somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

=== বন্ধুতা (১ম অংশ) ===

০১ লা জুন, ২০১২ রাত ১:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিকেল বেলা । মাঝে মাঝে হালকা বাতাসে কিছু বালু উড়ে এসে চোখে পড়ছে । ঝাপসা করে দিচ্ছে দৃষ্টি । আমরা অনেকগুলো লোক । একসাথে হেঁটে যাচ্ছি ।
আমাদের সবার পরনে সাদা পোশাক । একমনে হাঁটছি । আমাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত হেঁচকি দিয়ে কান্নার চেষ্টা করছে । আবার পর মুহূর্তেই থেমে যাচ্ছে । কেউ কারো সাথে কথা বলছে না । কেমন যেন একটা নিস্তব্ধতা । এরকম পরিস্থিতিতে আগে কখনও পড়েছি বলে মনে হয় না ।
জংলা-মত একটা জায়গা পেরুনোর পর মোটামুটি একটা খোলা জায়গায় এসে থামলাম আমরা । খানিকটা দূরে একটা ছেলে শুয়ে আছে । ও আমার বন্ধু । শুধু বন্ধু বললে ভুল হবে; ও আমার ভাই, আমার নিঃসঙ্গতার সঙ্গী ।
ছেলেটার নাম অরিন্দম । অরিন্দম সাহা । আমি ডাকি অরু ।
--------------------------------------------------------------------
অরুর সাথে আমার পরিচয় কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময় । অরু আর আমি একই রুমে থাকতাম । বাবা-মা ছেড়ে একা থাকতে এসে প্রথম প্রথম আমি শুধু কাঁদতাম । কলেজের কাছের টিলা, বিশাল মাঠ, বাস্কেটবল গ্রাউন্ড – কিচ্ছু আকর্ষণ করতো না আমাকে । সেই সময় অরিন্দম আমাকে প্রায়ই জ্বালাত ‘ন্যাদা বাচ্চা’ বলে । আমি খেপে উঠে অরুর শুকনো শুকনো হাত দু’টো মুচড়ে দিতাম । ব্যথায় চিৎকার করতে করতেও হাসতো সে । একসময় আমি মারামারির পথ ছেড়ে দিয়ে অরুর খাতা লুকিয়ে রাখতাম, প্যান্টে কালি লাগিয়ে দিতাম, পানিশমেন্ট এর ব্যবস্থা করতাম । আশ্চর্যের বিষয় হল, অরিন্দম আমার কাজগুলো সম্পর্কে জানত, কিন্তু নালিশ করতো না ।
লেখাপড়া থেকে বেশ দূরেই চলে গিয়েছিলাম। পরীক্ষার কিছুদিন আগে, অরিন্দম হঠাৎ করেই আমাকে লেখাপড়ায় সাহায্য করতে শুরু করে দিল । আমি অনেক অবাক হয়েছিলাম । ক্লাস সেভেন পড়ুয়া একটা ছেলের কাছে এরকম বন্ধু পাওয়া বিশাল ব্যাপার । ... আমি নিজেও লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিলাম । অরিন্দমের সাহায্য পেয়ে খুব ভালোমতোই পরীক্ষা দিলাম । আমি প্রায় নিশ্চিত ছিলাম যে, ফার্স্ট হয়ে যাবো । কিন্তু রেজাল্ট দেয়ার পর অবাক হয়ে গেলাম; যখন দেখলাম, ফার্স্ট হয়েছে অরিন্দম !
আমি সেদিনও ঈর্ষায় জলে-পুড়ে কেঁদে দিয়েছিলাম । আর অরু হাসতে হাসতে আমাকে দেখে বলেছিল, “ন্যাদা বাচ্চা”।
-------------------------------------------------------
কয়েকটা কাক সামনের খালি জায়গাটাতে এসে বসছে মাঝে মাঝে । একটু পরেই আবার উড়ে যাচ্ছে । সূর্যের দিকে তাকালাম আমি । নাম না জানা পাখির দল উড়ে যাচ্ছে, উত্তর থেকে দক্ষিণে । হঠাৎ বাতাসে আবারও বালু উড়তে শুরু করল । উড়ন্ত বালুর পর্দা সরে যেতেই একটা ছেলেকে শুয়ে থাকতে দেখা গেল ।
ছেলেটার নাম অরিন্দম । অরিন্দম সাহা । আমি ডাকি অরু ।
--------------------------------------------------------------------
ক্যাডেট কলেজের প্রথম বছরটা মোটামুটি ভালোভাবেই কেটে গেল । প্রচণ্ড রকমের ঘর-পাগল ছেলে আমি । তাই যেদিন ঈদ উপলক্ষে ছুটির ঘোষণা করা হল, খুশিতে প্রায় লাফাতে লাফাতে ব্যাগ গোছানো শুরু করে দিয়েছিলাম । আমার মত এতোটা না হলেও, বাকি সবাই কম-বেশী খুশী হয়েছিল । শুধু একজন ছাড়া । সে অরিন্দম । অরুকে দেখলাম মুখ গোমড়া করে বড় সিনিয়রদের কাছে গিয়ে ঘুরঘুর করছে আর কিছু একটা জিজ্ঞেস করছে । তারপর আবার মুখ গোমড়া করে ফিরে আসছে । কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ঘটনা কি । অরিন্দম জানালো, ও ছুটির সময়টাতে কলেজ হোস্টেলেই থেকে যেতে চায় । অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
“বাড়িতে বাবা, মা’র সাথে পুজোর সময় না থেকে এখানে কি ঘোড়ার ডিম করবি ?!”
“আমার মা,বাবা কেউই বেঁচে নেই । কাকুর কাছে বড় হয়েছি ।”
অরুর মুখে এই নির্লিপ্ত উত্তরটি শুনে আরও অবাক হয়েছিলাম আমি । তের-চৌদ্দ বছর বয়সী একটা ছেলের বাবা-মা কেউই বেঁচে থাকবে না, এটা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না । নতুনভাবে দেখা শুরু করেছিলাম অরুকে । মাথা চুলকে চুলকে এরপর বলেই ফেলেছিলাম,
“আমার সাথে, আমাদের বাড়িতে যাবি?”
মুহূর্তের জন্য একটা আনন্দের ঝিলিক দেখতে পেলাম অরিন্দমের চোখে । তারপরেই মলিন মুখে বলল,
“আংকেল, আন্টি কি না কি মনে করবে...”
“সেই চিন্তা আমার ।”
বলেই প্রায় দৌড়ে দৌড়ে অফিস ভবনে ঢুকে মা’কে ফোন করি আমি । বাবা ঝামেলা করতে পারে, এই হুঁশিয়ারি সহ অরুকে বাসায় আনার অনুমতি দিয়েছিল মা । আমি খুশির সপ্ত-ডিঙ্গায় উঠে, হোস্টেলে গিয়ে অরুকে অরুর ব্যাগ গোছাতে বললাম ।
বাবা-মা’র অনুমতি নিয়ে আমি আর অরিন্দমই বাসে উঠে চলে এলাম বাসায় । আমাদের বাসা কলেজ থেকে তেমন দূরে ছিলোনা । বাসায় গিয়ে বাবার কথা শুনতে হতে পারে, ভেবে বাসার পেছনের দরজা দিয়ে বাসায় ঢুকেছিলাম । পরে মা’র মাধ্যমে, বাবাকে ম্যানেজ করা হয়েছিল । আমরা রাতের খাবার খেয়ে আমার রুমে ঢুকে গেলাম । এর মধ্যে বাবা দুই বার এসে হুঁশিয়ার করে দিলেন, ছুটির সময়টাতে চিৎকার-চ্যাঁচামেচি কোনোভাবেই বরদাস্ত করবেন না তিনি । নিয়ম করে লেখাপড়া করতে হবে । আমরা তারপরও রাত জেগে আড্ডা দেবার সিদ্ধান্ত নিলাম । পরদিন ঘুম থেকে তাড়াহুড়ো করে উঠতে হবে না, হাই তুলতে তুলতে হাত-পা’র কসরত করতে হবে না, এইসব ভেবে ভেবে আমার মনে হচ্ছিল, সত্যিকারের ঈদ তো এটাই !
আমি বাবা-মা’র একমাত্র ছেলে । তাছাড়া বন্ধুদের সাথে তেমন ভালো ভাবে মিশতেও পারতাম না আমি । তাই অরিন্দমের সাথে মিশে আমি প্রথম কাউকে পেলাম, যে একই সাথে আমার বন্ধু এবং ভাই ।
পরদিন দুপুরে খাবার সময়, আমাকে মা খাইয়ে দিচ্ছিলেন । অরু আমার পাশে বসে খাচ্ছিল । খেতে খেতেই মা অরিন্দমকে জিজ্ঞেস করছিলেন, ওর বাসায় কে কে আছে , এসব নিয়ে । তারপর অরিন্দম যা যা বলল, তা শুনে আমি অনেকক্ষণ হা করে তাকিয়ে ছিলাম ওর মুখের দিকে । কারণ, অরু বলছিল,
“জন্মের পর থেকেই আমি বাবাকে দেখিনি । শুনেছিলাম, তিনি হারিয়ে গেছেন । একটু বড় হবার পর আমার মা ও মারা যান । আমাদের বংশের সবাই আমাকে খারাপ চোখে দেখতেন । তারা বলতেন, আমার কারণেই আমার বাবা-মা’র এরকম পরিণতি হয়েছে । কেউই আমার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে চান নি । পরে আমার এক কাকু একদিন আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যান । তার আগে আমি অন্য একটা বাড়িতে থাকতাম । তখন আমার বয়স ছয়-সাত বছর । কাকু খুব ভালো । কিন্তু...
“কিন্তু কি ?”
আমি আর মা একই সাথে জিজ্ঞেস করলাম । অরু একটু থেমে আবার বলতে লাগল,
“কাকু ট্রাক ড্রাইভার । সারাদিন ট্রাক চালিয়ে মাঝরাতে মদ খেয়ে ঘরে ফিরতেন । আর তখন... তখন হাতের কাছে যা কিছু পেতেন, তা দিয়েই আমাকে বেধড়ক পেটাতেন ।”
শিউরে উঠলাম আমি । কি ভয়ংকর ! সাত-আট বছরের একটা বাচ্চাকে কেউ পেটায় ! একটু পর মা জিজ্ঞেস করলেন,
“ক্যাডেটে তো অনেক খরচ । তাহলে তোমার খরচ কে চালায় বাবা ?”
অরিন্দমের মুখে এবার হাসি ফুটে উঠে । হাসিমুখেই উত্তর দেয়,
“আমার কাকু এই দিক দিয়ে খুব ভালো । খরচ উনিই দেন । যেভাবেই হোক, টাকা যোগার করে পাঠিয়ে দেন ।”
আমি প্রায় হতভম্ব হয়ে এতক্ষণ অরুর কথা শুনছিলাম । সত্যিই আশ্চর্য ! এতদিন ধরে একসাথে ছিলাম, অথচ একবারের জন্য ও অরু আমাকে এসব নিয়ে কিছুই বলে নি । অবশ্য আমি নিজেও কিছু জিজ্ঞেস করিনি । অরিন্দমকে দেখে মনে হচ্ছিল, বয়সের তুলনায় অনেকটাই পরিপক্ব । এই বয়সেই এতো ভয়াবহ অভিজ্ঞতা !
বিকেলে কেনা-কাটার জন্য বের হবার সময় আমি আর অরু ও যাই, মা’র সাথে । মা আমাদের দু’জনের জন্যই জামা-কাপড় কিনে দেন । অরু অবাক হয়ে সেই উপহার নিতে অসম্মতি জানায় । পরে মা’র কথায় সেই জামা-কাপড় গুলো নেয় । আমরা কেনা-কাটা, খাওয়া-দাওয়ার পর বাসায় ফিরি । রাতের খাবারের সময় মা আমাকে আর অরিন্দমকে দু’জনকেই নিজের হাতে খাইয়ে দেন । আমি খেয়াল করছিলাম, অরুর চোখের কোণ চিক চিক করছে ।
রাতে ঘুমানোর সময় ক্লান্ত ছিলাম বলে, তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে যাই আমি । ... মাঝরাতের দিকে কিছু একটা শব্দে ঘুম ভাঙ্গে আমার । চোখ খুলে পাশে তাকিয়ে দেখি অরিন্দম বসে আছে । হাঁটু ভাঁজ করে তাতে বালিশ নিয়ে মুখ গুঁজে ফোঁপাচ্ছে ।
“কি হয়েছে তোর ? কাঁদছিস কেন ?”
“রাহাত, খুব কম বয়সে মা কে হারিয়েছিলাম । মা’র চেহারাটাও মনে পড়ে না আমার । আজ যখন আন্টি আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছিলেন, মা’র কথা খুব মনে পড়ছিল । আমাকে এভাবে কেউ কখনও আদর করে নি...”
কথাগুলো বলেই আমাকে ধরে কাঁদতে লাগল অরু । ...বাবা-মা’র কাছে, তাদের আদর-যত্নে বেড়ে উঠেছি বলে, অরুর মত কেউ যে এতোটা খারাপ অবস্থায় বেড়ে উঠে তা আমার ধারণায় আসে নি কখনো ।
সেইবার ছুটি শেষে কলেজে ফিরে যাবার সময় মা আমার হাতে বেশ কিছু টাকা দিয়ে বলে দিলেন, অরুকে যাতে মাঝে মাঝে এখান থেকে কিছু কিছু করে দেই । প্রথমে আমি কারণ বুঝতে না পারলেও পরে বুঝেছিলাম, অরুর নানা রকম খরচের পুরোটা ওর কাকুর পক্ষে দেয়া সম্ভব হয় না । তখন আমি সেই টাকাগুলো থেকে নানা রকম বাহানা করে কিছু কিছু করে দেই ।
এরপর থেকে অরুও আমার মা’কে ‘মা’ বলেই ডাকত । মা ও গর্বভরে বলতেন, আমার দু’টি ছেলে ।
-----------------------------------------------
আকাশ বেশ খানিকটা কালো হয়ে আসছে । বাতাসের বেগ ও বাড়ছে । আমাদের সামনের খোলা জায়গাটার অপর পাশে মহিলারা আছেন । মা ও এসেছেন । অঝোরে কেঁদে যাচ্ছেন । আঁচল দিয়ে চোখ মুছে মুছে সামনের দিকে তাকাচ্ছেন । তারপর আবারও কেঁদে উঠছেন । মা যেখানে তাকিয়ে তাকিয়ে কাঁদছেন, সেখানে একটা ছেলে চুপচাপ শুয়ে আছে ।
ছেলেটার নাম অরিন্দম । অরিন্দম সাহা । আমি ডাকি অরু ।
------------------------------------------------
কলেজে আমি আর অরু হয়ে উঠেছিলাম যেন এক জোড়া । আমাদের বন্ধুত্ব ছিল অটুট । যার কারণে আমি ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়বার সময় যখন, বৃষ্টিতে ভিজে জর বাধিয়ে রুমে ফিরতাম, তখন অরু রাত জেগে আমাকে গালাগাল করতে করতে আমার মাথায় পানি ঢালত । আবার, আমি যখন কলেজের দক্ষিণ দিকের টিলার মত জায়গাটিতে আগুন জ্বালিয়ে ক্যাম্প-ফায়ার করার পরিকল্পনা করি, তখন এই অরু সিনিয়র ভাইদের কানে এসব কথা লাগিয়ে দেয় । আর আমার কপালে জুটত কানমলা । কখনও আমাদের এইসব খুনসুটি হাতাহাতিতে গড়ায় । আবার মিটমাট হতেও দেরী হয় না ।
এভাবে দেখতে দেখতে এইচ এস সি পরীক্ষা এসে গেল । ভালোভাবেই দিলাম । এরপর আমি আর অরু একবার অরুদের বাড়ি মানে, ওর কাকুর বাড়িতে ঘুরে এলাম । ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটা গ্রামের ছোট্ট একটা ঘর ।
অরুর কাকী মারা গেছেন প্রথম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে । বাচ্চাটাও বাঁচে নি । অরুর কাকু আর বিয়েও করেন নি । তাই একা একাই থাকতে হত তাঁকে । আমাদেরকে দেখে উনি খুব ব্যস্ত হয়ে রান্নাবান্নার যোগাড় করতে শুরু করে দিলেন । তাঁকে দেখে তখন বোঝার উপায়ই ছিল না, যে, উনি রাতে মদ খেয়ে তার ভাইপোকে বেধড়ক পেটাতেন । আশ্চর্য রকমের চুপচাপ স্বভাবের মানুষটিকে আমার বেশ ভালোই লেগে গিয়েছিল । অরু যে কেন এতোটা কাকু বলতে পাগল, তা টের পেয়েছিলাম সেদিন ।
আমাদের এইচ.এস.সি’র ফল প্রকাশ হয় । অরু পুরো বোর্ডে তৃতীয় এবং কলেজে দ্বিতীয় স্থান লাভ করে । আমি অতটা না হলেও মোটামুটি ভালো অবস্থানেই ছিলাম । অরুর এরকম ফলাফলে আমার চেয়ে বেশী খুশি আর কেউ হয়েছিল বলে মনে হয় না । প্রায় মিছিল শুরু করে দিয়েছিলাম, ক্যাম্পাসেই ।
জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, আর বেশ কিছু স্থানীয় পত্রিকা থেকে সাংবাদিক আসে অরু এবং হাসান(যে প্রথম স্থান লাভ করেছিল) এর সাক্ষাৎকার নিতে । অরুর সাক্ষাৎকার নেবার সময় আমি কাছেই ছিলাম । অরুকে নানারকম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার পর সাংবাদিকরা একবার জিজ্ঞেস করেছিল, “তোমার এই সাফল্যে কে বেশী অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে বলে তোমার মনে হয় ?” অরু হাসিমুখে উত্তর দিল,
“তাশদীদ মোহাম্মদ রাহাত । আমার বন্ধু ।”
আমি আমার কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । বলে কি ! আমি তো পারলে বই-টই লুকিয়ে রাখতাম ওর । আর আমি নাকি সবচেয়ে বেশী অনুপ্রেরণা যুগিয়েছি ! ভুল শুনলাম নাকি সে ব্যাপারে নিশ্চিত হবার জন্য আরেকটু এগিয়ে গেলাম । অরুকে জিজ্ঞেস করা হল, “তোমার সেই বন্ধুটি কি আশেপাশে আছে ?” অরু তখন হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তে লাগল । আমি বোকার মত এগিয়ে গেলাম সেদিকে । তারপর সেই সাংবাদিক আমার আর অরুর একটা ছবিও তুললেন । আর পরদিন সেই ছবিটি প্রকাশিত হয় স্থানীয় একটি পত্রিকার প্রথম পাতার বামদিকের এক কোণে । যাতে দেখা যায়, হাস্যোজ্জ্বল মুখের একটা ছেলের পাশে অবাক চোখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাকা আরেকটা ছেলেকে ।
----------------------------------------------------
উষ্ণ লাগছে পরিবেশটা হঠাৎ করেই । ঝড় হবে ? আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝা গেল না । পা এর ভর বদল করে পেছনে তাকালাম একবার । পরিচিত মুখ দেখতে পারছি অনেক । ক্যাডেট কলেজের শীলভদ্র স্যার , আজিম স্যারকে চিনতে একটু কষ্টই হল । শীলভদ্র স্যারের মাথায় টাক উকি দিচ্ছে । কলেজ জীবনে আজিম স্যারকে আমরা সবাই খুব ভয় পেতাম । অথচ আজকে স্যারকে আজ কেমন যেন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে । একটু পর পর রুমাল দিয়ে কপাল মোছার ফাঁকে চোখও মুছে নিচ্ছেন । শেষ বয়সে এসে নিজের মাঝে লুকিয়ে থাকা আবেগী মানুষটাকে দেখাতে চাচ্ছেন না হয়তোবা । আমি সামনে তাকালাম । এতো এতো মানুষ যার জন্যে আসছে সে ছেলেটা আমার সামনেই শুয়ে আছে ।

ছেলেটার নাম অরিন্দম । অরিন্দম সাহা । আমি ডাকি অরু ।
-------------------------------------------------------
ঢাকায় এসে ভর্তি যুদ্ধের লড়াই এ ঝাঁপিয়ে পড়লাম । শুরু করে দিলাম লেখাপড়া । কিন্তু তারপরও মাঝে মাঝে “উদাসী রোগ” এ ভুগে ভাবতাম, কোন এক অদেখা, অচেনা কোন অপ্সরীর কথা । যার কারণে, কোচিং এ ভাইয়াদের বলা লেকচার গুলো মাথার উপর দিয়েই যেত বেশীরভাগ সময় । এবারও অরিন্দমই আমার ভরসা রূপে কাজ করতো । ও নিজে যা বুঝত তা আমাকে বোঝাতো । আর যেগুলো আমরা দুজনের কেউই বুঝতাম না, সেইটা রাত জেগে প্রায় গবেষণা করে বুঝতে হত । কেমিস্ট্রি সাবজেক্টটার উপর বেশী গুরুত্ব দিতাম আমরা । আমার মাথা ধরে যেত, ঘুম পেয়ে যেত, হাজার বার শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়েও রেহাই পাইনি আমি অরুর হাত থেকে । যতক্ষণ পর্যন্ত পড়া শেষ না হত, ততক্ষণ আমাকে অরুর পাশে বসে হাই সামলানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হত ।
এক সময় ভর্তি পরীক্ষার সময় এসে যায় । আমার আর অরুর স্বপ্ন ছিল একটাই । বুয়েট । দিলাম পরীক্ষা । এমনকি টিকেও গেলাম ! আমি যে কি পরিমাণ খুশি হয়েছিলাম, বোঝাতে পারবোনা ! অরু যে টিকবেই, সে ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ ছিল না । তারপরও একবার চেক করে নিয়েছিলাম । আমি খুশির ঠেলায় কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না । অরুর এতদিনের অত্যাচার সব মাফ করে দিয়ে আমি ছুটে গিয়ে অরুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম । চিৎকার-চ্যাঁচামেচি খানিকটা কমলে অরুর দিকে ভালো করে তাকিয়ে খেয়াল করলাম, ও মলিন মুখে জোর করে হাসছে । এই হাসি আমার পরিচিত । খানিকটা ভয় ঢুকে গেল আমার মনে ।
আমি ভিড় ঠেলে অরিন্দমকে নিয়ে আসলাম একটু দূরে । জিজ্ঞেস করলাম,
“কিছু হয়েছে ? মন খারাপ কেন ?”
“দেড়টার দিকের বাসের টিকেট নিয়ে এসেছি । রেডি হয়ে থাকিস ।”
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় যাবি ?”
অরু তখন একটু থেমে আস্তে আস্তে প্রায় অস্পষ্ট ভাবে বলল, “আজ সকালে কাকু মারা গেছেন । শেষ দেখাটা দেখতে যাবো ভাবছিলাম ।”
আমি স্তম্ভিত । এত বড় একটা ঘটনা, অথচ অরু একেবারে শান্ত ভাবে কথাগুলো বলছে । অবশ্য ভেতরে ভেতরে ওর মাঝে যে কি হচ্ছে, সেটা সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন । আমি কোনোরকমে ধাতস্থ হয়ে আমাদের ভাড়া করা ছোট ফ্লাটে ফিরে গেলাম । প্রস্তুত হতে লাগলাম । আমি অবাক হয়ে খেয়াল করছিলাম, এত বড়ো একটা ঘটনার পরও অরু এতটা নিষ্পৃহ থাকে কিভাবে ! তবে, পরে কোন একদিন আমিও বুঝেছিলাম অরুর সেদিন কিরকম অনুভূতি হয়েছিল ।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যখন পৌঁছাই, তখন শেষ বিকেল । শশ্মানে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, পোড়ানোর জন্য । পুরোহিতের মন্ত্র পড়ানোর সাথে সাথে অরু ঠাণ্ডা মাথায় ধীরে,সুস্থে মুখাগ্নি করায় । তারপর আগুন ধরিয়ে দেয় । লাশ পোড়ানোর একটা বিকট গন্ধে চারপাশ ভরে উঠে । অরুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ও ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করছে । সে চেষ্টায় বিফল হয়ে একসময় হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদতে থাকে । আমি অরুকে ধরে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে দেখি আমার নিজের চোখই ভিজে উঠেছে । অরু আমার কাঁধে মাথা রেখে সেই ছোটবেলার মত করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, “রাহাত... কাকু অনেক ভালো রে । আমার যখন কেউ ছিল না, তখন কাকু আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিল । অথচ আমি কত স্বার্থপর দেখ... কাকুর জীবনের শেষ সময়টাতেও আমি পাশে থাকতে পারলাম না... কাকুর জন্য আমি কিছুই করতে পারলাম না ...”
অরিন্দমের পিঠে হাত রেখে আমিও নীরবে অশ্রুবর্ষণ করতে লাগলাম । কাঁদুক অরু । মনের কষ্টটা যদি তাতে কিছুটা কমে, মন্দ কি । আমি আকাশের দিকে তাকালাম । মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি উপরওয়ালার কাছে নীরবে প্রশ্ন করছিলাম, আর কত কষ্ট দিবেন ছেলেটাকে ? আর কত ?
---------------------------------------------------
আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি । সেদিনের আকাশ আর আজকের আকাশটার মাঝে পার্থক্য খুঁজছি । মাঝে মাঝে মিল পাই, মাঝে মাঝে পাই না । আনমনে হাতের আঙ্গুল গুলো দিয়ে মাথার চুলগুলোকে আরও এলোমেলো করে দিচ্ছিলাম । একটা সময় পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটা দিয়ে মাটিতে আঁচড় কাটতে লাগলাম । আমার কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল । কেমন যেন... ।
মহিলাদের মাঝে কান্নার রোল হঠাৎ করেই খুব বেশী বেড়ে গেল । আমি সেদিকে তাকাই । মা’কে জড়িয়ে ধরে একটা মেয়ে উদভ্রান্তের মত ফুঁপিয়ে যাচ্ছে । এই কম আলোতেও চিনতে পারি মেয়েটিকে । ফারিয়া । আমার সদ্য পরিণীতা স্ত্রী ।
মনের মাঝের অস্বস্তি ভাবটা যাচ্ছে না । আমি আবারও তাকালাম সামনের দিকে । যে আমাদের সবার কান্নার উৎস, সে ছেলেটার দিকে ।

ছেলেটার নাম অরিন্দম । অরিন্দম সাহা । আমি ডাকি অরু ।
(পরের পর্বে সমাপ্ত)
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

×