স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপদেশ মতো ঈদের আগে যারা তালা জোগার করতে পেরেছেন, তারা হয়তো নিরাপদে গ্রামের বাড়িতে ঈদ শেষে শহরে ফিরেছেন। নিরাপদে শহরে ফিরতে পারলেও ঈদের ছুটিতে বিষমুক্ত নিরাপদ খাবার খেয়েছেন কিনা, তাতে অবশ্য সন্দেহ রয়েছে। ঈদের আগে পত্রিকায় খবর পড়েছিলাম ‘কলার খোসা খেয়ে ছাগল মারা গেছে’। ‘সিরাজগঞ্জে ময়দা, চিনি ও রাসায়নিক মিশিয়ে দুধ তৈরী করে বাজারজাত করা হচ্ছে’। তার চেয়েও ভয়ানক খবর ছিলো ‘লিচু খেয়ে দিনাজপুরে মারা গেছে বেশ কয়েকজন বাচ্চা ও শিশু’। ঈদের সেমাই, কাঁচা শাকসব্জি, সুস্বাদু ও রসালো ফল-মূল, তাজা মাছ, শুটকি, টাটকা মাংস, গুঁড়া দুধ, প্রক্রিয়াজাত খাবার থেকে শুরু করে মসলার গুঁড়া পর্যন্ত সবকিছুই এখন আমাদের দেশে মানুষের রোগবালাই ও মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রমজানের ঈদের আগে মসলার গুঁড়ায় টেক্সটাইল কারখানার রং মিশিয়ে বাজারজাত করেছে ন্যায়-নীতিহীন মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা। মানুষের শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর জেনেও শুকনা মরিচের গুঁড়ার সঙ্গে টেক্সটাইল কারখানার প্রাণঘাতী লাল রং ও জিরা-ধনিয়ার গুঁড়ার সঙ্গে ছাই রং মেশানো হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছিল। তুলনামূলকভাবে দামে সস্তা ও টাটকা রং হওয়ায় গ্রামাঞ্চলের নিরীহ ও অশিক্ষিত মানুষ বিষাক্ত মসলার ফাঁদে পড়েছে সহজেই। এসব বিষাক্ত খাবার খেয়ে মানুষ তো বটেই, জীবজন্তু পর্যন্ত মারা যাচ্ছে। আমাদের দেশে প্রায় প্রত্যেক পরিবারেই বড় ধরনের রোগে আক্রান্ত কোন না কোন সদস্য রয়েছেন। কেউ কিডনির সমস্যায় ভুগছেন, কারও লিভার নষ্ট, কারও রয়েছে হার্টের সমস্যা, আবার কারও রয়েছে ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধি। ঘরে ঘরে রয়েছে ডায়াবেটিকসের সমস্যা। কঠিন ও জটিল এসব মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হলে, যাদের সামর্থ্য রয়েছে তারা সাধারণত চিকিৎসা করান রাজধানী ঢাকার নামিদামী হাসপাতাল গুলোতে। যাঁরা বিখ্যাত ও ধনকুবের এবং সমাজের উঁচুস্তরের লোকজন, তাঁরা উন্নত চিকিৎসা সেবার জন্য ছুটেযান ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আর যাদের কোনও আর্থিক সামর্থ্য নেই, তারা ঠাঁই পান দেশের সরকারী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর হাসপাতালের মেঝেতে। প্রিয়জনের জীবন রক্ষায় জায়গা জমিসহ সব সম্পদ বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে যান তাদের ছেলেমেয়ে বা আত্তীয়স্বজনেরা। সমস্যা জটিল হওয়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মা-বাবা, ভাই-বোন অথবা প্রিয়জনকে বাঁচানো সম্ভবপর হয়ে উঠে না। জীবন মরণের সব ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তার হাতে থাকলেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রিয়জনকে বাঁচানোর জন্য সাধ্যমত চিকিৎসা সেবা করেও বিষাক্ত খাবারের সর্বনাশা ছোবল থেকে রেহাই পাওয়া যায়না।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকারের কাছে সাধারণ জনগনের জীবন ও স্বাস্থ্যের নিরাপত্তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় থাকতে পারে না। থাকাটা উচিতও নয়। মাঝরাতে বেসরকারী স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর টকশোতে কে কি বললেন তা নিয়ে বর্তমান সরকার অতি উৎসাহী হলেও, খাদ্যে ভেজাল ও সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা নিয়ে তেমন কোনও মাথাব্যথা নেই সরকারের নীতিনির্ধারকদের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়াধীন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর (বিএসটিআই) মাঝেমধ্যে মোবাইল কোর্ট বা ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে ভেজালবিরোধী অভিযান চালায়। ছোটখাটো ব্যবসায়ী ও খুচরা বিক্রেতাদেরকে জরিমানা করে থাকে। আবার কখনও কখনও কাগজে-কলমে কম জরিমানা দেখানো হয়। রাতের আঁধারে এসে বাকী টাকা নিয়ে যাওয়া হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। বছর শেষে তারা কয়েক কোটি টাকা জরিমানা আদায় করা দেখিয়ে সরকারের কাছ থেকে বাহবা কুড়ায়। রাজনৈতিক সরকারের পরিবর্তন হলেও তাদের কাজ বদলায় না। ফলে খাবারে বিষ মেশানোর আসল অপরাধীরা সবসময়ই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। নমুনা পরীক্ষার বেলায়ও সিটি করপোরেশনের দুর্নীতিবাজ খাদ্য পরিদর্শকরা ল্যাবরেটরির গবেষকদের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা নমুনা সরবরাহ করে থাকে। তাই নমুনা পরীক্ষায়ও কখনোই কোনো ভেজাল প্রমাণিত হয় না। সাধারণ জনগনের জীবন ও স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা বিষয়ে বছরের পর বছর এমনিভাবে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে আমাদের দেশ। দীর্ঘদিন ধরে এসব ভেজাল ও বিষাক্ত খাবার গ্রহণের ফলে বয়স্কদের মধ্যে ক্যান্সার জাতীয় রোগের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে বেশী। গর্ভবতী মহিলারা জন্ম দিচ্ছেন বিকলাঙ্গ শিশু। এমন অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই হয়তো আমরা পঙ্গু জাতিতে পরিনত হবো। খাদ্যপণ্যে মেশানো বিষ ও ভেজালবিরোধী অভিযান সফল করতে এবং খাবারের প্রতি সাধারণ ভোক্তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দ্রুত কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত অনতিবিলম্বে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করা।
১. সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন হচ্ছে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বা বিএসটিআই কে তাদের দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেয়া। আরেকটু সহজ কথায় বলা যায়, সংস্থাটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে খাদ্যপণ্যে ভেজাল দেয়া বা মানহীন পণ্য বিক্রি করার সকল দায়-দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালযেই কেন্দ্রীভূত করা উচিত। দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকের চোখে যেমন ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী বা সরকারের প্রভাবশালী আমলার দুর্নীতি কখনোই ধরা পড়েনা, তেমনি বিএসটিআইও ভেজাল পণ্যদ্রব্য উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে কখনোই শাস্তি দিতে পারবে না। একথা মোটামুটি হলফ করে বলা যায়। তার প্রধান কারণ হচ্ছে, আমাদের দেশের জনপ্রতিনিধিরাই বড় বড় ব্যবসায়ী। তানজিম আহমদ সোহেল তাজের গাজীপুর-৪ (কাপাসিয়া) আসনটি বাদ দিলে, ৩৪৪ সদস্যের বর্তমান জাতীয় সংসদে ৮০ ভাগ সংসদ সদস্যই ব্যবসায়ী। এই আইনপ্রণেতাদের কেউ কেউ আবার আইনের নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সরকারের সঙ্গে বহাল তবিয়তে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। জনসেবার নামে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে ব্যাপক সফলতার পরিচয় দিচ্ছেন। তাই বিএসটিআই বা দুদকের মতো সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার পক্ষে আইনপ্রণেতা নামের এই ব্যবসায়ীদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা প্রায় অসম্ভব। তাই সংস্থাটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা না করে, রাষ্ট্রের তহবিল থেকে বেতনভাতা দিয়ে, নামিদামি গাড়ি ও সরকারী বাড়ি দিয়ে জামাই আদরে রেখে লাভ কী?
২. ভেজালবিরোধী অভিযান যদি চালাতেই হয় তাহলে খুচরা বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে নয়, বরং অভিযান চালিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন পণ্য উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। খাদ্য-দ্রব্যে কোনও সংরক্ষক বা প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হলে তা অবশ্যই নিরাপদ এবং নির্দিষ্ট মাত্রার হতে হবে। পণ্যের মোড়কে পণ্যের নাম, খুচরা মূল্য, সঠিক পরিমান, প্রস্তুতকারী কোম্পানির নাম, পূর্ণ ঠিকানা, ফোন নম্বর, উৎপাদনের তারিখ, মেয়াদ উত্তীর্নের তারিখ ও ব্যবহার বিধি অবশ্যই উল্লেখ থাকতে হবে। টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়ার ক্ষেত্রেও এই বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। এসবই উত্পাদকের বা উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব, খুচরা বিক্রেতার নয়।
৩. পলিথিন বা প্লাস্টিকজাত দ্রব্যে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ (প্লাস্টিসাইজার) মানুষের শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টি করে থাকে। তাই পলিথিন ও প্লাস্টিকজাত প্যাকেটে তৈলাক্ত খাবার রাখা উচিত নয়। ফাস্টফুড বা জাঙ্কফুডে প্রোটিন, ভিটামিন ও আঁশ জাতীয় খাদ্য প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম পরিমাণে থাকে। অথচ অতিরিক্ত লবণ, চিনি ও চর্বি থাকে যা শরীরে স্থূলতা (মেদবৃদ্ধি) সহ হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি বাডায়। তাই এসব পণ্যের মোড়কে সতর্কতামূলক নির্দেশনা থাকা উচিত ।
৪. বিদেশ থেকে কাঁচা ফল-মূল ও মাছ আমদানীর ক্ষেত্রে কঠোর পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানে চিংড়ি রপ্তানীর ক্ষেত্রে কঠোর মান রক্ষা করতে হয়। সেসব দেশের মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য সরকার প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করতে পারলেও আমাদের দেশের মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য সরকার একটি সাধারণ পরীক্ষার ব্যবস্থাও করতে পারছে না। আশপাশের দেশ থেকে কাঁচা ফল-মূল ও মাছ আমদানির সময় তা ক্ষতিকর কি না, দেশের স্থলবন্দর ও সমুদ্রবন্দরগুলোতে তা পরীক্ষা করার কোনো ব্যবস্থা নেই। ডিজিটাল যুগে এটি শুধু দুর্ভাগ্যজনক নয়, অনেকটা লজ্জারও বটে।
৫. সরকারি সংস্থাগুলোর কাজের সময় সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত এমন ধারণা পরিহার করতে হবে। মাছে ফরমালিন দেয়া বন্ধ করতে হলে, সূর্য ওঠার আগেই রাজধানী ও বড় বড় শহরের কাঁচাবাজার গুলোর পাইকারি বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে হবে। প্রয়োজনে রাত জেগে বাজারে অভিযান চালাতে হবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা শিফটিং বা সময় ভাগাভাগি করে কাজ করতে পারেন।
৬. আমাদের দেশে ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনাকারী ভ্রাম্যমাণ আদালতগুলো সাধারণত মিডিয়া নির্ভর হয়ে থাকে। অভিযান টিভি ক্যামেরাতে ধারণ করা হলো কিনা, অভিযানের পরের দিন কয়টি পত্রিকায় ছবিসহ প্রতিবেদন ছাপানো হলো সেদিকেই থাকে তাঁদের নজর। গণমাধ্যমে প্রচার দিয়ে অভিযান চালালে তার সার্থকতা কী? মানুষ কি টিভি ক্যামেরায় বা পত্রিকার পাতায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটের ছবি দেখতে চায়, নাকি স্বাস্থ্য রক্ষার নুন্যতম অধিকার টুকু চায়?
৭. রাসায়নিক দ্রব্য আমদানীর ক্ষেত্রেও কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আমদানীর অনুমোদন পেতে আমদানিকারককে উল্লেখযোগ্য শর্ত পূরণ করার ব্যবস্থা করতে হবে। আমদানি করা রাসায়নিক দ্রব্য যত্রতত্র খোলাবাজারে বিক্রি করা চলবে না।
৮. খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে আমাদের দেশে আইনের অভাব না থাকলেও, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির যথেষ্ট অভাব রয়েছে। অপরাধীদেরকে মধ্যপ্রাচ্যের মতো প্রকাশ্যে শিরচ্ছেদ করতে হবে, এমনটা দাবী করা হচ্ছে না। তবে খাদ্যে ভেজাল বা বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মেশালে কঠোর শাস্তি পেতে হয়, এমন একটা ধারণা আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। নামমাত্র কিছু টাকা জরিমানা ও দু-এক মাসের কারাদণ্ড নয়, ভেজাল পণ্য উত্পাদন রোধে কমপক্ষে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে শুরু করে মৃত্যুদন্ডের বিধান রাখতে হবে। আইনে শুধু বিধান রাখলেই হবে না, প্রয়োজনে অপরাধীকে সর্বোচ্চ শাস্তিও প্রয়োগ করতে হবে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



