকার নৈঃশব্দ্যকে বর্শার ফলায় গেঁথে ফেলল যেন, গেঁথে যাওয়া বোয়ালের মত ধ্বনি-প্রতিধ্বনির ফাঁপরে পড়ে কাতরাতে থাকে নৈঃশব্দ্য। তারপর একসময় ম্লান হয় নিজের ভেতর।
হঠাৎ শ্যালো মেশিন থেকে উপচে পড়ছে পানি, থইথই জলে খলখল করছে কয়েকটি ছেলেমেয়ে। হলুদ পা ডুবিয়ে শালিকগুলো পান আর স্নান সারছে আর ঠারে-ঠোরে সতর্ক চোখ রাখছে ছোট্ট মাথা ঘুরিয়ে। ক্ষেতগুলোতে সবুজ শৈশবের ঢল, লাল ফড়িঙের পাখায় নাচছে তরমুজের ফুল।
আমরা ভাষা খুঁজে পাই না। দীর্ঘক্ষণ শব্দহীন কাটাই...। তারপর সশব্দে ফেটে পড়ি, এ-ওর গায়ে ঢলে পড়ে বলতে থাকি সে সময়ের কথা, হাসতে থাকি সে সময়ের হাসি, খেতে থাকি সে সময়ের খাওয়া, গাইতে থাকি সে সময়ের গান। যক্ষের ধনের মত সে সময়কে আঁকড়ে থাকি, আমরা আর এক পা-ও এগোই না।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





