somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গোলাপ যে নামে ডাক

১১ ই জানুয়ারি, ২০১১ রাত ১০:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছোট ভাইয়ের ছেলেটা একদিন হঠাৎ জিজ্ঞেস করল- আচ্ছা, ফুপি হিটলার যখন জার্মানীতে ছিল, তখন কি সবাই ওকেই সাপোর্ট করেছিল? আমি চিন্তায় পড়ে যাই। এমনতো ভাবিনি। বই পত্রে তো পড়েছি রেজিট্যান্স যোদ্ধাদের কথা আর জার্মান ভিন্ন মতালম্বীদের জেলে আর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাবার কথা। ওকে সেগুলো বললাম, কিন্তু দেখলাম ও চাইছে নাম, তারিখ এসব। আমি ছোট একটা গল্প শুনেছিলাম জার্মানীতে গিয়ে। সেটার উপর ভিত্তি করে সার্চ দিলাম। পেয়ে গেলাম আমার মনের মত তথ্য ওকে বলার মত।

উপরের সারি বাম থেকে প্রফেসর কুর্ট হুবের, অ্যালেক্স শ্মোরেল, ক্রিস্টফ প্রোবস্ট, নীচের সারি বাম থেকে হান্স শোল, সোফি শোল, ভিলি গ্রাফ

সাদা গোলাপ নামের গোপন দলটি ১৯৪২ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন লিফলেটের মাধ্যমে হিটলারের শাসনের বিরোধীতা করেছিল , ঝুঁকি নিয়েছিল মৃত্যুর। সাদা গোলাপ দলের মূলে ছিলেন মিউনিখ বিশ্ববিদযালয়ের বেশ কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী-হান্স শোল, সোফি শোল, ক্রিস্টফ প্রোবস্ট, অ্যালেক্স শ্মোরেল, য়ুর্গেন ভিটেনস্টাইন, ভিলি গ্রাফ, ট্রট লাফ্রেনৎস সহ আরও অনেক তরুণ-তরুণী এবং তাদের শিক্ষক কুর্ট হুবের। ১৯৩৮ সালেই সাদা গোলাপের জন্ম হয়বলা চলে । এ সময় য়ুর্গেন ভিটেনস্টাইনের আলাপ হয় অ্যালেক্স শ্মোরেলের , তাঁরা তখন মিলিটারি ট্রেনিং নিচ্ছিলেন। দু’জনের মধ্যে আলাপ হয় রেজিট্যান্স সহ নানাবিধ বিষয়ে। ট্রেনিং শেষে দুজন ভর্তি হন মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে।সেখানে আলাপ হয় সমমনস্ক হান্স শোলের সঙ্গে। হান্স ছিলেন সাদা গোলাপের প্রতিষ্ঠাতা মূল ৬ জনের একজন। নিজেদের ভাল লাগার বিষয়গুলো আলাপ করতে এসে পড়ে হিটলারের শাসনের ভয়াবহতা কথা আর সেই সাথে অনুভব করেন কিছু করার। এঁদের প্রত্যকেরই ইহুদী বন্ধু ছিল, যাদের তাঁরা হারিয়েছিলেন। তাছাড়া বাড়ির পরিবেশও ছিল এক রকম, যেখান থেকে পেয়েছিলেন অবরুদ্ধ পরিবেশের বিরুদ্ধাচারণ করা।

তাঁরা ঠিক করেন লিফলেট লিখে পোস্ট করবেন। সব মিলিয়ে তাঁরা লিখেছিলেন ছয়টি লিফলেট। প্রথম থেকে চতুর্থ লিফলেটগুলো লেখেন অ্যালেক্স শ্মোরেল ও হান্স শোল। টেলিফোন বই থেকে ঠিকানা নিয়ে পোস্ট করেন সারা মিউনিখবাসীদের। লিফলেটে জার্মান জনগণকে নিজেদের বিবেক জাগ্রত করার ডাক দেয়া হয়। ১৯৪২-এর জুলাইয়ে সাদা গোলাপের পুরুষ সদস্যদের যেতে হয় ফ্রন্টে রাশিয়ায়। সেখানে গিয়ে তাঁরা আরও ভালভাবে বুঝতে পারেন এই অনর্থক যুদ্ধের অসারতা। ঐ বছরের হেমন্তে ছেলেরা ফ্রন্ট থেকে ফিরে নব উদ্যোমে সাদা গোলাপের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৪৩-এর জানুয়ারীতে হাতে চালান মেশিন দিয়ে তাঁরা মোটামুটি ছয় থেকে নয় হাজার লিফলেট ছড়িয়ে দেন স্টুটগার্ট, কোলন, ভিয়েনা, ফ্রিবার্গ, শেমনিৎস, হামবুর্গ, ইন্সব্রুক এবং বার্লিন পর্যন্ত। লিফলেটটি সৃষ্টি করে আলোড়নের আর গেস্টাপো সন্ধান করতে থাকে এর হোতাদের।

১৯৪৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী স্যুটকেসে করে অনেকগুলো লিফলেট ভরে হান্স আর সোফি যান ইউনিভার্সিটিতে। ক্লাস চলাকালীন সময়ে সিঁড়িতে আর করিডরে লিফলেট রেখে দেন, যেন ছাত্র-ছাত্রীরা বের হয়ে ওগুলো নিয়ে পড়তে পারে। এই পর্যন্ত ঠিক ছিল, কিন্তু সোফি লক্ষ্য করেন যে, স্যুটকেসে কিছু লিফলেট বাকী পড়ে আছে। তাই তিনি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ছুঁড়ে দেন বাকী কপিগুলো। ব্যাপারটা নজরে আসে বিশ্ববিদ্যালয় কর্মী জ্যাকব শ্মিডের ,সঙ্গে সঙ্গেই খবর চলে যায় গেস্টাপোর কাছে। গ্রেপ্তার হন হান্স ও সোফি শোল।হান্সের পকেটে পাওয়া যায় ক্রিস্টফের লেখা একটি লিফলেট। গ্রেপ্তার হন ক্রিস্টফও।জিজ্ঞাসাবাদের সময় হান্স জানান যে, নামটি তিনি নিয়েছেন জার্মান কবি ক্লেমেন্স ব্রেন্টানোর সাদা গোলাপ কবিতা শিরোনাম থেকে।
গ্রেপ্তারকৃত হান্স শোল, সোফি শোল ও ক্রিস্টফ প্রোবস্ট

একে একে সাদা গোলাপের সবাই গ্রেপ্তার হন। প্রহসনের বিচারে হান্স, সোফি এবং ক্রিস্টফের প্রাণদন্ড হয়। আদালতে অকুতোভয় সোফি বিচারককে বলেন-আমাদের মত আপনিও ভালই বুঝতে পারছেন যে যুদ্ধে আমরা হেরে গাছি। এটাকে স্বীকার করতে এত ভয় পাচ্ছেন কেন? ১৯৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী শিরশ্ছেদ করা হয় হান্স সোফি এবং ক্রিস্টফের। এরপর একে একে ধৃত সকলেরই প্রায় প্রাণদন্ড হয়। তাঁদের ষষ্ঠ লিফলেটটি চোরা পথে মিত্র বাহিনীর হাতে পৌঁছায়।
কি লেখা ছিল সেই শেষ লিফলেটে?

ষষ্ঠ লিফলেট
“আমাদের জন্য শ্লোগান একটাই- পার্টির বিরুদ্ধে লড়াই করুন! ত্যাগ করুন পার্টি, যা আমাদের মুখে তালা মেরে রেখেছ আর রাজনীতির জালে আটকে ফেলেছে! এসএস কর্পোরাল এবং সার্জেন্টদের আর তাদের পা চাটাদের লেকচার রুম থেকে বেরিয়ে আসুন! আমরা চাই সত্যিকারের শিক্ষা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা। কোন হুমকি-ধমকি আমাদের ভয় দেখাতে পারবেনা, এমনকি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিলেও না। বিবেক আর নৈতিক দায়িত্ব থেকে এই আমাদের এই সংগ্রাম চলবে ভবিষ্যৎ,আমাদের স্বাধীনতা, আর সম্মানের জন্য…
…জার্মানীর জনগণ আজ একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। আমাদের প্রশ্ন হল আমরা কি আমাদের সৈনিকদের ভবিষ্যৎ একটা জ্ঞানশুণ্য লোকের হাতে ছেড়ে দেব? আমরা কি আমাদের বাকী জার্মান যুবসমাজকে একটা পার্টির উচ্চাকাঙ্খার কাছে বলি দেব? হিসাব নিকাশের দিন এসেছে জার্মান যুবসমাজের সাথে আমাদের কাছে সবচাইতে জঘন্য স্বৈরাচারীর সঙ্গে। জার্মান জনগণের পক্ষে থেকে আমরা এডলফ হিটলারের রাষ্ট্রের কাছে দাবী জানাই যে আমাদের সবচাইতে বড় সম্পদ ব্যক্তি স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়া হোক, যা তিনি আমাদের কাছ থেকে ধাপ্পাবাজি করে নিয়ে নিয়েছেন…”

মৃত্যুদণ্ডে প্রাণ দেবার আগে সোফির শেষ কথা ছিল- আমরা কি করে আশা করি যে হঠকারীতার জয় হবে, যেখানে মানুষ হঠকারীতার জীবন দিতে চায়না নিজে থেকে? কি সুন্দর একটা রোদ ঝলমলে দিন, কিন্তু আমাকে চলে যেতে হবে। আমার মরে যাওয়ায় কিছু যায় আসে না, যদি এর মধ্যে দিয়ে হাজার হাজার মানুষ জেগে ওঠে।”
মিত্র বাহিনী তাদের ষষ্ঠ লিফলেটটি সম্পাদনা করে বিমানে করে জার্মানীর উপরে কয়েক মিলিয়ন কপি ছড়িয়ে দেয়। সাদা গোলাপের সব সদস্য, বিশেষ করে সোফি নতুন জার্মানীর প্রতীক।



ছবি কৃতজ্ঞতাঃ মাহমুদুল করিম রুবেল, উইকিপিডিয়া
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১০:৩৯
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×