কখনো আকাশ বেয়ে চুপ করে, যদি নেমে আসে ভালোবাসা খুব ভোরে
চোখভাঙ্গা ঘুমে তুমি খোঁজ না আমায়, আশেপাশে আমি আর নেই।
ভোর হয়েছে সবে। খুব শান্ত একটা অনুভূতি চারপাশ মিলিয়ে। রাস্তার পাশের নিয়মিত গাড়ি চলাচল, লোকজনের কোলাহল ছেড়ে চুপচাপ পরিবেশ। আর আজ তো এমনিতেই ছুটির দিন, মানুষ জনের ব্যস্ততারও শুরু হওয়ার তেমন ব্যস্ততা নেই। জানালাগুলোতে দুই পরতের ভারি পর্দা দেয়ার কারণে ঘরের মাঝে তেমন কোন আলো ঢুকছে না, কিন্তু ঈশাণের দীর্ঘদিনের অভ্যাস থেকে ঠিক এই সময়টাতেই ঘুম ভেঙ্গে যায়। তবে আজ তো ছুটির দিন, তাই ঘুম ভেঙ্গেই যে ঝটপট উঠে পড়তে হবে, এমন কোন কথা নেই। ঘুম ভাঙলেও ঈশাণ চোখই খুলল না, বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকল। তারপর আস্তে আস্তে চোখ মেলল। কিন্তু সোজা সামনে তাকালো না, বিছানার সামনেই ড্রেসিং টেবিল রাখা, আর ঘুম ভেঙ্গেই ঈশাণের নিজেকে দেখতে মোটেও ভাল লাগে না। ও একটু পাশ ফিরে কথা’র দিকে তাকালো। প্রশান্ত মুখে ঘুমিয়ে আছে, ঠোঁটের কোণে খুব হালকা একটা হাসির রেখা ফুটে আছে, যেন খুব মজার কিছু দেখছে স্বপ্নে। আরও মজার ব্যাপার হলো, কথা’র কখনোই এরকম কিছু মনে থাকে না, জিজ্ঞেস করলেই বলে, “হ্যাঁ..... আন্দাজে”। যাই হোক, সকালে ঘুম থেকে উঠে এমন দৃশ্য দেখলে এমনিতেই মন ভালো হয়ে যায়। এরকম আবছায়া হাসি দেখে ঈশাণের অবশ্য একটু লোভ হলো, কিন্তু নিজেই নিজেকে চোখ রাঙ্গালো, না...বাসি মুখে অমৃতের স্বাদ নিতে হয় না। এক গোছা চুল এসে পড়েছে কথা’র কপালে, আলতো হাতে সেগুলো সরিয়ে ঈশাণ গালে একটু হাত রাখল কথা’র। তারপর নামল বিছানা থেকে।
ফ্রেশ হয়ে রুমে ফিরে ঈশাণ জানালার কাছে দাঁড়ালো। রোদ ওঠেনি, একটা ধূসর আলো চারদিকে। হঠাৎ করে দেখলে ভোর না বিকেল বুঝতে পারা কঠিন হয়ে যাবে। রাস্তায় বেশ ভালোই ধূলো উড়ছে, মোড়ের কাছটায় এসে একটা ঘূর্ণির মতোও হচ্ছে। বসন্ত শুরু হতে যাচ্ছে মাত্র, এই সময়টা খুবই রোমান্টিক, প্রকৃতি আদর দিয়ে এমনিতেই মন ভালো করে দেয়। না ঠান্ডা, না গরম, আবার মাঝে মাঝে চমৎকার বাতাস এসে এমনকি মনের ক্লান্তিও দূর করে দেয়। রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনেক স্মৃতি হঠাৎ ভিড় করে আসে একসাথে। কিন্তু এগুলো এখন ঈশাণ মনে করতে চায় না, ছুটির দিন, সম্পূর্ণ ছুটি, যদিও আরেকটু পরই এই স্বাধীনতা আর থাকবে না, কথা ঘুম থেকে ওঠা মাত্র। ঈশাণের মতো মানুষ কমই পাওয়া যাবে, যে এরকম উন্মুখ থাকে স্বাধীনতা হারানোর জন্য। তবে যে কি না এরকম স্বাধীনতাহীনতায় থাকেনি, সে এর রহস্যও বুঝবে না।
আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ঈশাণ বিছানার দিকে, আর বেশিক্ষণ একা থাকতে ভালো লাগছে না, উঠানো দরকার কথাকে ঘুম থেকে। এই ঘুম থেকে উঠানোর ব্যাপারটা অনেক পছন্দ ওর। ঈশাণ ওর বালিশটা একটু টেনে নামিয়ে বিছানার মাঝামাঝি নিয়ে এলো, এবার আস্তে করে শুয়ে কথার বুকের মাঝে ঢুকে পড়ল। প্রথম প্রথম কথা চমকে উঠতো ঘুমের মাঝে, কারণ সবসময় একা ঘুমানোর অভ্যাস ছোটবেলা থেকে। এখন অবশ্য জানে, যে এই বড় বাচ্চাটার এরকম পাগলামির রোগ আছে। তাই ঘুম ভেঙ্গেই চমকে উঠে না। ঈশাণ শুয়েই বুক ভরে শ্বাস নিল, কথার গায়ের একটা ঘ্রাণ আছে, একদম ওর নিজস্ব, কোন পারফিউম বা অন্য কিছুর না। এটা ঈশাণ অনেক পছন্দ করে। আর এই আশ্রয়টা ওকে সবসময় সত্যিকার অর্থেই আশ্রয় দেয়। যতই কাজের চাপ, বা অন্য কোন দুঃশ্চিন্তা থাকুক, ঈশাণ এখানে থাকলেই সবকিছু ভুলে যেতে পারে, কথার নাইটির সিল্কে আরেকটু চেপে ধরল নাক।
ঘুম ভেঙ্গেছে কথার, ঈশাণকে বুকের মধ্যে দেখে ছোট্ট করে একটু হাসলো, আরেকটু কাছে টেনে নিল, নিয়ে বলল, “কি হয়েছে বাবা, ঘুম ভেঙ্গে গেল?” ঘুম ভেঙ্গেই এই যে কথাটা বলে কথা, তার মাঝে একই সাথে অপত্য স্নেহ আর অসীম আশ্রয় খুঁজে পায় ঈশাণ, আর থাকে মায়া। এই মায়াবতীকে এজন্যই ঈশাণ এত ভালোবাসে। মেয়েটা মায়া দিয়েই ঘিরে রেখেছে ওকে। ঘুম ভেঙ্গেই হঠাৎ কিছু বলতে পারে না কথা ঠিকঠাক, এই যে কথাটা, খুব অস্পষ্ট বলে, বাবা বলে না বাবু বলে, তাও ঠিকঠাক বোঝা যায় না, কিন্তু এই বলার সুরে যে ভালোবাসা থাকে, তা ঠিকই বোঝা যায়, আর কিছুর তো দরকার নেই। আর ঘুম থেকে ওঠার পরপরই কথার গলার স্বরটা একটু ভাঙ্গা ভাঙ্গা থাকে, সেটাও ঈশাণের অনেক পছন্দ। ও মুখটা একটু ঘষে কথার বুকে, ওম নেয়, তারপর বলল, “না, আর ঘুমাতে পারছিনা, অনেক ঘুমিয়েছি।“
“আচ্ছা, আমি আরেকটু ঘুমাই?” যদিও কথা জানে এর উত্তর কি হবে, ঈশণের ছোট্ট একটা চিৎকার, এবং তাই এলো, “নাআআআআআ....ওঠো এবার, অনেক সকাল হয়েছে”। বলেই উঠে পড়ল এরকম ভান করলো ঈশাণ, কারণ, জানে এরপর কি হবে। কথা ওকে আরেকটু জড়িয়ে ধরল, “আচ্ছা, উঠব তো, আরেকটু থাকো না।“ এটার জন্যই অপেক্ষা করছিল ঈশাণ, ভাবটা এমন যে ওতো উঠেই পড়তো, নেহায়েৎ কথা বললো, তাই থাকলো আরও কিছুক্ষণ ওর বুকের মাঝে।
কিছুক্ষণ পর আসলেই ক্ষিধে পেল, এবার উঠতেই হয়। কথা ছুটির দিনগুলোতে একদম উঠতে পারে না তাড়াতাড়ি, সারা সপ্তাহ অফিস করে যে দুই দিন ছুটি পায়, এ ক’দিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে চায় না একদমই। আর ঈশাণও জোর করে না কখনো, ওর কোন অসুবিধা নেই এটুকুতে....নেহায়েত যেদিন বেশি আলসেমি লাগে, সেদিন বাইরে থেকে নিয়ে আসে পরাটা আর ডিমভাজি। কিন্তু বেশিরভাগ ছুটির দিনগুলোতে ও নিজেই তৈরি করে নেয়, এমন কিছু কঠিন ব্যাপারও না। পরাটা তো রেডি করাই থাকে ফ্রিজে, যেদিন কথা সময় পায়, একসাথে অনেকগুলো বানিয়ে হাল্কা গরম করে রেখে দেয়, পরে শুধু তেল দিয়ে ভেজে নিলেই চলে। আর ডিমভাজি তো কোন ব্যাপারই না। তবে সবার আগে চা বানিয়ে আনতে হবে, নাহলে কথাকে উঠানো যাবে না। ঈশাণ উঠে চা এর পানি গরম দিল কেটলিতে, তারপর আবার বেডরুমে চলে এল। কথা তখনো চোখ বুজে আছে। ঈশাণ কাছে এসে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে সাদা বালিশে, ঘরে এসি চলছে বলে একটা হালকা গুঞ্জন আছে, তাই কথা টের পেল না ঈশাণের উপস্থিতি। ঈশাণ এগিয়ে এসে কথার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো, তারপর দুই চোখের পাতায়, তারপর নাকের উপর, দিয়ে থেমে গেল। এবার কথা একটু মুচকি হেসে চোখ খুলে বলে, “তারপর?” ঈশাণ চোখ পাকিয়ে বলে, “তারপর কিছু না, যা মুখ ধুয়ে আয়।“
“না না, যা করছিলে, তারপরের টা করো। আরে করো করো, কোন অসুবিধা নেই।“
“হুম, আমি জানি তোমার অসুবিধা নেই, ওঠো ওঠো, অনেক সকাল হয়ে গিয়েছে।“
“আচ্ছা বাবা, উঠছি, একদম অস্থির হয়ে যায়”, এখানেও সমস্যা, কথা একবারে উঠতে পারে না বিছানা ছেড়ে, প্রথমে উপুড় হয়ে বসে, তারপর নানা কসরত করে আড়মোড়া ভাঙে, তারপর মহারাণীর পা মাটিতে পড়ে। আর এই সময়টা ঈশাণ মজা নিয়ে দেখে, বলে, “কার্টুন একটা।“
“কেন? কি হলো?” আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতেই বলে কথা।
“কিছু হয়নি, একটা কার্টুন বিয়ে করেছি, তাই ফ্রি ফ্রি কার্টুন দেখে নিচ্ছি।“ ঈশাণের জবাব।
কথা ফ্রেশ হতে বাথরুম চলে গেলে ঈশাণ কিচেনে চলে এল। পানি গরম হয়ে কেটলি ইতোমধ্যে আওয়াজ দিচ্ছে। দুইটা কাপ নিয়ে ঈশাণ চিনি দেয় কাপে, ওর নিজের চা খাওয়া নিয়ে অভ্যাস নেই, কথাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য ধরে থাকতে হয় আর কি। কি যে পাগলি মেয়েটা, মাঝে মাঝেই উদ্ভট সব কাজ করে বসে। ও একা চা খাবে না, ঈশাণ বানিয়ে দিলেও না, ওকেও চা খেতে হবে কথা’র সাথে। কেটলি থেকে পানি ঢালছে কাপে, এর মাঝেই পিঠে নরম একটা অনুভূতি পেল ও, দুটো পেলব হাত পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো ঈশাণকে, কথার গায়ের ঘ্রাণ পেল ঈশাণ। এইবার.....অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে আছে ঈশাণ এটার জন্য। ঘুরে দাঁড়িয়ে আলতো করে কোমর জড়িয়ে ধরল কথার, টান দিয়ে ওকে বুকের সাথে লাগালো, “অবশেষে, উঠলেন শেষ পর্যন্ত”।
“হুম, উঠতেই হলো, না উঠিয়ে আর ছাড়লে কই।“ ঠোঁট উল্টে বলে কথা।
“এখনই বা ছাড়ছি কই, ধরেই তো আছি।“
“সে তো তুমি একটু দস্যি আছই।“
ঈশাণ আরেক হাত দিয়ে কথার গাল ছুঁয়ে ওখান থেকে চুলগুলো নিয়ে কানের পিছনে আটকে দিল, “ও, এখন আমার দোষ, তাই না? আর নিজে যে এসে এভাবে ধরলে, তাতে কিছু না?”
“কিভাবে ধরেছি?” খুব আহ্লাদ করে বলে কখা।
আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে ঈশাণ কথাকে, একদম বুকের সাথে মিশিয়ে, “এই তো, এইভাবে।”
এবার, সেই সকাল থেকে অপেক্ষা করে করে, এখন সুযোগ পেল। ছোট্ট করে একটু আদর করলো কথার ঠোঁটে, “ব্যাস? হয়ে গেল?” কথা দুষ্টুমি করে জিজ্ঞেস করে।
“তাই কি হয়?” ঈশাণ একটু তাকায় কথার দিকে, কথা পুরো শরীরের ওজন ছেড়ে দিয়ে আছে ঈশাণের হাতে, এখনো ঘুম লেগে আছে চোখে, ঠোঁট দুটো একটু খুলে আছে, মুক্তোর মতো দাঁত দেখা যাচ্ছে ভিতরে, ঈশাণ এবার পুরোটার স্বাদ নিতে চায়, ওর ঠোঁট মিশে গেল কথার ঠোঁটে, প্রথম একটু সময় কথা চুপচাপ আদরটা নিল, তারপর নিজেও অংশ নিল, আদর দিল। বেশ কিছুক্ষণ পর কথা বলে উঠল, “উফ, আস্তে, একদম.....রাক্ষস একটা”। হো হো করে হেসে ওঠে ঈশাণ, “এরকম ঠোঁট থাকলে দোষ তোমার, আমাকে দোষ দিয়ে লাভ কি, ভাল খাবার সামনে দেখেও আমি হাত গুটিয়ে থাকব, এতটা ভদ্রলোক নাকি আমি?”
চোখ পাকিয়ে তাকায় কথা, “কি কথার শ্রী। এরকম করে বলে কেউ, আমি কি খাবার নাকি? দিব ধরে মাইর”।
“কথার শ্রী তো ভালোই আছে, ওভারঅল দেখতে তো খারাপ না তুমি, হি হি,” বলে এক ঝটকায় দু’ হাত দিয়ে কোলে তুলে নেয় কথাকে।
“এই, কি করছ?” চমকে ওঠে কথা।“আর আমি ওভারঅল দেখতে ভালো, তা..ই না? তোকে তো....”
“কিছু না, তোমাকে রুমে দিয়ে আসি, তুমি এখানে থাকলে পানি ঠান্ডা হয়ে যাবে আরও, চা আর বানানো হবে না”, ঈশাণ হাঁটতে হাঁটতে বলে। “আমাকে তো কি?”
আরেকটা চুমু দেয় কথা ঈশানের গালে, “তোকে তো এই, আর কিছু না। আর তুমিই যে গরম আছো, তাতে পানিও গরম লাগবে?” কথা একহাত দিয়ে গলা জড়িয়ে থাকে ঈশাণের, একটা কান টেনে দেয়।
“ওই, এইগুলা কি!” ঈশাণ কপাল কুঁচকে বলে, ভাণ করা বিরক্তি, এটাও কথা জানে।
কথাকে বেডরুমের বিছানায় নামিয়ে দিয়ে ঈশাণ আবার কিচেনে ফিরে আসে, চা বানিয়ে দুই কাপ নিয়ে আবার চলে আসে রুমে। কথা গান ছেড়েছে হাল্কা করে সিডি প্লেয়ারে, “ভালবাসি, ভালবাসি, এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়, বাজায় বাঁশি ভালবাসি, ভালবাসি”। এই আকুলতা হৃদয়ে থাকলেও সবসময় মুখে প্রকাশ করা যায় না, তখন গান অনেক উপকারি, একটা পরিবেশ তৈরি করে দেয়ার জন্য।
“নাও, চা খাও, ক্ষিধে পেয়েছে অনেক, নাস্তা রেডি করতে হবে”। ঈশাণ বলে। বিয়ের পর পর অনেক মজা হতো, এতদিন পর এখন আর সেই নতুন নতুন আবিষ্কারের মজাটা নেই, কিন্তু এখন একটা অন্য মজা, নির্ভরতার, পরস্পরকে চিনতে পারার, কথা না বলেই অনেক কথা বলে ফেলার, নীরবতা থেকেই অনেক অনুভূতি বুঝতে পারার। যেমন ঈশাণের যখন অনেক মন খারাপ হয় কোন কারণে, ও চুপচাপ এসে জড়িয়ে ধরে কথাকে, কথাকে বলতে হয় না যে ওর মন খারাপ, কথা নিজেই বুঝে নেয়, আবার যখন এমনিতেই কথাকে ধরে থাকতে ইচ্ছে হয়, তখনো ও নিজেই বুঝে নেয়, এই ব্যাপার গুলোই সময়ের পুরস্কার।
চা শেষ করে কথা কাপ দুটো নেয়, “চলো, আসো আমার সাথে, আমি নাস্তা বানাবো, তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে ওখানে”।
“হুম, চলো, আসছি আমি।“ ঈশাণ শুয়ে পড়ে বিছানায়।
“উহু, আমার সাথেই চলো, তোমাকে চেনা আছে আমার......আসো”। কথা হাত ধরে টান দিল ঈশাণের।
“আচ্ছা বাবা, আসছি, চলো, দাও, একটা কাপ হাতে দাও”।
“একটা কেন, দুইটায় নাও, নিয়ে, আসো পিছন পিছন”, কথার গলায় কড়া আওয়াজ।
“বাপ রে, একদম....হুম, দাও, চলো”। অগত্যা, যেতেই হলো কিচেনে।
কথা ফ্রিজ থেকে পরাটা বের করলো, ঈশাণ কাপগুলো ধুয়ে রাখল। ধুয়ে পিছনে ঘুরেই দেখে কথা হাতে দুইটা পিঁয়াজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, “এই নাও, শিগগির পিঁয়াজ দুটো কেটে দাও। ডিমভাজিতে লাগবে”।
ঈশাণ মুচকি হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে নিল ওগুলো, তারপর ছুলে নিয়ে, ধুয়ে নিয়ে চপার প্লেটে নিয়ে ছুরি দিয়ে কাটতে লাগল। এই পিঁয়াজ কাটার কাজটা ঈশাণ খুব ভালো পারে। ওদের কিচেনটা দুই ভাগে ভাগ করা। করিডোর থেকে ঢুকে একটা রুম, সেখানে ফ্রিজ, কিচেন ক্যাবিনেট, বেসিন, থালা-বাসন রাখার র্যােক, ওভেন এগুলো, আর তার পাশেই আরেকটা ছোট পার্ট আছে, যেটা আসলে স্টোররুম হিসেবে থাকার কথা, কিন্তু কথা এখানে চুলো বসিয়েছে, তার পাশেই ডাবল বেসিন আরেকটা, এখানে থালা-বাসন ধোয়া হয়। কথা এখন সেখানে, চুলাতে তাওয়া দিয়ে পরাটা ভাজছে। পিঁয়াজ কাটা শেষ করে, ঈশাণ দুইটা ডিম বের করল ফ্রিজ থেকে, বের করে কথার ওখানে গেল। বেচারি এইটুকু সময়েই ঘেমে গিয়েছে অল্প। ডিম আর পিঁয়াজ একপাশে রেখে ঈশাণ কথার ঠিক পিছনে দাঁড়ালো, একটা হাত বাড়িয়ে ওর কোমর জড়িয়ে ধরল, আরেক হাতে কাঁধের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে মাথা নিচু করে ঠোঁট ছোঁয়ালো। “কতদূর হলো?” কথা এক হাতে খুন্তি ধরে আরেক হাত পিছনে দিয়ে ঈশাণের চুল একটু এলোমেলো করে দেয়, “এই তো, হয়ে গিয়েছে, তুমি ডিম দুইটা রেডি করে ফেল, ভেজে ফেলি”। পিঁয়াজ, লবণ, কাঁচামরিচ মাখিয়ে, ডিম ফেটে দিল, কথাকে সরিয়ে ঈশাণ নিজেই ভাজল ডিম, এর মাঝে বাকি সব ডাইনিং রুমে নিয়ে এল কথা। দু’জনে বসে নাস্তা করল, যদিও কথা এত সকালে উঠে খেতে পারত না আগে, কিন্তু ঈশাণ একা খেতে পারে না, আর সকালেই ওর অনেক ক্ষিধে পেয়ে যায়, তাই অল্প হলেও নাস্তা করে কথা ওর সাথে।
“ওহহো, জুসের প্যাকেট টা তো আনা হয়নি ফ্রিজ থেকে, দাঁড়াও, নিয়ে আসি”, ঈশাণ উঠে গিয়ে নিয়ে আসে ফ্রিজ খুলে। “একবারে আনতে পারোনি কিসের জন্যে?” কথা ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে।
“আরে তুমিই তো সব নিয়ে আসলে, আমি তো শুধু ডিমভাজিটা নিয়ে এলাম, তোমারই না আনার কথা”, ঈশাণ বলে ওঠে।
“ও..তাই!! আচ্ছা, তো ভুলে গিয়েছি, চ..রি!” কথার গলায় আবারও আহ্লাদ। “ভুল হতে পারে না মানুষের!”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই পারে, নিজের বেলায় ভুল হতেই পারে, আর আমার বেলায় ধমক?” ঈশাণ কৌতুক করে বলে।
“আমি ধমক কই দিলাম, ওতো এমনি একটু বললাম আরকি”।
“জ্বি, তোমার ঐ এমনি একটু বলা....জানা আছে আমার, নাও এবার ওঠো, আজ তো বের হওয়ার কথা আমাদের”। মনে করিয়ে দেয় ঈশাণ।
“কোথায় বের হওয়ার কথা? আজ তো আমার বের হতে একদম ইচ্ছে করছে না, আজ সারাদিন ঘুমাবো তো”। কথার কন্ঠে আবার আলস্য।
“সে চলো, বের হলেই তো দেখতেই পাবে কই যাই। আরে সব আগে থেকেই বলে দিলে বের হয়ে আর কই যাবে”।
“না, শুনো না, আজ না বের হতে ইচ্ছে করছে না, বুঝেছি তো, লাঞ্চই তো করাবে বড়জোর, তো এত আগে বের হয়ে লাভ কি, লাঞ্চ এর আগে আগে বের হলেই তো হয়”।
“আচ্ছা, ঠিক আছে, তাহলে এক কাজ করি, লাঞ্চ বাসাতেই করি, কিন্তু এখন একটু বাজার করতে হবে তো, চাল শেষ, পিঁয়াজ, কাঁচামরিচ আর রসুন আনতে হবে, সাথে টুথপেস্ট, আর তোমার শ্যাম্পু আনতে হবে। এগুলো আনার সময় লাঞ্চ কিনে নিয়ে ঢুকবো একবারে, ঠিক আছে?” বিশাল লিস্ট দিল ঈশাণ, চেক করেছে একটু আগে রান্নাঘরে।
“আচ্ছা, ঠিক আছে, কিন্তু বাইরে খেতে পারলেই ভালো হতো, ঘরের মধ্যে খেয়ে আর কি মজা, আরও তো প্লেট ধোয়ার ঝামেলা। ও হ্যা, আমার লোশনও তো শেষ হয়ে গিয়েছে, ওটাও আনতে হবে”।
“আচ্ছা, সে দেখা যাবে, ঝামেলা তোমারই বাড়বে, রেডি হতে হবে আবার ভালো করে, তার চেয়ে চলো এখন শপিং করে আসি আগে, তারপর দেখা যাক”।
“এহ, আমি যাব না এখন মোটেও, আমি এখন আবার শোব, এমনিতেই আগে উঠিয়েছ তুমি, ছুটির দিনেও শান্তি নেই”। কথার জোরালো প্রতিবাদ।
“না, প্লিজ চলো, আমার একা যেতে একদম ভালো লাগছে না, এই তো ফ্যামিলি নীডস যাবো, তুমি উপরের সেকশনে গিয়ে ওগুলো কিনলে, আমি নিচে চাল, পিঁয়াজ এগুলো নিলাম, বেশিক্ষণ লাগবে না, হাফ এ্যান আওয়ার, প্লিজ প্লিজ প্লিজ প্লিজ প্লিজ প্লিজ প্লিজ প্লিজ”।
“আচ্ছা থাক, হয়েছে, বুঝেছি, ছাড়বে না তো, ঠিক আছে, আমি ঝটপট রেডি হয়ে নিচ্ছি, চলো তাড়াতাড়ি।“
দু’জনে রেডি হয়ে বের হলো ঝটপট, কথা একটু বিমর্ষ, ওর একদম ইচ্ছে করছিল না বের হতে, কিন্তু ঈশাণ বুঝতে চায় না সবসময়, একটু গাধা টাইপ আছে, কিন্তু একটা মায়া চলে এসেছে কেমন, তাই এগুলো নিয়ে কথা এখন আর রাগ করে না তেমন।
লিফটে উঠতে যাবে ওরা, এই সময় হঠাৎ ঈশাণ বলে উঠল, “আরে আমি তো মানিব্যাগ আনিনি, উফ,” বলে কথার দিকে ফেরে, দেখতেই পাচ্ছে কথা চরম বিরক্ত, “একটা কাজও ঠিকঠাক করতে পারো না, এইটা ভুলে গেলে কি করে!”
“আচ্ছা থাক, তুমি নামো লিফটে, আমি জাস্ট মানিব্যাগটা নিয়েই ফিরছি, গাড়ির চাবিটা নিয়ে যাও, স্টার্ট করো, আমি এই আসছি”। বলে ঈশাণ চাবিটা দিয়েই চম্পট, কারণ এর মধ্যেই কথার কপাল কুঁচকে গিয়েছে পুরো। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে ঢুকে পড়লো বাসায়।
কথা প্রচন্ড বিরক্ত, এমনিতেই যেতে ইচ্ছে করছিল না, তার মাঝে আবার এই ঢং ঈশাণের, কোন কাজ গুছিয়ে করতে পারে না, কিছু না কিছু বাগড়া বাজাবেই। লিফটে উঠে গ্রাউন্ড ফ্লোরের বোতাম চাপলো। লিফট নিচে পৌঁছলে বের হয়ে গাড়ির চাবিটা হাতে নিল, গাড়ি আনলক করার জন্য। কি ব্যাপার, গাড়িতে নতুন লক বসিয়েছে নাকি ঈশাণ, এটা তো আগের রিমোটটা না, নিশ্চয় আবার নষ্ট করে ফেলেছে, ঝাড়ি খাবে, তাই জানায়নি। কতগুলো টাকা নষ্ট হলো আবার, কথার মেজাজ তো চরম খারাপ হলো। নামুক নিচে, ভেবেছিল নিশ্চয় কথা টের পাবে না। ওদের গাড়ির কাছে এলো কথা, দারোয়ান লোকটা এগিয়ে এসে সালাম দিল, অকারণে দাঁত বের করে রেখেছে, যেন খুব হাসি পাচ্ছে তার, ভদ্রতা করে একটু হেসে সালামের উত্তর দিল কথা। কিন্তু কপাল সোজা হলো না, এই গাড়িটা ওর একদম পছন্দ না, শুধু চলার জন্য চলা, ঢাকাতে গাড়ি না হলে চলাফেরা করা যায় না, এই জন্য গাড়িটা আছে আর কি, কিন্তু এই সময়ে সেই ’৯০ এর দশকের স্টারলেট গাড়ি নিয়ে আর যাই হোক এমন কিছু গর্ব করা যায় না। কিন্তু ঈশাণ তো ভ্রুক্ষেপ করে না এই সব। যাই হোক, গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে ভিতরে বসার জন্য গেল কথা, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে না। কি রিং এর আনলক বাটনটা চাপ দিল, টিট-টিট আওয়াজ হলো, কিন্তু গাড়ির লাইট জ্বললো না। মানে কি? আবার নষ্ট হয়ে গেল নাকি? কাছে গিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করলো কথা, তাও তো খুলছে না। একটু হতভম্ব হয়ে দারোয়ানের দিকে তাকালো, দেখল ওই ব্যাটার মুখে হাসি আরও প্রশস্ত হয়েছে, যেন খুব মজা পেয়েছে। কথার মেজাজ আরও খারাপ হলো, ব্যাপার কি? আবার প্রেস করলো আনলক বাটন, এবার যেন দেখল কাছেই কোথাও আলো জ্বলে উঠলো আওয়াজের সাথেই। এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার প্রেস করলো, দেখল ওদের গাড়ির উল্টোদিকে এক সারি পিছনে একটা চকচকে কালো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, সেটা সাড়া দিচ্ছে ওর বাটন প্রেসের সাথে। এবার তো কথা আরও চমকে উঠলো, মানে কি এর? কাছে গিয়ে দাঁড়ালো গাড়িটার, একটা হোন্ডা সিভিক গাড়ি, কিন্তু এটার চাবি ঈশাণের কাছে কি করে এলো! এবার দারোয়ান এগিয়ে এলো, “আপা, এটা আপনাদেরই গাড়ি, কাল রাতেই দোকান থেইকা দিয়া গেছে, স্যার অফিস থেকে ফেরার সময়। তয় স্যার মানা করছিল পরথমে আপনারে না কইতে। তাই কই নাই”।
এবার কথা বুঝলো দারোয়ানের দাঁত বের হয়ে থাকার রহস্য। ও অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো, অনেকদিন থেকেই বলছিল বটে এই হোন্ডা সিভিকের কথা, কথা একবার পছন্দ করেছিল শোরুমে গিয়ে, তখন আর কেনা হয়নি নানা বাহানায়। কিন্ত ঈশাণ এরকম হুট করে কিনে ফেলবে, না জানিয়ে, আর তাও এইভাবে দিবে, এটাই বা কেমন হলো, মোবাইলটা বের করলো ব্যাগ থেকে, নামছে না কেন এখনো ঈশাণ? ফোনে রিং হতেই ওর ঠিক পিছনেই বেজে উঠলো ঈশাণের ফোন। ঝট করে ঘুরে দাঁড়ালো কথা, ঈশাণ ওর পিছনের দাঁড়িয়ে। “তা হলে মানিব্যাগ ফেলে আসাটা অভিনয়?” কথা চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করে।
“এই হলো কথার প্রথম কথা? গাড়িটা দেখার পর?” ঈশাণের ঠোঁটে মুচকি হাসি। “কেমন হয়েছে তাই বলো”।
“অনেক সুন্দর হয়েছে, অনেক অনেক অনেক অনেক অনেক অনেক সুন্দর, কিন্তু কতগুলো টাকা নষ্ট হলো, বলছিলাম, বাট এখনই কেনার কি দরকার ছিল!” কথা’র চোখেমুখে এক অন্য আলো খেলা করছে।
ঈশাণ আরেকটু এগিয়ে আসে, দারোয়ানের উপস্থিতি থোড়াই কেয়ার করে কথার গালে ডান হাত টা দিয়ে একটু আদর করে বলে, “না কিনলে কি এইটা দেখতে পেতাম বলো?”

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





