কী লিখতে যাচ্ছি জানি না। তবু বসলাম।
তখন কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। ১৯৮৫। ঢাকা কলেজ।
বাংলা পড়াতেন জামান স্যার, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার, শামীম আজাদ ম্যাডাম আরও ৪/৫ জন স্যার/ম্যাডাম পড়াতেন, যাঁদের নাম মনে নেই।
খেই হারিয়ে ফেললাম- কলেজের কথা চলে আসলো বলে। কতো কিছু, কিন্তু কোন্টা লিখবো?
জামান স্যার ক্লাসে এসে বাংলা সিনেমার উপর তাঁর সরেজমিনলব্ধ জ্ঞানের কথা বলতেন। তখন তো খুব সিনেমাপাগল ছিলাম, তাই ভালো লাগতো। স্যার নাকি বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষদের সাথে মিশবার জন্য মাঝে মাঝে একেবারে সামনের সাড়িতে (থার্ড ক্লাসে) গিয়ে বসতেন। হাইস্কুল লেভেল পর্যন্ত মা-বাবার মতো শিক্ষকগণও সিনেমা দেখাটাকে বখে যাওয়ার লক্ষণ মনে করতেন, কিন্তু জামান স্যারের 'সিনেমাদর্শন'-এর জ্ঞান আমাকে সিনেমা দেখার জন্য খুবই অনুপ্রাণিত করতো। দু কদম হাঁটলেই বলাকা সিনেমা হল, শো-টাইমে যার সামনের দিকটা দর্শনার্থী মানুষে থইথই করতো। ওখানে গিয়ে পাগল হয়ে যেতাম। অনেকদিনই হোস্টেলে দু-একটা মিল না খেয়ে টাকা বাঁচিয়ে সিনেমা দেখেছি।
বলাকার পাশেই ইডেন। ওখানে শাহনাজ পড়তো। স্কুল পার হয়ে ঢাকার শহরে শাহনাজকে কতো খুঁজেছি! একদিন নবাবগঞ্জ সেকশনে খালার বাসায় যাওয়ার পথে দেখি শাহনাজ আসছে রিকশায় উল্টো দিক থেকে, ওর পাশে আরেকটা মেয়ে। শাহনাজ হাসছিল সেভাবে যে হাসির জন্য আমি খুন হয়ে যেতাম। ...........শাহনাজ কি একবারও আমাকে খোঁজে না যেভাবে ওকে আমি খুঁজি- এমন ভেবে ভেবে কতো কেঁদেছি!। রুমমেটের সাথে কথা বলতে বলতে চোখে পানি চলে আসতো- ও জানতো না কিছুই, শুধু জানতে চাইতো কী হয়েছে।
শাহনাজের সাথে আজ কথা হলো।
কিরে, ফোন ধরিস না কেন?
ব্যস্ত আছি।
অন্তত ফ্রি হয়ে কি একটা কল দেয়া যায় না?
না।
তুই মানুষ হবি কবে?
আমি খুব ভালো মানুষ। বিশ্বাস না হলে আমার বউরে জিগা।
ইশ, তোর কথাবার্তাও তো দেখছি অভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
রাখি, ব্যস্ত আছি।
হ্যাঁ, ব্যস্ত তো থাকবিই, ফোন করি তো!
রাখি।
কাল বীনা ফোন করেছিল। খুব দুঃখ করলো। তুই নাকি ওর ফোন ধরিস না?
ব্যস্ত থাকি।
এতো ব্যস্ত কী নিয়ে?
তুই বুঝবি না।
হ্যাঁ, আমার তো বোঝার বয়স হয় নাই।
একটা কবিতা শুনবি?
বল।
আমি কবিতার নাম বলি- 'তারপর গুরু ভনিলেন অমর বাণী।' শাহনাজ হাসে। আমি বলি, তোদের মতো মূর্খের কাছে আর কবিতা বলবো না। রাখি।
কিন্তু রাখতে রাখতেও পিসি থেকে দুটো কবিতা শোনালাম। বেশিক্ষণ মোবাইলে কথা বলতে গেলে কানে ব্যথা হয়ে যায়।
শাহনাজ শেষ করলো, মাঝে মাঝে ফোন দিবি, অন্তত মিস্ডকল।
চলুন কলেজে ফিরে যাই।
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার তখন একজন বিখ্যাত টিভি উপস্থাপক হিসেবে পরিচিত। কিন্তু তখনো তাঁর কোনো অনুষ্ঠান দেখবার সুযোগ হয় নি বলে খুব আফসোস হতো।
স্যার ক্লাস নেয়ার সময় গ্যালারি ভরে যেতো; বেঞ্চিতে জায়গা না পেয়ে ছাত্ররা দাঁড়িয়ে থাকতো। অন্যান্য সেকশন, সিনিয়র-জুনিয়র সব সেকশনের ছাত্ররা চলে আসতো। তিনি আমাদের 'হৈমন্তী' পড়িয়েছিলেন। ৩ কি ৪ দিনে। আমার সারা জীবনে আজও ওরকম কোনো ক্লাসে এ্যাটেন্ড করার সৌভাগ্য আমার হয় নি। কিন্তু পরবর্তীতে বিটিভিতে স্যারের উপস্থাপনায় একটা অনুষ্ঠান দেখে খুব মর্মাহত হয়েছিলাম। তাঁর বাংলার ক্লাস যতোখানি উপভোগ্য, রসাত্মক ও আকর্ষণীয় ছিল, টিভি অনুষ্ঠান তার এক দশমাংশও মনে হয় নি।
শামীম আজাদ ম্যাডাম পড়াতেন 'সমুদ্রের প্রতি রাবণ' কবিতাটি। রাবণের পিতৃত্ববোধের বর্ণনা দিতে গিয়ে ম্যাডাম এক ক্লাসে বলে ফেললেন- নিজ সন্তান আর পরস্ত্রী সর্বদাই লোভনীয়। তখন তো সব 'স্ত্রী'ই আমাদের পরস্ত্রী, তাই কথাটার গূঢ়ার্থ আমাদের কাছে ততোখানি স্ট্রাইকিং মনে হয় নি। কিন্তু ম্যাডাম কথাটা বেশ ক'বার বললেন। ১০ সেকেন্ড নীরবতা; হঠাৎ গ্যালারির মাঝখান থেকে 'গর্ধভ' একজন দাঁড়িয়ে গেলো : ম্যাডাম, আমার বউ যদি খুবই সুন্দরী হয়, আর পরের বউটা দেখতে যদি খুবই বিশ্রী হয়, তবুও কি আমার কাছে পরস্ত্রী লোভনীয় মনে হবে?
মুহূর্তে ক্লাসের মধ্যে হাসির বোমা ফাটলো। ম্যাডাম এখন এই পাগলদের চেঁচামেচি থামাতে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
সেই হাসি একটুখানি স্তিমিত হয়েছে, এমন সময়ে পেছন থেকে আরেক পাগল দাঁড়িয়ে বয়ান করলো : ম্যাডাম, আমার বউ 'বিশ্বসুন্দরী' হলেও কি পরের বউয়ের জন্য আমার লোভ হবে?
এটা ফাটলো এটম বোমার মতো।
ম্যাডাম বোধ হয় ঢাকা কলেজ থেকে লন্ডনে চলে গিয়েছিলেন। অনেক বছর পর গত বছর চ্যানেল আইতে তাঁর একটা সাক্ষাৎকার দেখি। দেখলাম ম্যাডাম একটুও বদলান নি।
যেখানে যাই সেখানেই ঢাকা কলেজিয়ানদের খুঁজি। ঢাকা কলেজের পুরনো যে কাউকে পেলেই কলেজের গল্প উঠে আসে। সবার আগেই যে কথাটা উঠে আসে তা হলো- সেই ঢাকা কলেজ আর ঢাকা কলেজ নেই। একদিন যে কোনো মেধাবী ছাত্রের জন্য ঢাকা কলেজ ছিল অনলি ওয়ান চয়েস। আজ সেই ঢাকা কলেজের কোনো নামডাকই নেই। ঢাকা কলেজ আজ শুধু ইতিহাস।
শাহনাজের যমজ দুই ছেলে গত বছর এসএসসি পাশ করলো। বড়টা জিপিএ-৫ সাধারণ আর ছোটটা জিপিএ-৫ গোল্ডেন। বড়টা জিপিএ-তে 'গোল্ড' মিস করেছে বলে ওদের হাহাকারের অন্ত নেই।
হাহাকার বাড়লো কলেজে ভর্তির সময়। ওদের চৌদ্দ গোষ্ঠির সাধ হলো ওরা নটরডেম কলেজে পড়বে। ভর্তিফর্ম ফিলআপ করে জমা দেয়া হলো। কিন্তু বয়সের ভিত্তিতে ভর্তিতালিকা নির্ণয় করা হবে বলে ওরা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো, কারণ ওদের সার্টিফিকেটের জন্মতারিখই প্রকৃত জন্মতারিখ; আর সে হিসেবে ওদের বয়স মোটামুটি কমই।
ভর্তিতালিকায় 'নির্বাচিত'দের মধ্যে ওদের নাম নেই; তবে 'গোল্ড'অলার নাম ওয়েটিংয়ে আছে। শাহনাজ ইতোমধ্যে প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলে ফেলেছে। কিছুটা আশ্বাস পাওয়া গেছে যে গোল্ডকে 'ওয়েটিং' থেকে কনফার্ম্ড লিস্টে উন্নীত করা হতে পারে। কিন্তু সাধারণটাকে কোনো মতেই সম্ভব নয়।
আমাকে হন্তদন্ত হয়ে ফোন দিয়ে সবিস্তারে জানিয়ে সবিনয় নিবদনে শাহনাজ বলে, তুই কি একটু আমার সাথে যাবি প্রিন্সিপালের কাছে?
ওরেব্বাবারে! আমি ঘরকুণো ম্যাঁও প্রিন্সিপালের কাছে যাবো? মরে গেলেও সম্ভব না। আমার খুব লজ্জা করে। তুই একাই যা। তুই তো মেয়েমানুষ, তোর কোনো ভয় নাই।
কোনো ভরসা না পেয়ে 'মেয়েলোকের চেয়েও অধম' ইত্যকার গালিগালাজ করে শাহনাজ ফোন রেখে দেয়। আর আমার খুব অনুশোচনা হতে থাকে- হায়, আমি শাহনাজের জন্য কিছুই করতে পারলাম না!
শাহনাজ আমার উপর ক্ষেপে আছে। ওর সাথে বনিবনা না থাকলে আমার অনেক ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। মিটিয়ে ফেলি।
রাতে ফোন দিই। শাহনাজ খুব উৎফুল্লভাবে জবাব দেয়, কিরে, কী খবর?
আমার খারাপ লাগে এই ভেবে, ও ওর ছেলেদের নটরডেম কলেজে ভর্তি করিয়ে ফেলেছে, আর সে কাজে আমি এক ফোঁটা অবদান রাখতে পারি নি। অথচ রাজ্জাক ভাই জানেন, যে কোনো বিপদ-আপদ বা কাজের জন্য আমিই শাহনাজের জন্য একমাত্র ভরসা।
অপরাধী স্বরে বলি, গুড। ওদের ভর্তি নিয়ে ঝামেলা মিটে গেলো।
শাহনাজ টেনে টেনে বলে, হ্যাঁ, অনেক চিন্তা করে দেখলাম নটরডেমে হবে না। আর হলেও মাত্র একজনের হবে। দুই ভাই দুই কলেজে গেলে কতো সমস্যা না?
আমি উৎসাহিত হয়ে বলি, হ্যাঁ হ্যাঁ বল, কী সিদ্ধান্ত নিলি?
শাহনাজ বলে, একটু পরেই আমি তোকে ফোন দিতাম।
কেন?
ওরা তো ঢাকা কলেজেও ফর্ম সাবমিট করেছিল। মানসুর ভাই (ঢাকা কলেজের জনৈক অংকটিচার, আমাদের স্কুলের) জানালো ওদের দুজনের নামই আছে। এখন বল, নটরডেমে যেহেতু হলো না আর কী করবো, বাসার কাছে ঢাকা কলেজ, ৫ মিনিটের হাঁটার রাস্তা। এখানেই দিয়ে দিই। কেমন হবে বল তো?
আমাদের ব্যাচে আমাদের স্কুল থেকে আমি একাই ঢাকা কলেজে চান্স পেয়েছিলাম। খবির ঢাকা কলেজে চান্স পেলো না, পেলো নটরডেমে, সে নিয়ে আজও পর্যন্ত খবিরের মনে গভীর কষ্ট, সে ঢাকা কলেজে পড়তে পারে নি।
শাহনাজের কথায় কষ্ট পাই। আমার ঢাকা কলেজ আজ আর ছাত্রদের ফার্স্ট চয়েস নয়। ঢাকা কলেজে পড়বার স্বপ্ন আজ কেউ দেখে না। যারা নটরডেমে চান্স মিস করে, তারাই তখন এরূপ পায়ে হাঁটার ৫ মিনিটের পথ ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়। যেনতেন কলেজে হয়ে গেছে ঢাকা কলেজ।
আমি কণ্ঠ ঝেড়ে বলি শাহনাজকে, দেশের সেরা কলেজ ঢাকা কলেজ, যা তোর বাসার এতো কাছে- তুই এটা রেখে নটরডেমে দিতে চাইছিলি তোর ছেলেদের?
শাহনাজ বলে, নটরডেমের মতো কি কলেজ হয়? এমন পড়ালেখা আর কোথাও নাই।
এরপর আমি শাহনাজকে বিভিন্নভাবে বোঝাবার চেষ্টা করি, আসলে ঢাকা কলেজের তুলনা হয় না। হাতি মরলেও লাখ টাকা দাম। নটরডেমের কথা কে জানতে চায়?
কিন্তু আমার সবকথাই ফাঁকা বুলি, আমি জানি। যা শাহনাজকে বললাম তা শুধু আমাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যই বলা।
সবশেষে নটরডেমে ভর্তি হতে না পারার দুঃখ নিয়েই শাহনাজের দু ছেলেকে ঢাকা কলেজে ভর্তি করানো হয়েছে।
(পরিবর্ধিত ও পুনর্মুদ্রিত)
ঢাকা কলেজ - জামান স্যার, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার ও শামীম আজাদ ম্যাডামের কথা; এবং হাবিজাবি
ঢাকা কলেজে - জামান স্যার, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার ও শামীম আজাদ ম্যাডামের কথা; এবং হাবিজাবি
ঢাকা কলেজের কথা
ঢাকা কলেজের পুরনো গৌরব কোথায় গেলো?
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:৫৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




