somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বুক রিভিউঃ মুখের দিকে দেখি-শহীদুল জহির

২২ শে মার্চ, ২০২০ রাত ২:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বেশ কিছুদিন ধরেই গৃহবন্দী জীবন যাপন করছি। সামনে আরো কতদিন করতে হবে তার ঠিক নেই। এমন একটা অস্থির সময়, যুদ্ধ নয় তবে যুদ্ধে চেয়েও বেশি কিছু…কিংবা অ্যাপোক্যালিপ্স! আর এমন একটা সময়ে টিকে থাকার একমাত্র অস্ত্রই গৃহবন্দী থাকা। তাই ভাবলাম সম্প্রতি পড়া শহীদুল জহিরের ‘মুখের দিকে দেখি’ বইটির একটা রিভিউ করে ফেলি।

‘ব্যস্ততার জন্য বই পড়া হয় না’, ‘আগের মত পড়ার আর সময় হয়ে ওঠে না’, ‘কতদিন ধরে এই মুভি/সিরিজ দেখবো দেখবো করছি,কিন্তু সময় করে উঠতে পারছি না’-এই অভিযোগগুলো ছিল আমাদের নিত্যদিনের। হয়তো দু’সপ্তা আগেও ভাবিনি হঠাৎই এত অফুরন্ত অবসর পেয়ে যাবো। অনিচ্ছার এই অবসর কাটানোর জন্য চিন্তা করলাম যে বইগুলো ব্যস্ত সময়ের অজুহাতে পড়া হয়ে ওঠেনি সেগুলো পড়ব আর রিভিউ করবো। আমার মত অর্বাচীনের এত বিখ্যাত সব সাহিত্যকর্ম রিভিউ করা মানায় কি মানায় না এই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম বৈ কি! তবে মনে পড়ে গেলো মুজতবা আলীর সেই অমর কথা, এক মহাপুরুষ আরেক মহাপুরুষের জীবনী রচনা করতে যাবেন কেন? অধিকারতো আমাদের মত হীন মানুষদেরই। সেই ভাবনায় সাহস করে লিখতে বসা। যদিওবা জ্ঞানের জিনিসের চাইতে চুটকিতেই আমাদের আনন্দ বেশি কারণ তাতে তৎক্ষণাৎ সুড়সুড়ি পাওয়া যায়, তারপরেও কেউ যদি পড়ে দু’চারটা ভাল খারাপ মন্তব্য করে তাহলেই সার্থকতা।

জাদু বাস্তবতা বা ম্যাজিক রিয়েলিজম নিয়ে আমি অজ্ঞ একজন মানুষ। শহীদুল জহিরের আগে এই জনরা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে আগে কেউ কাজ করেছেন কি না সঠিক জানা নেই তবে লেখকের খ্যাতি মূলত এই জনরা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার জন্যই সুবিদিত। আমি সাহিত্য সমালোচক নই, নতুন অ আ ক খ শেখার পর যেরূপ অনুভূতি হয় তাই উগড়ে দেয়ার চেষ্টা করব।

‘মুখের দিকে দেখি’ বইটিকে লেখক কোনো নির্দিষ্ট সময়ের আবর্তে বাঁধতে চাননি, হয়তো চেয়েছেন, হয়তো বিভিন্ন সময়ের সমান্তরালে গল্প বলে পাঠককে সেই সময়ে বিচরণের স্বাধীনতা দিয়েছেন। বইটিতে অনেক অনেক চরিত্র, কিন্তু সেই চরিত্রগুলো স্বাধীন, প্রত্যেকের নিজস্ব গল্প আছে। সেই গল্পগুলো কোনো বিশেষ চরিত্রের আবর্তে গড়ে ওঠেনি, বরঞ্চ ‘মুখের দিকে দেখি’ সেই সকল চরিত্রের স্বাধীন গল্পের একটি মিশ্রণ হয়ে দাড়িয়েছে। লেখক সেই সকল চরিত্রের পরিণতির দায় নিতে চাননি, তাদের নিজেদের মত করে বাড়তে দিয়েছেন, হয়তোবা চেয়েছেন পরিণতির দায় পাঠক নিজেদের মত করেই নিক। এজন্যে তিনি অনেকগুলো সম্ভাবনার কথা বলে গিয়েছেন শ’বারেরও অধিক ‘হয়তো’ শব্দটি ব্যবহার করে।

উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এর ন্যারেটিভ স্টাইল। আপনি এই লেখাকে তথাকথিত লিনিয়ার ন্যারেটিভ স্টাইলের ছাঁচে বাঁধতে পারবেন না। আপনার কল্পনাকে নিয়ে লেখক খেলা করবেন বিভিন্ন সময়ে নিয়ে যেয়ে। সেই ঘোর লাগা মুহূর্ত আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে একদম উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত। সেই ঘোরের মধ্যেই সমাজের কথা, ইতিহাসের কথা বলে গেছেন শহীদুল জহির। খ্রিষ্টান মিশনারির গল্প, প্রটেস্ট্যান্টের সাথে ক্যাথলিকের প্রেমের গল্প, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, খৈমনের দারিদ্রের সাথে সংগ্রাম করে হেরে যাওয়ার গল্প, বান্দরের দুধ খাওয়া পোলা চানমিঞার ঊঁচু স্তরে খাপ খাওয়াতে যেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে অন্ধকার জীবনে ধাবিত হওয়ার গল্প, কিংবা মামুন বা খরকোসের জন্ম পরিচয়ের গোলকধাঁধাতে ঘুরপাক খাওয়ার উপাখ্যান এটি। কোনো একটি লেবেলে এই উপন্যাসকে বাঁধা যায় না। এজন্যেই এটি হয়ে উঠেছে বিরুদ্ধ প্রেমের উপন্যাস, দ্রোহের উপন্যাস, সামাজিক বিভাজনের উপন্যাস।

পাঠক যদি এই উপন্যাস পড়ে উপসংহারের আশা করেন তাহলে মস্ত ভুল করবেন। আপনাকে এই উপন্যাসের গতিময়তার সাথে হারিয়ে যেতে হবে। প্রতিটি লাইনের মধ্যে নিজের কল্পনাকে স্থাপন করে সেখান থেকে রস আস্বাদন করতে হবে। এই বাস্তব আর পরাবাস্তবের মিশেলের মধ্যেই এই উপন্যাসের সার্থকতা।

তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে উপন্যাসের শুরুতে আর মাঝে যেভাবে হাজারো সম্ভাবনার কথা বলে পাঠককে কল্পনার বিভিন্ন স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন শেষে এসে সেগুলোকে ন্যারো ডাউন করার একটা দায় নেয়ার চেষ্টাও তিনি করেছেন। এজন্যে উপন্যাসের শেষে কিছু খাপছাড়া উপসংহারে যাওয়ার প্রচেষ্টা আমরা দেখতে পায়। প্রচেষ্টা সফল হলে হয়তো সেটি উল্লেখ করার কোনো প্রয়োজন পড়ত না, কিন্তু একটু খাপছাড়া হয়ে যাওয়াতেই মনে হয়েছে লেখক শেষের দিকে শুরুর কিংবা মাঝের ইন্টেন্সিটিটা ধরে রাখতে পারেননি।

নতুন ধরণের বাংলা সাহিত্যর সাধ পেতে বইটি অবশ্যই রিকমেন্ডেড। হয়তো প্রথমে গিলতে কষ্ট হবে। নতুন যেকোনো কিছুই তো প্রথমবার কষ্টের, তাইই তো?

রেটিংঃ ৭/১০
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০২০ রাত ২:৫৯
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×