কথাটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, যশোরে এমন একটি গ্রাম আছে যার নামে সরকারি কাগজপত্রও আছে; কিন্তু ওই গ্রামের লোকজন জানেন না গ্রামটির নাম কী।
যিনি শুনবেন তিনিই বলবেন আজব কথা। আমিও বলেছিলাম। কিন্তু ওই যে কথা মিডিয়ার লোক। এমন আজব খবর শুনে মন্তব্য যাইই করি না কেন গ্রামটিতে যাওয়ার পরিকল্পনা নিলাম। গত ফেব্রুয়ারি ছিল সেই আজব খবরের পেছনে ছোটার দিন।
গ্রামটি বাঘারপাড়া উপজেলায় অবস্থিত। সেখানে যাওয়ার রুট বাতলে দিল স্নেহভাজন সাংবাদিক লক্ষণ চন্দ্র ম-ল। তার বাড়ি মাগুরার শালিখা উপজেলার সীমাখালীতে। সে ফোনে জানাল, যশোর-ঢাকা সড়কের খাজুরা বাজার থেকে পূর্বদিকে রায়পুর হয়ে যেতে হবে দৌলতপুর স্কুলের কাছে। সেখানে রাস্তায় সে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি পেঁৗছানোর পর গাইডের ভূমিকা পালন করবে সে।
আমার সফরসঙ্গী হলেন আমার স্নেহভাজন আবদুল আলিম বাবুল ও তার বাল্যবন্ধু আরিফুল আলম আরিফ। আমাদের বাহন প্রাইভেটটি আরিফ এনেছিল।
ঢাকা সড়ক ছেড়ে আমরা বাঘারপাড়া রোড ধরে চললাম রায়পুরের দিকে। রায়পুর হয়ে যাওয়ার কথা দৌলতপুর। কিন্তু আমরা পথ ভুলে চলে যাই বাঘারপাড়ার দিকে প্রায় দেড় কিলোমিটার। সেখানে কজন প্রবীণ লোকের কাছে জানতে চাইলে তারা পথ দেখিয়ে দেন। আমরা ফের ফিরে আসি রায়পুর বাজারে। এ বাজারে নেমে চা পানের জন্য এক দোকানে গেলে দোকানদার জানালেন, তালতলার লিয়াকতের দোকান ছাড়া কোথাও দুধ চা পাওয়া যাবে না। এখানকার সব টি-স্টলে লাল চা বিক্রি হয়। তালতলার ওই দোকান থেকে চা পান শেষে আমরা সঠিক পথ ধরেই এগোলাম দৌলতপুর বাজারের দিকে। মাঝে মধ্যে মোবাইলফোনে লক্ষ্মণের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাদের চলার পথ সঠিক হচ্ছে কিনা জেনে নিচ্ছিলাম।
বাঘারপাড়ার এ অঞ্চলে এসে একটি বিষয় লক্ষ্য করলাম যে, রাস্তায় যানবাহনের মধ্যে নসিমন, করিমন আর আলমসাধুর আধিক্য। ঠাসা যাত্রী নিয়ে গাঁয়ের রাস্তায় দ্রুত গতিতে চলছে এসব বাহন। আমাদের সমাজে একশ্রেণীর লোক আছে, এই গ্রামীণ বাহনের বিরোধিতা করার জন্যই যেন তাদের জন্ম হয়েছে। তারা মাটি ও মানুষের সঙ্গে সম্পর্কহীন জীব মাত্র। ওরা যদি বুঝত গ্রামীণ এ বাহন ছাড়া গ্রামের অর্থনীতির চাকা অচল। আর এই চাকা অচল হলে দেশের চাকা সচল করার কোন শক্তি থাকবে না, তাহলে তারা বিরোধিতা করত না।
অাঁকাবাঁকা পিচঢালা আর সলিংয়ের রাস্তা মাড়িয়ে যাওয়ার সময় দু'ধারে চোখে পড়ল খেজুর গাছের সারি। সব গাছ থেকে চলতি শীত মৌসুমে রস সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ এলাকায় আসলে যে কোন লোককে নিয়ে যাবে খেজুরবিথীর ঐতিহ্যসমৃদ্ধ সুদূর অতীতে। যশোরের অন্য কোন জনপদে এত খেজুর গাছ নেই। এ জেলার মফস্বল এলাকায় ব্যাপক সফরকালে আমি এ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছি। রাস্তার দু'পাশে আরো দেখা গেল কৃষকরা জোটবদ্ধ হয়ে বোরো রোপণের কাজ করছে। ধান রোপণের সময় প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। তাই কৃষকদের এত ব্যস্ততা।
কিছুদূর এগুতেই নাগাল পেলাম দৌলতপুর স্কুলের। সেখানে জাঙ্গালের মোড়ে রাস্তার মাথায় ট্রাফিক পুলিশের মতো দাঁড়িয়ে আছে লক্ষণ চন্দ্র ম-ল। পেঁৗছাতেই বিনম্র অভিবাদন জানাল সে। জাঙ্গালের মোড় পাকা রাস্তা থেকে দক্ষিণ দিকে কাঁচা রাস্তায় পা বাড়ালেই পড়ে সেই গ্রামটিতে। নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নের এ গ্রামটির নাম কাকডুবি। গ্রামের বাসিন্দারাই যে গ্রামটির নাম জানে না তার প্রমাণ পেলাম লোকজনের সঙ্গে কথা বলে। প্রথমে কথা হলো নবতিপর বৃদ্ধ আকমল বিশ্বাসের সঙ্গে। তার কাছে জানতে চাইলাম গ্রামটির নাম কী? তিনি সোজা কথায় বললেন, দৌলতপুর।
_ আপনার নিজের গ্রামের নাম বলাটা ভুল হচ্ছে না?
_ তা হবে কেন। আমার গ্রামের নাম ভুল করে বলে লাভ কী।
_ কাকডুবি গ্রাম কোনটি?
_ তা তো জানি নে।
_ এই গ্রামটির নাম কাকডুবি। আপনি সব ক্ষেত্রে কী গ্রামের নাম দৌলতপুর বলেন?
_ হ্যাঁ, তা বলি।
_ ছেলে-মেয়ে বিয়ে দেয়ার সময় কোন গ্রামের নাম বলেন?
_ দৌলতপুর।
_ জমিজমা বেচার সময় কোন নাম ব্যবহার করেন?
_ তখনও দৌলতপুর।
_ এতে কোন অসুবিধে হয় না?
_ কালেভদ্রে হয়। যেমন_ আমাদের নামে বরাদ্দ আসে দৌলতপুর ঠিকানায়। অনেক সময় আমরা তা পাইনে। এখন বুঝতে পারছি নামের কারণেই আমরা পাইনে।
কথা হলো সত্তরোর্ধ্ব ইজাহার তরফদার ও মোহসীন মোল্লার সঙ্গে। তারাও বললেন একই কথা।
আবদুল আহাদের বয়স ত্রিশ বছর। সে বলল, আমি এই প্রথম শুনছি আমাদের গ্রামের নাম কাকডুবি। এর আগে কোনদিন শুনিনি।
_ এখন জানার পর কী তোমার গ্রামের নাম কাকডুবি বলবে?
_ তা কী আর বলা যাবে।
_ কেন
বললে তো কেউ বুঝবে না। তখন হবে আর এক ফ্যাসাদ। তাছাড়া টাইটেলটাও ভালো না। দৌলতপুর নামটা শুনতে ভালো লাগে।
কাকডুবি গ্রামের নাম সরকারি নথিপত্রে আছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট প্রকাশিত ভূমি ও মৃত্তিকা সম্পদ ব্যবহার নির্দেশিকায় কাকডুবি নাম আছে। নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নের ১৬টি গ্রামের মধ্যে ক্ষুদ্রতম গ্রাম এটি। এখানে জমির পরিমাণ মাত্র ৫১ হেক্টর। ভূমি অফিসের নথিতেও আছে এসব তথ্য।
গ্রামটিতে কুড়িঘর লোকের বাস। লোকসংখ্যা হবে শ'দেড়েক। এর মধ্যে কৃষিজীবী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী সব পেশার মানুষ আছে। স্নাতক পাস আছে তিনজন। এসএসসি বা সমমানের আছে পাঁচজন। ১২ জন থাকে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করছে সবাই। গ্রামবাসীর আর্থিক অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল। তাদের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, ছেলেমেয়ের বিয়েসাদি, স্কুল-কলেজে ভর্তি, চাকরির দরখাস্ত, ভোটার তালিকা, আইডি কার্ড সব জায়গায় গ্রামের নাম হিসেবে দৌলতপুর ব্যবহার করে। ইউনিয়ন পরিষদ অথবা উপজেলা পরিষদ থেকে কোনো কিছুর বরাদ্দ এলেও দৌলতপুরের নামে আসে। এতে অনেক সময় বিভ্রান্তির সৃষ্টি হওয়ায় তারা সেসব বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত হন। নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান জানান, তিনিও প্রথমদিকে কাকডুবির কথা জানতেন না। সরকারি কাগজপত্র ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে এ নামটি জানেন।
প্রবীণরা জানান, কাকডুবি গ্রামে আগে জনবসতি ছিল না। গ্রাম জুড়ে ছিল আম কাঁঠালের বাগবাগিচা ও ফসলি জমি। দৌলতপুরের একটি পাড়া হিসেবে বছর বিশেক আগে এখানে প্রথম আবাস গড়ে তোলেন আলম বিশ্বাস। তার বাড়ি ছিল মূল দৌলতপুর গ্রামে। পরে একে একে ২০টি পরিবার এখানে এসেছে।
এ গ্রামে বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। তাই সাধ এবং সাধ্য থাকা সত্ত্বেও টেলিভিশন কিনতে পারছেন না অনেকে। সুকুমারের বাড়িতে একটি টিভি আছে সেটি ব্যাটারিতে চলে। প্রতি বাড়িতে আছে একাধিক সেলফোন। সেগুলো চার্জ দেয়া হয় দৌলতপুর গ্রাম থেকে। এ জন্য ফোন প্রতি মাসে ১০ টাকা দিতে হয়।
কাকডুবি কিন্তু বিচ্ছিন্ন কোন গ্রাম নয়। একাধিক এনজিও এখানে কাজ করে। গণবীমার গ্রাহকও আছে। নিয়মিত আসেন কৃষি স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের লোকজন। তারা সবাই কাজ করেন দৌলতপুর গ্রামের একটি পাড়া হিসেবে। একটি মাত্র রাস্তা আছে, তাও কাঁচা। এ কারণে সারা বছর যোগাযোগ সংকটে ভোগেন তারা। বিদ্যুৎ ও রাস্তাটি পাকা করা ছাড়া গ্রামবাসীর কোন কিছু চাওয়া-পাওয়া নেই।
সূত্র: যশোর নিউজ ডট নেট

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





