সৈয়দ মুজতবা আলী’র সাথে আমার পরিচয় ডিগ্রী ক্লাসের বাংলা সংকলনের একটা গল্প দিয়ে। ঐ গল্পটা তার “চাচা কাহিনী” থেকে নেওয়া, এটা মনে আছে (পরে চাচা কাহিনী পড়েছি কিনা); কিন্তু গল্পটার নাম মনে নেই। অবশ্য “ ’নিস্তব্ধতা হিরণ্ময়’- একথাটা যে বলেছে তাকে যেন মরবার আগে একবার একলা-একলি পাই।” – এই লাইনটা পড়লেই সৈয়দ সাহেবের ভক্তরা নিশ্চয় বুঝতে পারবেন আমি কোন গল্পটার কথা বলছি।
পড়ছিলাম “দেশে-বিদেশে”, হঠাৎই ইচ্ছে হলো আগে “শবনম”টা শেষ করবার, দু’টোই আফগানিস্তানের প্রেক্ষাপটে লেখা কিনা। মিথ্যা বলবোনা, পড়বার পর, এবং পড়বার মাঝে, কতবার যে আমার চোখ ভিজেছিলো, সেটা আসলে হিসেব করে বলা যায়না। এই লেখাটা আসলে একজন পাঠকের মুগ্ধতার বহিঃপ্রকাশ।
সৈয়দ সাহেবের লেখার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার তীক্ষ্ণ রসবোধ, আর তার মাথায় তুলে আছাড় মারা’র কৌশল। শবনম ও এর বাইরে নয়। প্রথম দুই খন্ড শবনমের এতোই মধুর, এতোই প্রেমের উচ্ছাসে ভরা, সেখান থেকে যখন পাঠককে তৃতীয় খন্ডের বিরহে ভরা সমুদ্র পাড়ি দিতে হয়, সে বড্ড কঠিন লাগে। প্রথম দুই খন্ডে কি বিরহ ছিলো না? ছিলো, শবনমের প্রেমে “মজনূন”-পাগল যে মজনূন, শবনম কান্দাহার চলে গেলে তার প্রতিটি মুহুর্ত কি একাকী চরম অপেক্ষায় যায়নি? শবনম বলেছিলো, “আমার বিরহে তুমি অভ্যস্ত হয়ে পরো না”, মজনূন তো বটেই, এক মুহুর্তের জন্য পাঠক পর্যন্ত শবনমের বিরহে, বিবৃতিকারের কাতরতায় অভ্যস্ত হয়ে পরেন না।
কিন্তু তারপরও, শবনমের রূপ, আর তার প্রাপ্তিতে বিবৃতিকারের সুখ, পালটা সৌভাগ্যের উপাখ্যান শবনমের সব মিলিয়ে প্রথম দু’খন্ড আমাকে করেছিলো ‘হিংসিত’। আমার জীবনে যদি অমন একটা প্রেম থাকতো, জীবনের কাছ থেকে চাইবার খুব কম কিছুই থাকতো। শবনম মজনূন’কে ভালোবেসে ধন্য, মজনূন তাকে ভালোবেসে তার চেয়ে আরো ধন্য; কে যে কাকে বেশী ভালোবাসে, সে হিসেব করতে না যাওয়াই ভালো।
শবনমের হারিয়ে যাওয়া, তৃতীয় খন্ডের সারমর্ম হতে পারতো এটাই; কিন্তু না, পাঠক তৃতীয় খন্ডের মুল সূর হিসেবে দেখতে পায় মজনূনের বিবর্তন। সত্যিকারের “মজনূন”- পাগল প্রেমিক থেকে মজনূন হয়ে ওঠে “সুফী”- সাধক। প্রিয়ার অপেক্ষা তাকে অভ্যস্ত করে না, কিন্তু প্রিয়ার বিচ্ছেদ তাকে এতো শক্তিহীনও করেনা, যে প্রিয়ার জন্যে তার অপেক্ষা এতোটুকু দূর্বল হয়।
গল্পের শেষ হয় শবনমের বাড়ি ছেড়ে যাবার আগে লেখা ছোট্ট চিরকুট দিয়ে, “বাড়িতে থেকো, আমি ফিরবো।” শবনম ফেরেনা, মজনূন অপেক্ষায় থাকে, পাঠকের গালে চোখের জলের নতুন প্রলেপ পড়ে। পাঠক শবনমের বিরহে অভ্যস্ত হয়না, সব মহান প্রেম কাহিনী’র মতো “শবনম”-এর শেষ বিচ্ছেদে, এই সত্য মেনে নিতে পারে না। মজনূনের মতোই পাঠক অপেক্ষায় থাকে, শবনম ফিরবে, আর ঠিক এখানেই লেখকের সার্থকতা।
“প্রথমে দেখেছিলুম কপালটি। যেন তৃতীয়ার ক্ষীণচন্দ্র। শুধু, চাঁদ হয় চাঁপা বর্ণের, এর কপালটি একদম পাগমান পাহাড়ের বরফের মতই ধবধবে সাদা। সেটি আপনি দেখেন নি? অতএব বলবো নির্জলা দুধের মত। সেও তো আপনি দেখেন নি। তাহলে বলি বন-মল্লিকার পাঁপড়ি’র মত। ওর ভেজাল এখনো হয়নি।”
আমার পড়া বইগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রেম কাহিনী এটিই।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ৯:৪৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




