somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবি, এম আর আখতার মুকুল। পর্ব- ২

০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ২:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



নীল দর্পণ নাটক ইংরেজিতে অনুবাদ করে পুস্তকাকারে প্রকাশ করায় যে সমাজ সংস্কারক রেভারেন্ড জেলং এর জেল ও জরিমানা হয়েছিল, তিনি ১৮৬৯ সালের ২১ শে জানুয়ারী বেঙ্গল স্যোশাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের অধিবেশনে তৎকালে বাঙালি মুসলমানদের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করলেন। তিনি মন্তব্য করলেন, জীর্ণ প্রাসাদের ভগ্নস্তুপ এবং শোচনীয় সামজিক দুরবস্থার দিকে চেয়ে দেখলেই বোঝা যায়, এদেশের মুসলমানরা নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছেন। এক সময় যারা এত বড় একটা রাজ্য শাসন করেছেন, আজ তাদের বংশধররা কায়ক্লেশে জীবনধারণ করছেন। ..... বাংলাদেশের কোনও গভর্ণমেন্ট অফিসে উচ্চপদস্থ মুসলমান কর্মচারী বিশেষ দেখা যায় না। কিন্তু মুসলমান দফতরী পিওন সব অফিসে ভরে গেছে। .....

তাই অবস্থাদৃষ্টে একথা প্রমানিত হয়েছে যে, আলোচ্য শতাব্দীতে ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ বাঙালি হিন্দুরা যেভাবে সানন্দে গ্রহণ করেছিল, বাঙালি মুসলমানরা সেভাবে করেনি। পশ্চিম বাংলার বিশিষ্ট মার্কসিস্ট গবেষক ও সমালোচক বিনয় ঘোষের মতে, ক্ষমতাচ্যুত মুসলমান সমাজের ইংরেজ বিদ্বেষ এবং নিজেদের শিক্ষা সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে গোড়ামি ও গর্ববোধ, দম্ভ ও রক্ষণশীলতা এবং স্বাভাবিক ইংরেজ বিদ্বেষের জন্য সে সময় ইংরেজের শিক্ষা ব্যবস্থা ও শাসন ব্যবস্থার প্রতি সহযোগিতার মনোভাব তাদের মধ্যে বিশেষ দেখা যায়নি। প্রথম যুগে ইংরেজদের সমস্ত কার্যকলাপ তারা সন্দেহের চোখে দেখেছেন। ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তনও তারা সুনজরে দেখেননি। এই অসহযোগিতার ও গোড়ামির জন্যই তারা ও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে হিন্দুদের পেছনে পড়ে গেছেন। ...... মুসলমানদের প্রতি অবিশ্বাস ও বিদ্বেষভাব থাকার জন্য ইংরেজ শাসকরাও হিন্দুদের মতন শিক্ষার সুযোগ মুসলমানদের দেয়নি।

এ সম্পর্কে তিনি আরও মন্তব্য করেছেন, প্রথম যুগে ব্রিটিশ গভর্ণমেন্টের নীতি মুসলমান বিদ্বেষ এবং হিন্দু পক্ষপাতিত্বের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। তাই হিন্দুরা উচ্চ শিক্ষার সুযোগ ও উৎসাহ পেয়েছেন, সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন এবং ইংরেজদের অধীনে কিছু কিছু মোটা বেতনের সরকারি চাকরিও পেয়েছেন। মুসলমানরা সেরকম সুযোগ বা উৎসাহ পাননি। নিজেদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে মিথ্যা অহংকার তাদের ছিল।.... ইংরেজদের নতুন জমিদারি ব্যবস্থার ফলে শুধু যে মুসলমান জমিদার জায়গিরদারেরা ধ্বংস হয়ে গেলেন তা নয়, বাংলার যে কৃষক প্রজারা ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হলো তাদের মধ্যে অধিকাংশই মুসলমান। বাংলার প্রায় প্রত্যেক জেলায় এই উৎখাত নি:স্ব প্রজাদের ধুমায়িত বিক্ষোভ দস্যুবৃত্তি (?) ও কৃষক বিদ্রোহের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করল। সেই সময় এল ওয়াহাবী আন্দোলনের ঢেউ। ধর্মান্দোলনের ঢেউ, কৃষক বিদ্রোহ, মুসলমান অভিজাত শ্রেণীর প্রতিহিংসা প্রবৃত্তি ও ইংরেজ বিদ্বেষের এই সম্মিলিত প্রকাশকে ব্রিটিশ শাসকরা ব্রিটিশ বিরোধী জিহাদ বলে প্রচার করলেন।

বাঙালি মুসলমানদের এই মনমানসিকতা সম্পর্কে লর্ড এলেনব্যুরোর মন্তব্য হচ্ছে, ইংরেজদের প্রতি মুসলমানদের একটা জন্মগত বিদ্বেষ ও শত্রুতা আছে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। (প্রবলেম্স অব ইন্ডিয়া : সেলভনকর : পৃ: ২২)।

১৮৬৮ সালের ৩০শে জানুয়ারী কোলকাতায় অনুষ্ঠিত বেঙ্গল সোশ্যাল সাইন্স এসোসিয়েশন এর দ্বিতীয় অধিবেশনে জনাব এ লতিফ বাংলাদেশে মুসলমানদের শিক্ষার অবস্থা সম্পর্কে যে নিবন্ধ পাঠ করেন, সে সম্পর্কে আলোচনাকালে ইংরেজ বিচারপতি জ্রে বি ফিয়ার এর বক্তব্য বিশেষভাবে লক্ষনীয়। তিনি বলেন, ওয়ারেন হেস্টিংসের সময় থেকে এদেশের মুসলমান ভদ্রশ্রেণী লোকচক্ষে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছেন। শিক্ষায় ও সামাজিক সম্মান লাভে তারা শিক্ষিত হিন্দু ভদ্রশ্রেণী থেকে অনেক পিছিয়ে পড়ে রযেছেন। মুসলমান সম্প্রদায়ের এই পশ্চাদগতির রাজনৈতিক গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। এর ফলে মুসলমানদের মধ্যে বিক্ষোভ দেখা দিতে বাধ্য।

তাই এ সময়কালের অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, একদিকে ক্ষমতা হস্তচ্যুত হওয়ায় মুসলমান বিত্তশালীরা কিছুটা আক্রোশ ও কিছু অভিমানে ইংরেজ রাজশক্তি থেকে নিরাপদ দুরত্বে চলে গেছে এবং পাশ্চাত্য ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি আচার ব্যবহার, রীতিনীতি সব কিছুকেই বর্জন করেছে। অণ্যদিক অভিভাবকহীন বাংলার মুসলিম গণমানুষের নেতৃত্ব সবার অলক্ষ্যে এক শ্রেণীর ধর্মান্ধ মোল্লা মৌলভীর (অনেকেই উত্তর ভারতীয় অঞ্চল থেকে আগত) কুক্ষিগত হয়েছে। এরা ইংরেজি শিক্ষার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি এবং কয়েক শতাব্দী ধরে মুসলিম পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা ঐতিহ্যবাহী বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষনা করল। সর্বোপরি এরা বাংলার মাটির সঙ্গে সম্পর্কহীন এক ধরনের জগা খিচুড়ি ভাষা ও তমুদ্দুন এর প্রবর্তন করল।

এতসব ঘটনা প্রবাহের আলোকে একথা নি:সন্দেহে বলা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার সমাজ জীবনে পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাবে এবং ইংরেজ পৃষ্টপোষকতায় কোলকাতা কেন্দ্রিক যে বুদ্ধিজীবি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সৃষ্টি হলো, বাঙালি মুসলিম শিক্ষিত ও বিত্তশালীরা অন্তত তার অন্তর্ভূক্ত হলো না। এজন্য কারা দায়ী সে কথা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ না করেও শুধু এটুকু মন্তব্য করা যথার্থ হবে যে, এটাই হচ্ছে বাস্তব ও ঐতিহাসিক সত্য। সে আমলের বাংলার এই নবসৃষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণী কিছুতেই ধর্ম নিরপেক্ষ ছিল না। অথচ ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শই হচ্ছে জাতীয়তাবাদের মুল ভিত্তি এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার চৌহদ্দিতেই গড়ে উঠে নির্ভেজাল প্রকৃত জাতীয়তাবাদ।

বাংলার ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরযালোচনা করলে দেখা যায় যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে শুরু করে পুরো ঊনবিংশ শতাব্দী ধরে কোলকাতা কেন্দ্রিক যে বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ ঘটেছে, তাদের কর্ণধারেরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের দাবিদার হিসেবে যত কথাই বলে থাকুক না কেন, তা আসলে বাঙালি হিন্দু জাতিয়তাবাদের কথাবার্তা। এজন্যই তো ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দপাঠ এর মুল সুরই হচ্ছে যবন বিরোধী। সে আমলে এদের রচিত বাংলা সাহিত্যের সর্বত্রই হিন্দুয়ানীর ঢক্কানিনাদ, বন্দেমাতরম স্লোগানের আড়ালে সামগ্রিকভাবে বাঙ্গালি সমাজের দেশপ্রেমের বহি:প্রকাশ দেখতে পেত। (পরবর্তী কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ সহ জনাকয়েক ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী। মানব প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নিরাকার ঈশ্বরের পূজারী।)

সুষ্ঠু ও একটা পরিচ্ছন্ন আলোচনার সুবিধার্থেই বঙ্গীয় এলাকায় মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণী সৃষ্টির গোড়ার কথা এবং এদের বিকাশের ধারাবাহিতা দেখা যায় যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্থে যখন ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের পৃষ্ঠপোষকায় কোলকাতার বাসিন্দাদের ব্যাপক বিকাশের কাজ সবেমাত্র শুরু হয়েছে, তখন থেকেই এক শ্রেণীর বাঙালি শিক্ষিত হিন্দু বিদেশী রাজশক্তির সহযোগির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। স্বল্প দিনের ব্যবধানে অত্যন্ত দ্রুত এরই ধারাবাহিকতার জের হিসেবে বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী (এটাকেই জাতীয়তাবাদী বাঙালি মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা করা হয়।) পূর্ণতা লাভ করে।

১৮৭২-৭৩ সালে এক প্রশাসনিক রিপোর্টে দেখা যায় যে, মধ্যস্বত্যের বিস্তারের ফলে জমিদারির সংখ্যা বাংলাদেশে দেড় লাখের বেশি হয়েছে, বিশ হাজার একরের উপরে বড় জমিদারির সংখ্যা পাঁচশর কিছু বেশি, ত্রিশ হাজার থেকে পাঁচশ একরের মধ্যে মাঝারি জমিদারি প্রায় ষোল হাজার এবং এবং পাঁচশ ও তার কম ছোট জমিদারির সংখ্যা দেড় লাখের কিছু কম। এর সঙ্গে যদি জমিদার-পত্তনিদার-জোতদারদের গোমস্তা নায়েব তহশীলদার পাইক দফাদার প্রভৃতি কর্মচারী ও ভৃত্যের সংখ্যা যোগ করা যায় তাহলে দেখা যাবে উনিশ শতকের শেষ পর্বে ব্রিটিশ ভুমি রাজস্ব নীতির ফলে বাংলাদেশের গ্রাম্য সমাজে কমপক্ষে সাত-আট লাখ লোকের এমন একটি শ্রেণী তৈরী হয়েছে, যে শ্রেণী ব্রিটিশ শাসকদের সুদৃঢ় স্তম্ভসরুপ। অবশ্য সামাজিক শ্রেণী হিসেবে বলতে গেলে একটি শ্রেণী বলা যায় না, দুটি শ্রেণী বলতে হয়- একটি নতুন জমিদার শ্রেণী আর একটি নতুন মধ্যসত্বভোগী ও গ্রাম্য মধ্য শ্রেণী। নামে দুই শ্রেণী হলেও, কাজ ও স্বার্থের দিক থেকে এদের চিন্তা-ভাবনা ও আচরন এক শ্রেণীর মতোই।

নব সৃষ্ট হিন্দু মধ্য শ্রেণীর ভুয়া রেনেসাঁ

..... এ পাশে নাগরিক সমাজে, যেমন কোলকাতা শহরে, ব্রিটিশ শাসকরা তাদের বিশ্বাসভাজন আরও দুইট শ্রেণী তৈরী করেছিলেন- একটি নতুন নাগরিক ধণিক শ্রেণী, আর একটি নতুন নাগরিক মধ্য শ্রেণী। এই মধ্যশ্রেণীর মধ্যে ছোট ছোট ব্যবসায়, দোকানদার, দালাল প্রভৃতির সংখ্যা অনেক, বাকি নানারকমের চাকরিজীবি। নাগরিক মধ্য শ্রেণীর একটি বিশেষ স্তর হিসাবে গড়ে উঠেছিল বাঙালি ইংরেজি শিক্ষিত এলিট শ্রেণী। ব্রিটিশ আমলে বাঙালি সমাজের এই শ্রেণী রুপায়ন নিশ্চয় একটা বড় রকমের পরিবর্তন এবং আগেকার পিরামিডের মতো স্তরিত সমাজের সঙ্গে এর পার্থক্য অনেক। কেননা নবযুগের নতুন শ্রেণী বিণ্যাস অচল নয়, সচল-উর্ধ্বাধ: গতিশীল এবং সেই গতির প্রধান চালিকা শক্তি টাকা। টাকা সচল, শ্রেণীও তার ছন্দে সচল। বাঙালি সমাজে আঠারো উনিশ শতকে এ সত্যও নির্মম বাস্তব সত্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তার জন্যই কি তাকে রেনেসাস বলা যায়?

পরবর্তী কালে অনেকেই উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার এই নব সৃষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দ্রুত বিকাশের পঞ্চদশ শতাব্দীর ইউরোপীয় কিংবা ষোড়শ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের রেনেসার সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। এদের মতে, বাংলার এই যুগই হচ্ছে নব জাগরনের যুগ। বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণী তখন ইংরেজী শিক্ষায় দীক্ষিত হতে শুরু করেছে- তাদের সম্মুখে তখন পশ্চিমের নতুন দুয়ার উন্মোচিত হয়েছে। মানববাদী দর্শন সুচতুর আবরনে পাশ্চাত্যের ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি ছাড়াও আচার-ব্যবহার রীতি নীতি সব কিছুই এদের দৃষ্টিতে সজীব ও মহান। রেনেসা আর নব জাগরনের ধ্বজা উত্তোলন করে বাংলার বর্ধিঞ্চু বর্ণহিন্দু মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবি শ্রেণী তখন বাবু কালচারের পাশাপাশি সাহেবী কালচারকে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যাপকভাবে প্রয়াসী হয়েছে।

কিন্তু একটা কথা স্মরণ রাখা দরকার যে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ ১৫৫৮ খ্রিষ্টাব্দে আক্রমনকারী দুর্ধর্ষ হিম্পানী আর্মাডাকে যখন ইংরেজরা পর্জুযদস্ত করতে সক্ষম হয়, তখন থেকেই তীব্র জাতীয়তাবাদ বোধের ভিত্তিতে সমগ্র ইংল্যান্ডে রেনেসা বা নব জাগরনের জোয়ার বয়ে যায়। ইংরেজদের এই নব জাগ্রত দেশপ্রেমের প্রতীক এবং এর কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন রানী এলিজাবেথ।

তাই ইংল্যান্ডের রেনেসার শুরু যেখানে হিম্পানী আর্মাডার বিরুদ্ধে ইংরেজদের বিজয়ের মাঝ দিয়ে; সেখানে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাংলার নবসৃষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রেনেসার সুচনা হচ্ছে জাতির পরাজয়ের মাঝ দিয়ে। এই রেনেসা বা নব জাগরণই হচ্ছে কখনও পরোক্ষভাবে আবার কখনওবা নগ্নভাবে সাম্রাজ্যবাদী শাসক গোষ্ঠীর গুণকীর্তন করে। অত্যন্ত দু:খজনকভাবে বলতে হয়, সে আমলে বাংলার মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবি শ্রেণীর নবজাগরণ হচ্ছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সম্পূরক শক্তি হিসেবে। এই নব জাগরণের মোদ্দা কথাটাই হচ্ছে বশ্যতা মেনে নিয়ে পরাধীনতার শৃংখল সুদৃঢ় করা। বাংলার নতুন হিন্দু জমিদার শ্রেণী ও উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে আপোস করে, শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবি শ্রেণীকে সরকারী চাকরির মাধ্যমে নিম্নস্তরের উচ্ছিষ্ট দিয়ে সন্তুষ্ট করে।
ভ্রমাত্মক আদর্শ কোনও ইজম-এর সুদৃঢ় ভিত্তি হতে পারে না

সে আমলের এই মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবি সমাজ বাঙালি হিন্দুয়ানীকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল বলে এক রকম নিশ্চিত হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন পর্যন্ত এই চিন্তাধারা অনেকের কাছেই সঠিক বলে বিবেচিত হয়েছে।
কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বাস্তবে এই ব্যাপারটা কত নাজুক ও ঠুনকো ছিল। একটা ভ্রমাত্মক আদর্শ কোনও ইজম-এর জন্য সুদৃঢ় ভিত্তি হতে পারে না। প্রায় দেড় শতাব্দী ধরে বাঙালি হিন্দুয়ানীকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টাকে বিলীন করতে অপরিপক্ক প্রতিপক্ষের চার যুগের বেশি সময়েল প্রয়োজন হলো না। প্রথম পর্যায়ে ধর্মীয় স্লোগান উচ্চারন করে এই প্রতিপক্ষ বাঙালি হিন্দুয়ানীকে পদ্মার ওপারে বিশাল অবাঙালি জনসমুদ্রে ঠেলে দিল। আর দ্বিতীয় পর্যায়ে এই সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিপক্ষ মাত্র ২৪ বছরের ব্যবধানে নির্ভেজাল বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্লোগান উচ্চারন করে রক্তাক্ত পতে ধর্মান্ধদের হটিয়ে দিয়ে পৃথক আবাসভূমি স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি করল।

পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এই গাঙ্গের বদ্বীপ এলাকার পুরো জনগোষ্ঠীর শতকরা ৮৮ ভাগই ইসলাম ধর্মাবলম্বী বলে এখানকার দ্রুত সৃষ্ট নয়া মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবি এর কিছুটা স্পর্শ থাকাটা স্বাভাবিক। তবুও একথা- স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, প্রচন্ড বাধা বিপত্তির দুর্গম পথ অতিক্রম করে প্রকৃত ও পরিপূর্ণ বাঙালি জাতীয়তাবাদ এই বাংলাদেশেই প্রতিষ্ঠিত হতে বাধ্য। এটাই হচ্ছে ইতিহাসের অমোঘ নির্দেশ। এখন বাংলাদেশে প্রকৃত বাঙালি জাতীয়তাবাদের শৈশবকাল চলছে। অবশ্য টাকার এ-পিঠে বাঙালি হিন্দুয়ানীর মতো ও-পিঠের বাঙালি মুসলামানীর প্রবক্তারা মাঝে মাঝে কিছুটা ধুলিঝড়ের সৃষ্টি করবে বৈকি। কিন্তু তা হচ্ছে নিতান্তই সাময়িক। বাংলাদেশের তরুন সমাজই এদের মোকাবেল করে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করতে সক্ষম।

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অর্থাৎ ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পূর্ব পর্যন্ত বাঙালিত্বের দাবিদার কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু এই বুদ্ধিজীবি সমাজ নিজেদের শ্রেণী স্বার্থে কীভাবে ইংরেজ পরাশক্তির লেজুড় হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে তা বিশেষভাবে লক্ষনীয়। পর্যলোচনা করলে দেখা যায় যে, আদর্শ দেশপ্রেম আর রেনেসার কথাবার্তা বলে এরা যত ধুলিঝড়ের-ই সৃষ্টি করুক না কেন এ কথা আজ গবেষণার মাধ্যমে প্রমানিত হয়েছে যে, এই বুদ্ধিজীবি শ্রেণী আলোচ্য সময়ে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে গণমানুষের আন্দোলনে নেতৃত্বদান কিংবা ভ্যানগার্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করা তো দুরের কথা সাধারণ মানুষের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সমস্ত প্রচেষ্টাকে হয় এরা বিদ্রুপ করেছে- না হয় উলঙ্গভাবে বিরোধীতা করেছে। এই প্রেক্ষিতে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত তৎকালীন সংবাদপত্রের ভুমিকার কথা উল্লেখ করতে হয়। সে আমলে অবিভক্ত বাংলার কৃষক বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ কিংবা নীলচাষিদের বিদ্রোহ কোনটাকেই এসব পত্র-পত্রিকা সুনজরে দেখেনি। সর্বত্রই শ্রেণী স্বার্থ রক্ষার উদগ্র বাসনায় এসব সংবাদপত্রের পরাশক্তির সমর্থক হিসেবে অতি নিন্দনীয় ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সিপাহী বিদ্রোহ’র সময়ে কোলকাতার সংবাদপত্রগুলোতে সিপাহীদের এসব কর্মকান্ডের প্রেক্ষাপটে বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবিদের মন-মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় তা ইংরেজদের প্রতি দাসসুলভ মনোভাবে পরিচায়ক বলে উল্লেখ করা যায়। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ২:৫৫
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×