somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমায় ঘিরে ঢাকার বিবর্তনের ইতিহাস - পর্ব ১ বিহারি ও হিন্দু পরিবার

২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ১১:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.
"ঢাকার মোহাম্মদপুর"
বলা যায় এখানেই জন্ম এখানেই জীবনের অনেকখানি পার করে দিচ্ছি। এর পশ্চিমে বুড়িগঙ্গার শাখা নদী, রায়ের বাজার স্মৃতিস্তম্ভ, পূর্বে সংসদ ভবন, দক্ষিনে লালমাটিয়া-ধানমন্ডি ও উত্তরে শ্যামলী। এখানে সাধারন বাংলাদেশি ছাড়াও অনেক বিহারীর বাস, বাঁশবাড়ী এলাকাতে বেশ কিছু হিন্দু পরিবার আছে। আমার বাবা স্বাধীনতার পরপর পুরাতন ঢাকার গেন্ডারিয়াতে থাকা যৌথ পরিবার ছেড়ে মো:পুর বাড়ি কিনে বসবাস শুরু করেন। আমাদের বাড়ির মালিক ছিল বিহারী। স্বাধীনতার সময় তার একমাত্র পুত্রধন ছিল বিহারী রাজাকার। বাবা মার কাছে শুনেছি স্বাধীনতা যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনীর লোকজন আমাদের বাসার সামনের জানালা দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই টেনে-ছিড়ে বের করে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। আমার বাবা বাড়িতে ওঠার পর দ্রুত জানালাটা পরিবর্তন করেন বলে শুনেছি। বেটা হামারী বিহারী মালিক আমার বাবা সহ আরো দুজনের কাছ থেকে অগ্রীম বাড়ি বেচার টাকা খেয়ে বসেছিল!
মো:পুরের প্লটগুলো ছিল মোটামুটি একই রকম দেখতে, পোনে দু কাঠার প্লট, অল্প কিছু ৩ কাঠার প্লট। শুনেছি এগুলো বিহারী উদ্বাস্তুদের বসবাসের জন্যই তত্কালীন পশ্চিমা পাকিস্তানিরা তৈরি করে। বিহারিদের বাংলাদেশে উদ্বাস্তু হয়ে আসার কাহিনী যদিও বেশ করুন! দেশ বিভাগের পর ১৯৪৭ সালের অক্টোবর/নভেম্বরে ভারতের বিহারে রায়ট এ প্রায় ৩০,০০০ মুসলমান বিহারীকে হত্যা করা হয়েছিল। সেই ভয়ে নিরুপায় হয়ে তারা উদ্বাস্তু হিসাবে দলে দলে তত্কালীন পুর্ব পাকিস্তানে চলে আসে। যদিও অনেকে ভুল করে এদের পাকিস্তানী ভাবে! সেটা ভুল, তাদের আদি নিবাস ভারতের বিহার রাজ্য। এ মাইগ্রেশনে পশ্চিম পাকিস্তানীদের হীন স্বার্থ ছিল। যেহেতু বিহারিরা ছিল শিয়া-উর্দুভাষী আর বাংলা সংস্কৃতি হতে সম্পূর্ন আলাদা তাই তারা চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে তাদের তাবেদার গোষ্ঠী তৈরি হোক। সে কারনে পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাদের সুনজরে রাখত, বিশ্বাস করতো বেশি। বিভিন্ন কাজে কর্মে, সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বাঙ্গালদের বঞ্চিত করে অগ্রাধিকার পেত বিহারিরা। স্বাধীনতা যুদ্ধে তাই তারা সরাসরি পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ নেয়, বাংলাদেশিদের উপর চালায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, রাহাজানি, লুটপাট - সবকিছু।
ছোট বেলায় মনে পরে দেখতাম হঠাৎ হঠাৎ ব্যান্ড বাদ্য বাজিয়ে পুলিশ সহ দলবল নিয়ে লোকজন কোথায় যেন যাচ্ছে! তখন জানতাম না ঘটনাটি কি! একদিন দেখি আমাদের সামনের দুটো বাসা পরে এ রকম একদল লোক এসে তক্ত পোষক (বিহারিরা ব্যবহার করতো), বাসন-কোসন, আসবাবপত্র ইত্যাদি ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে! বিশাল হট্টগোল, চিত্কার চেচামেচি! ঘটনা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানিরা অনেক বিহারীকে কাগজপত্র ছাড়াই এখানে প্লট বরাদ্দ দিয়েছিল কিংবা দখলে রেখেছিল। পরে অন্য কেও সে জমি সরকারের কাছ থেকে কিনে/লিজ নিয়ে মালিকানা নিয়ে নেয়। নোটিস দেয়া পরও অনেক পরিবার দখল না ছাড়ায় এভাবে ব্যান্ড বাদ্য বাজিয়ে সিনেমাটিক স্টাইলে দখল নেয়া হতো। ছোট বেলায় খুব অমানবিক লাগতো ব্যাপারগুলো! কারন আমার পরিচিত অনেক পরিবারকেই এভাবে বিতাড়িত হতে দেখেছি।
অনেকে মনে করতে পারে বিহারিদের প্রতি অন্যায় (সংখ্যালঘু অত্যাচার) করা হতো তখন! একদম ভুল কথা! আমি অনেক অবৈধ বাংলাদেশিকে ও দেখেছি এভাবে দখল হারাতে! এখনও প্রচুর বিহারী বৈধভাবে সম্মানের সাথে নিরাপদে আমার আশেপাশে ঢাকাতে বাস করতে দেখছি।
বিহারিদের সাথে খেলাধুলা, মজাসে দিন পার করার অনেক স্মৃতিময় মুহূর্ত আছে। আমরা ঢাকার পোলাপাইন বিহারিদের 'মাউরা' বা 'বিহারীকা ভুত, লম্বা লম্বা ুধ' বলে নিয়মিত ক্ষেপানো হতো, যেভাবে নোয়াখালী-বরিশাল থেকে আসা অন্য বন্ধুদের 'নোয়াখাইল্লা', 'বরিশাইল্লা' বলে ক্ষেপানো হত। আর একটা মনে আছে, "চোর চোট্টা খেজুরের গুড়, সব হইলো ফরিদপুর"! এখানে বর্ণ-জাতি নিয়ে হেয় কটাক্ষ করে কিছু বলার মানসিকতাই আমাদের ব্রেনে একদমই ছিল না, এখনও নেই।
মোহাম্মদপুরে প্রতিবছর মহারমে বিহারিদের তাজিয়া মিছিল বের হয়, সাথে চলে মাতম করা! ছোট বেলার আমাদের মিছিল দেখাটাও ছিল অনেক বড় বিনোদন! তবে গায়ে চাবুক মেরে রক্তা রক্তি করা আর মুখে কেরোসিন নিয়ে ফুঁ দিয়ে আগুনের কুণ্ডলী বানানো দেখে ভয় পেতাম। মসজিদের মত তাজিয়া গুলো দেখে রেটিং করা ছিল অন্যতম কাজ।
এখন তাদের পরবর্তী বিহারী বাংলাদেশি প্রজন্ম (১৯৭১এর পর জন্ম নেয়া) দেশের মূল শিক্ষায় প্রবেশ করে আমাদের সাথে বেশ খাপ খাইয়ে নিয়েছে। অনেকের উচ্চারণ (Accent) এখন ধরা যায় না যে তাদের আদি নিবাস বিহার! যদিও ঘরে তারা এখনও 'উর্দু' (না হিন্দি? আমরা বাংলাভাষীদের কাছে সব একই রকম লাগে:P) বলে থাকে। মজার ব্যপার ' ভারতীয় হিন্দি' কালচার, ভাষা, মুভি এখনও তারা তাদের নিজেদের কালচার মনে করে!! প্রচন্ড অনুরক্ত।


২.
আমাদের বাড়ির পিছন গলিতেই (বাঁশবাড়ী) আছে অনেক হিন্দু পরিবারের বাস। গলিটা যথেষ্ট অপ্রসস্থ হলেও হিন্দু ধর্মের পরিবারগুলো গুচ্ছ হয়ে এক সাথে থাকে! হতে পারে অমূলক অনিরাপত্তার ভয়! যাহোক আমার এক ক্লাস মেট কাম বন্ধু সুমন বন্দোপাধ্যায় সেখানে থাকতো। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াতে সপরিবারে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে বাস করছে (কেও আবার এখানেও সংখ্যা তত্ত্ব দিয়ে প্রমান করার চেষ্টা না করে, কেন হিন্দু পরিবার কমে যাচ্ছে)। মিষ্টি খেতে হলে যে কোন সময় মাসির (সুমনের মা) কাছে গেলে কিছু না কিছু পেতাম। আর সুমনের বাবার সাথে দেখা হলেই প্রথমে বলতেন, 'কেমন আছো বাবা?' আমার পরিবারের সবার খোজ খবর আগে নিয়ে তার পর অন্য কথা শুরু করতেন। উনি কি যেন পাইকারী ব্যবসা করে যথেষ্ট অর্থবান ছিলেন। এ এলাকার বেশিরভাগ হিন্দু পরিবারই প্রতিষ্ঠিত। কখনও মনে হয়নি তারা দেশে অন্য ধর্মালম্বী বলে ব্যবসায় সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন।
আমরা মুসলমানরা শিক্ষা পেয়েছি, ছোট বড় যে কাওকে প্রথম দেখলে সালাম দিতে হয়, বলতে হয় আপনার উপর 'শান্তি' বর্ষিত হোক। সেটা যেভাবেই প্রতিষ্ঠা হোক না কেন বা যে ধর্মেরই হোক, শান্তিই সবার জীবনে কাম্য। কিন্তু মজার ব্যপার লক্ষ্যনীয় আমরা কোন হিন্দু গুরুজনের সাথে প্রথম সাক্ষাতেই বলি 'আদাব', সালাম শব্দটা চাপিয়ে না দিয়ে! এটা অবশ্যই আমাদের বাংলাদেশীদের সৌহার্দ্যতা পরিচয়। তাছাড়া দাদা, মাসি শব্দগুলোর ব্যবহারও লক্ষণীয়। তবে সুমনকে আমরা বন্ধুরা মিলে "বদনায় পাদ দেয়" (বন্দোপাধ্যায় এ অপভ্রংশ/বিকৃত করে:|) বলে ক্ষেপাতাম! যেভাবে ক্ষেপানো হত বাবুকে 'হাগু বাবু' বলে (পিকনিকে যেয়ে হাগু বিষয়ক সমস্যায় পরা থেকে শুরু;)), কিংবা তানভীরকে 'পোতা' (কারন অজানা:P)।
দুর্গা পুজার সময় ঐ পাড়াতে আনন্দের জোয়ার বইত, সাথে সাথে আমাদের মত পোলাপানরা পেত বোনাস উত্সব। সেই ছোট বেলা থেকে দেখে এসেছি একই পাড়াতে দু দুটো পুজা মন্ডপ বসে আসছে। আমারা হিসাব করতাম কোন বিগ্রহটি বেশি সুন্দর হয়েছে, সাথে ঢাকের আওয়াজ বাড়তি উত্সবের আমেজ দিত। তবে এটা সত্যি প্রসাদের মন্ড খেতে আমার ঘেন্না লাগতো (পৃথিবীর অনেক ভাল খাবারই আছে আমার না পছন্দ হওয়ার তালিকায়)। এখন আর সেভাবে বাশবাড়ি পুজা মন্ডপ দেখতে যাওয়া হয় না! বন্ধুরা ছড়িয়ে পরেছে পৃথিবীর আনাচে কানাচে। তবে আমার ঢাকাইয়া বউ প্লাস তার হিন্দু বান্ধবীদের পাল্লায় পরে অন্যান্ন বড় পুজার মন্ডপ দেখতে যাওয়া হয়েছে লাস্ট কবছর। বর্তমানে কলাবাগানের পুজা মন্ডপের বিগ্রহ বেশ দৃষ্টি নন্দন হয়ে আসছে। তবে এখন মন্ডপে মন্ডপে থাকে সাউন্ড সিস্টেমে (বোধহয় আধুনিকতায় ধাক্কায় শুধু ঢাকে পোষায় না!) বিশাল আয়োজন! ধুম ধারাকা সাউন্ডে বাজে চটুল হিন্দি গান! আমাদের দেশীয় স্বকীয়তা মার খাচ্ছে ভারতীয় হিন্দি গানের দাপটে তবে অনুপ জালোটার কিছু বাংলা গান/ভজন বাজতে শুনেছি। এখান হিন্দুয়ানা (আচার অনুষ্ঠান) চেয়ে চাকচিক্য বেশি দেখতে পাই। আধুনিকতার দাপট সব যায়গায়!

কিছু তথ্য লিংক:
View this link
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০১০ রাত ১১:০৭
১৮টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!

লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫২

রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।

আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!

এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×