somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইবলিশের শয়তান হয়ে ওঠা ... শয়তানামার সমাপ্তি

২৩ শে মার্চ, ২০১০ রাত ২:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আগের পর্বে আমরা মোটা দাগে দেখেছি:
১. ওল্ডটেস্টমেন্টের সৃষ্টিতত্ত্ব বা জেনেসিস পুস্তকে সাপ হচ্ছে সেই চরিত্র, যে আদম আর হাওয়াকে জ্ঞানফল খেতে উদ্বুদ্ধ করে। সম্ভবত, আরো বহু গল্প-কাহিনীর মতোই প্রাণঘাতী সাপের সাথে মানুষের শত্রুতার সম্পর্ক ব্যাখ্যাতেই এই গল্পটি জন্ম নিয়েছিল। শয়তানের ভূমিকার কোন উল্লেখ এই পুস্তকে নেই।

২. শয়তানের ভূমিকা ওল্ডটেস্টামেন্টর প্রথমভাগে, এমনকি আইয়ুব নবীর কাহিনী পর্যন্ত আমরা পাই ঈশ্বরের স্বর্গীয় পরিষদের অভিযোগ উত্তথাপনকারী হিসাবে। ক্রমবিবর্তনশীল কৃষিজীবী গোত্র-গ্রামসমাজে এই রকম একটি চরিত্রের ভূমিকা থাকে পরিবর্তনের মুখে মানুষের আচরণকে ন্যায্যতার দিকে রাখার প্রেরণা দেয়া। কখনো কখনো বলা যায় বিবেক হিসেবে কাজ করা একটি চরিত্র। তবে জাকারিয়া পুস্ককে যে শয়তানকে আমরা পাই মহাইমাম যশুয়াকে অভিযুক্ত করছেন বিচ্যুতির বিশয়ে, সেই চরিত্রেরই আরও বিবর্তিত রূপ আমরা পাই আইয়ুব পর্বে আইয়ুবকে পরীক্ষা করার জন্য শয়তান ঈশ্বরকে উস্কে দিচ্ছে। কিন্তু নিজে মানবের পরীক্ষা নিতে শযতান তখনো নামেনি, তখনো সে স্বর্গীয় পারিষদই।

৩. ইহুদিদের সমাজে সম্পত্তিরি ব্যক্তিগত মালিকানা থাকলেও তার একটা ইগলেটেরিয়ান রূপও ছিল। কোন ইহুদিকে আদি আইনে ক্রীতদাস বানানো যেতো না, দেনার দায়ে ভূমি হাতছাড়া হয়ে গেলে সপ্তম বছরে তা আবার মালিকের কাছেই ফেরত যেত। ক্রমশ: ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য তৎপরতার বিকাশের ফলে আদিম স্থিতিপূর্ণতা বিনষ্ট হয়। একদিকে এটা সমাজ বিকাশের দ্বন্দ্ব হিসেবে ভূমিকা রাখে, ধর্মতাত্ত্বিক পুনর্গঠনেও এর ভূমিকা বিশাল।

শয়তানের আর যে সব পরিভাষা আমরা ব্যবহার করে থাকি, সেগুলোর মাঝে আছে ইবলিশ, শব্দটির উদ্ভব গ্রিক ডায়াবোলিস হতে। এ থেকে কিন্তু রোমান সাম্রাজ্যভুক্ত ইস্রায়েলের ধর্মীয় পরিগঠনে গ্রিক দর্শনের প্রভাবই অনুমান করা যায। ইহুদি-খ্রিস্টানরা শব্দটিকে বাকি আরবে জনপ্রিয় করে বলে অনুমান। অবশ্য শব্দটির আরবী উৎপত্তির সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না, সে ক্ষেত্রে এর অর্থ দাঁড়ায় যে হতাশার জন্ম দেয়।
আর একটি পরিভাষা হল আযাযিল, সে হল মরূভূমির প্রেত বা অপচ্ছায়া। স্কেপগোটরে তার প্রতিই পাঠানো হৈত। খেয়াল করুন, সে তখনো শয়তানের সাথে একাকার না, দুই জনের অবস্থান আর সন্মানও আলাদা। একজন বেচারা মরুভূমির প্রেত, অন্যজন স্বর্গীয় পারিষদ।

তো, আমরা যে ইহুদিদের নিয়ে আলাপ করছি, তাদের মাঝে কিন্তু তখনো রাজতন্ত্র আসে নাই। মহাইমাম আর যুদ্ধপতিরাই নেতৃত্ব দিতেন তাদের। আগের পর্বেই ইহুদিদের মাঝে সম্পত্তির মালিকানার সামাজিক ধরন নিয়ে যে আলাপ আমরা করেছিলাম, তাতে উল্লেখ ছিল যে, ক্রমশ এই স্থিতি ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছিল। ফলে একসময় রাজতন্ত্রের জন্মও নিল।

ইহুদীদের মাঝে রাজতন্ত্রের উদ্ভবের খুব মজার বর্ণনা পাওয়া যায় নবী স্যামুয়েলের কিতাবে। এর বর্ণনায় দেখা যায়, ইহুদীরা স্যামুয়েল নবীর কাছে আবেদন করে ফিলিস্তিনীদের মত রাজা দ্বারা শাসিত হবার আশায়! কিন্তু আদিম গোত্রীয় শাসন বরাবরই রাজতন্ত্র বিরোধী, এই কারণেই মরুচর বেদুইনরাও রাজাকে মানতে চায় না। স্যামুয়েল জনগণকে বললেন, রাজা তাদের সন্তানদের যুদ্ধে নিয়ে যাবে, নিজেদের স্বার্থে তাদের রক্তপাত ঘটাবে, আর তাদের নিযুক্ত করবে ঘোড়সওয়ারীতে কিংবা রাজার রথের পেছেন পেছনে দৌড়াবার কাজে (পদাতিক বাহিনী বা রাজার খেদমতদারিতে!মূল ভীতিটা স্পষ্ট: সম্পদের অসাম্য তো গিয়েছেই, আচরণের সাম্যও আর থাকবে না।

স্যামুয়েলের বাণী আদতে কিন্তু রাজতন্ত্র উদ্ভবের ঠিক সময়টাতে মানুষের মনে রাজতন্ত্র আর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার হরনের বিরুদ্ধ-চেতনারই বহিঃপ্রকাশ। এই চেতনার নজির আমরা আরো বহু জাতির মাঝে রাজতন্ত্র উদ্ভবের কালে দেখতে পাই গল্প, মিথ বা রূপক আকারে। গ্রিক ইতিহাসেও দেখা যাবে, ব্যক্তিগিতভাবে অনেকেই পার্সিয়ান রাজার মতো ক্ষমতাশালী হতে চাইলেই গোত্রবদ্ধ গণতান্ত্রিক চেতনা ব্যক্তির এই ক্ষমতাবান হবার বিরুদ্ধে বহুবারই শক্তদেয়াল হিসেবে কাজ করেছে। আহা, মজার গল্পটা মনে পড়ছে স্যামুয়েলের কাহিনী বলতে গিয়ে, ওই যে ব্যাঙেরা রাজা চাইল আল্লার কাছে, আল্লা পাঠিয়ে দিলেন সারস। তারপর আর কি, টপাটপ প্রজাদের গিলে চললেন সারস-রাজ।

তো, গল্পঅনুযায়ী লোকেরা যখন কিছুতেই স্যামুয়েলের বারণ না শুনে নিজেদের জন্য একজন রাজা নিযুক্তির দাবিতে অটল থাকলে স্যামুয়েল আল্লার কাছে নালিশ করেন। আবারও ইসরায়েলীদের বিরুদ্ধে প্রভুর ক্রোধ জাগ্রত হলো, আর প্রভু দাউদকে তাদের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে আদমশুমারী করতে বললেন!

আদমশুমারীর তাৎপর্য কী? রাজারা আদম শুমারী করতেন নিজেদের যুদ্ধ করার ক্ষমতা যাচাই করার জন্য, শক্তসমর্থ যুবকদের হিসাব নিকেশটা করা গেলে বাহিনী গঠনের পরিকল্পনাটা সহজ হয়। ওই আমলে আদমশুমারীর আর কোন উদ্দেশ্য ছিল না। এই কারণেই, স্যামুয়েলের ভবিষ্যতবাণীগুলোর মাঝে ইহুদীদের মাঝে রাজার আবির্ভাব ঘটলে যে খারাপ ঘটনাগুলো ঘটবে, তার অন্যতম ছিল আদমশুমারী।

এখন স্যামুয়েল পুস্তকের কাহিনী এই রকম হলেও, যেখানে ইশ্বর স্বয়ং দাউদকে উস্কে দিলেন আদমশুমারী করতে, এসবই খ্রিস্ট জন্মের হাজার খানেক বছর আগের কথা। এটা ইসরায়েল জাতির এমন একটা পর্ব, যখন গোত্রগুলোর মাঝে সংহতি প্রায় পুরোটাই বিনষ্ট, আন্তগোত্রীয় সাম্যাবস্থাও নেই। ফলে প্রতিবেশীরা, যাদের আছে রাজতন্ত্র (আদিম সাম্যের অবসানের পর রাজতন্ত্র কিন্তু নতুন সংহতি দেয়, সেই অর্থে এইটা সমাজ বিকাশে একটা অগ্রগতিও বটে!), নিয়মিতই চড়াও হতো ইসরায়েলের ওপর। (ধুরো, এই সবের সাথে শয়তানের সম্পর্ক কি!) এইটা তাই এমন সময়ও, যখন বুদ্ধিশুদ্ধিওয়ালা শক্তসমর্থ কেউ রাজা হয়ে বসছে!

ইহুদীদের প্রথম রাজা তালুত (হিব্রুতে সউল)। স্যামুয়েল পুস্তকে তাকে কিন্তু রাজা হিসেবে না উল্লেখ করে কখনও কখনো সামরিক নেতা বা নেতা হিসাবেও বলা হয়েছে। নবী দাউদ ছিলেন তারই একজন সেনাপতি। তালুতকে বাদ্যযন্ত্র শুনিয়ে শুশ্রুষা করা ছিল তার কাজ। একটা যুদ্ধে গোলাইয়াথ নামের মহাকায় ফিলিস্তিনীকে হত্যা করে তিনি নাম কামান, তালুত তার বীরত্বে ইর্ষান্বিত হলেও দাউদ ততদিনে শক্তিশালী অবস্থানে চলেও গিয়েছেন। অবশেষে তালুতের এক কন্যার সাথে পরিনয়, রাজার অমতের কারণে আরেক কন্যাকে বিবাহ... ইত্যাদি বহু ফ্যাসাদের পর তালুতের সাথে তার শত্রুতা চূড়ান্ত পর্যায়ে যায়। ফিলিস্তীনিদের সাথে এক যুদ্ধে তালুত দুই পুত্রসমেত নিহত হলে নবী স্যামুয়েল তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিষিক্ত করেন। তালুতের অবিশষ্ট পুত্রও দাউদের সহকারীদের হাতে নিহত হন, তালুতের একমাত্র জীবিত বংশধরকে অবশ্য দাউদ সুরক্ষা দেন।

প্রথম পর্যায়ে তালুত কিংবা দাউদও কিন্তু একটা বড় অংশে রাজা হিসেব নন, নেতা বা সমরপ্রধান হিসেবেই অভিহিত হচ্ছিলেন। এই দ্বিধা থেকে রাজা হিসেবে মানার বিষয়ে পুরনো গোত্রসম্পর্কের পক্ষাবলম্বীদের প্রতিরোধও কিছুটা আন্দাজ করা যায়। ইস্রায়েল আসলে তখন এমন একটা দশায়, যখন গোত্রসংহতি বিনষ্টির কারণে প্রতিবেশীদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে, আবার নতুন ক্ষমতার কেন্দ্র রাজতন্ত্র পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত তখনও না হবার কারণে যথাযথ প্রতিরোধেও সক্ষম হচ্ছে না।

দাউদ রাজা হয়ে যে সব অপরাধ করেন, এর মাঝে ওল্ডটেস্টামেন্টে উল্লেখযোগ্য হল ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যভিচার। নবী নাথান তাকে অভিশপ্ত করেন। দাউদ শান্তিতে রাজত্ব করতে পারেননি। গৃহযুদ্ধ, আপন পুত্রের বিদ্রোহ, অবমানননা তার রাজত্বকে কলঙ্কিত করেছে। রাজা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকলে যা আপনি পাওনা, তাই তার রাজত্বে প্রজাদের ক্ষোভের কারণ ঘটিয়েছে। এই ঘটনা আমরা কিন্তু খেলাফতের একটা পর্বে মুসলমানদের মাঝেও দেখবো ওসমানের আমলে। কিন্তু দাউদই শেষ পর্যন্ত ইহুদীদের মাঝে একটা রাজবংশ কায়েমে সক্ষম হন।

এসবের মাঝে শয়তান কৈ? না, শয়তান তখনও ঐশী পরিষদের অভিযোগকারীই। কিন্তু বহু পরে খ্রিস্ট জন্মের সাড়ে পাঁচশো বছর আগে ইস্রায়েলের রাজাদের কাহিনী লিখতে গিয়ে ব্যাবিলনের অধীনস্ত ইহুদিরা ধর্মতাত্ত্বিকরা একটি নতুন সঙ্কটে পড়েন। এই সংকলনের শেষ হয় পারসিক দখলদারিত্বেরও বহু পরে। ইহুদি জাতির সংহতি আর সাস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, পরাধীন মাতৃতভূমির স্বাধীনতার স্মৃতি অটুট রাখা আর জাতিকে ক্রমাগত স্মরণ করিয়ে দেয়া যে, ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করার দায়ে তাদের এই পরিনাম ঘটেছে: সহজে এই তো বুক অব ক্রনিকলস লেখার কারণ। সেইখানে এই নতুন ধর্মতাত্ত্বিক সমস্যাটার জন্ম হয়: দাউদের এই পাপের জন্য দায়ী কে?


স্যামুয়েলের কিতাবে কিন্তু আমরা তার ব্যক্তিগত অপরাধেরই বর্ণনা পাই, দাউদ ব্যভিচার করেছেন। আরেক স্থলে পাই, প্রভু তার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে উস্কানি দিচ্ছেন আদমশুমারী করার জন্য (রক্তপাত আর যুদ্ধ ডেকে আনার জন্য!)।
প্রভু স্বয়ং?

তাহলে কি পাপের দায় প্রভুর ওপর বর্তায়?

দাউদ প্রতীক মাত্র, আদতে বনি ইসরায়েলই তো অপরাধী, তালুত নিজেও ঈশ্বরের নাফরমানি করেন, গোটা জাতিই তখন নাফরমানিতে লিপ্ত। এমনকি নবী আর ধর্মনেতাদের ক্ষমতা আর সম্পদলোভের বর্ণনাও একেবারে নেই তা নয়। বহুপরে যখন এসবেরই কাহিনী লেখা হবে পুনর্বার, তখন ঈশ্বরকে পাপের কালিমা থেকে মুক্তি দেয়ার জন্যই শয়তানের আরেক দফা বিবর্তন হল। সেই দাউদকে উস্কানি দিল আদমশুমারী করার জন্য। এইবার শয়তানকে আমরা নতুন একটা ভূমিকায় পাচ্ছি, যেখানে সে মানুষের পাপের জন্য দায়ী, সরাসরি ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরোধিতা করায় মদদদাতা একটি চরিত্র।
বুক অব ক্রনিকলসে এইবার ঘটনাটাকে নতুন করে লেখা হল: শয়তান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে উদ্যত হল, আর দাউদকে আদমশুমারীতে উস্কে দিল!

এই ভাবে আমরা প্রথম পেলাম কারও ব্যক্তিগত পাপের জন্য (ঈশ্বরের ইচ্ছার বদলে) শয়তানের ভূমিকা। এই উল্লেখ এর আগে নাই।
এই ঘটনাটাকেই স্যামুয়েল নবীর কাহিনীতে আরও ৫০০ বছর আগে লেখা হয়েছিল: আবার ইসরায়েলের প্রতি ঈশ্বরের ক্রোধ জেগে উঠল, আর তিনি দাউদকে তাদের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে বললেন, যাও, ইসরায়েলের মানুষের শুমারী কর।

দুই গ্রন্থে পাঠের এই পরিমার্জন কেউ সচেতন ভাবে করেছেন, তা নাও হতে পারে। সময়ের পার্থক্যটা কয়েকশত বছরের। এর মাঝে বিরাট রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে ইসরায়েলে। বিদেশী শাসকরা ইহুদিদের অনেকগুলো গোত্র সমেত বিদেশে নির্বাসন দিয়েছে, একের পর এক শাসকও পাল্টেছে। খুবই সম্ভব, প্রথমে এই বদলটা হয়েছে জনপ্রিয় ভাষ্যে, বহু আখ্যান-উপআখ্যান আর কাহিনী যেমন তৈরি হয় সাধারণ মানুষের ক্ষুধা আর প্রশ্নকে নিবারণের জন্য। পরে তা গ্রন্থবদ্ধ হয়। উচ্চাঙ্গের রাগের সূত্রপাত নাকি যেমন সাধারণ মানুষেরই মাঝে, মহান সঙ্গীতজ্ঞরা তাকে পরিমার্জন করে দরবারে তোলেন, এই সব কাহিনী আর ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও অধিকাংশ সময়ে তাই ঘটে। একক কোন ব্যক্তির অসদুদ্দেশ্যে এটা করা বলে মনে হবার সম্ভাবনা খুবই কম।

কিন্তু শয়তান কেন মানুষকে এই মন্ত্রণা দেবে? তার কি স্বার্থ? এমনকি শয়তান তখনও কিন্তু আদম আর হাওয়াকে প্ররোচিত করে নাই!

আরো বহু পরের লাইফ অব অ্যাডাম অ্যান্ড ইভ পুস্তকে, যেটিও রচিত, পরিমার্জিত ও সংশোধিত হয়েছে কয়েকশ’ বছর ধরে, কয়কেটি ভাষায়ও, আমরা পাই শয়তানকেই ওই আদিপাপের প্ররাচকের ভূমিকায়। সেই সাপকে বলল আদম আর হাওয়াকে স্বর্গোদ্যান খেকে বিতারিত করার কাজটি করতে, কারণ আদমকে সেজদা না করার অপরাধে প্রভু তাকে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করেছেন।

গল্পের চক্র পূর্ণ হল।

শয়তান এইবার তার ঐতিহাসিক ভূমিকা খুঁজে পেল, মানবজাতির সাথে তার চিরায়ত দ্ব্ন্দ্বর একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা অবশেষে পাওয়া গেল।

কিন্তু ছোটখাট কিছু জটিলতা যে থাকল না, নয়। ইহুদী পুরানে শয়তান নিজে একজন ফেরেশতা। জেনেসিস পুস্তকে বিদ্রোহী ফেরেশতারা মানব নারীদের গর্ভবতী করার কারণে পৃথিবী পাপে পূর্ণ হয়েছিল বলেই ঈশ্বর একবার তাদের শাস্তি দিয়েছিলেন। শয়তান কিন্তু সেই তালিকায় ছিল না। শয়তানের এই ফেরেশতা পরিচয়টা একটা জটিলতা তৈরি করে, কারণ পরবর্তীতে ফেরেশতাদের বিদ্রোহের আর কোন সংবাদও পাওয়া যায় না। ইসলামে এই সমস্যাটার একটা সমাধান হলো ফেরেশতার বদলে তার জীন পরিচয়ে। জীনদের একবার সবংশে নির্মূল করে ইবলিশ নামের জিনের বাচ্চাকে নিয়ে আসা হয়েছিল স্বর্গে, সেইখানে সে ইবাদত-বন্দেগীতে আর সবাই কে হার মানিয়ে নেতৃত্বের আসনে চলে গিয়েছিল। জীনরাও যেহেতু ইসলামের ধর্মতত্ত্বে স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী, তাই তার পক্ষে ভালমন্দ বিচার করা সম্ভব, বিদ্রোহ করাও সম্ভব। এইখানে ফেরেশতারা রোবট(নানা)স্বরূপ। তাদের স্বাধীন ইচ্ছা নাই।

ইসলামের আবির্ভাবের আগেই আদতে ইহুদী আর খ্রিস্টান ধর্মের তর্ক, বাদ প্রতিবাদ, উপদলীয় কোন্দল ইত্যাদির কারণে শয়তান ইতিমধ্যেই একটা তাত্ত্বিকভাবে বিকশিত পর্যায়ে ছিল। ইহুদী ধর্মের আদি পর্বে যেহেতু কোন পুনরুত্থান ছিল না, পাপের শাস্তি ইহকালেই হতো, শযতানের ভূমিকার প্রয়োজনও ছিল খুবই কম। আমরা দেখলাম, আইয়ুব নবীর বেলায় আল্লাকে উস্কানো ছাড়া তার তেমন ভূমিকা ছিল না। শয়তানের দ্বিতীয় বিবর্তন আমরা দেখলাম বুক অব ক্রনিকলসে, সেই খানে সেই ইসরায়লী রাজাদের উস্কাচ্ছে পাপের পথে। এইখানেও কিন্ত শয়তান আদিপাপের জন্য দায়ী না। শয়তানের তৃতীয় পর্যায় আমরা দেখলাম লাইফ অব অ্যাডম অ্যান্ড ইভে, এইখানে সেই আদিপাপের জন্য দায়ী। ইহুদী ধর্মে পরকাল বা শেষ বিচার নাই, কিন্তু খ্রিষ্টানধর্মের আদিতে এইটা কম গূরুত্ব নিয়ে থাকলেও পরবর্তী ধর্মতাত্ত্বিকরা পরকাল, স্বর্গ-নরক ভাবনাকে আরো গুছিয়ে আনেন, শয়তানের তাই নরকে নেয়ার ক্ষেত্রে গূরুত্ব বৃদ্ধি হয়। ইসলামী পর্বে আমরা দেখলাম শেষ বিচার ধর্মতত্ত্বের প্রথম থেকেই খুব গূরুত্বপূর্ণ। মানুষকে অপরাধের জন্য উস্কে দেয়া ইবলিশ শযতানের নাম তাই কোরআনে বিশেষ গূরুত্ব দিয়ে আলোচিত হযেছে, কোরাআন সূত্রে দেখলাম প্রায় শ’ খানেক বার।

হুম। এই হল সহি আসল ইবলিশনামা কাহিনীর সমাপ্তি। ফাঁক ফোকর যা আছে, তার দায় আমাদের বন্ধু কাজীর। অনেক ছোট ছোট গর্ত সে পূরন করতে পারে নাই, ফলে ইতিহাসের অস্বস্তি না থাকলেও কার্যকারণের অস্বস্তি থাইকা যায়।





৪২টি মন্তব্য ৩৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। কালবৈশাখী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৪



গত পরশু এমনটি ঘটেছিল , আজও ঘটলো । ৩৮ / ৩৯ সে, গরমে পুড়ে বিকেলে হটাৎ কালবৈশাখী রুদ্র বেশে হানা দিল । খুশি হলাম বেদম । রূপনগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

আমরা সবাই জানি, ইরানের সাথে ইজরায়েলের সম্পর্ক সাপে নেউলে বললেও কম বলা হবে। ইরান ইজরায়েলকে দুচোখে দেখতে পারেনা, এবং ওর ক্ষমতা থাকলে সে আজই এর অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়।
ইজরায়েল ভাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

নগ্ন রাজা কর্তৃক LGBTQ নামক লজ্জা নিবারনকারী গাছের পাতা আবিষ্কার

লিখেছেন মুহাম্মদ মামুনূর রশীদ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪০

LGBTQ কমিউনিটি নিয়ে বা এর নরমালাইজেশনের বিরুদ্ধে শোরগোল যারা তুলছেন, তারা যে হিপোক্রেট নন, তার কি নিশ্চয়তা? কয়েক দশক ধরে গোটা সমাজটাই তো অধঃপতনে। পরিস্থিতি এখন এরকম যে "সর্বাঙ্গে ব্যথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×