মেরামতির পর নদীবাঁধ পাহারায়ও রাত-দিন পার্টিই
অনিকেত চক্রবর্তী
পেশাগত কারণেই ছবি তোলার তাড়নায় সহকর্মী চিত্র সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করছিলেন, ‘আচ্ছা, কোথাও কি নতুন করে ঘরবাড়ি তৈরি হচ্ছে আইলায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য?’
যাঁর উদ্দেশ্যে এই জিজ্ঞাসা, তিনি আবু বক্কর লস্কর। এখানে আসার আগে অবনী রায় বলছিলেন, ‘ওখানে গিয়ে আবু বক্কর লস্করের দেখা পাবে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে ওখানেই পড়ে আছে। কথা বলার ফুরসৎ পাবে কি না, সেটাও প্রশ্ন।’
ঠিকই বলেছিলেন অবনী রায়। সন্দেশখালির বিধায়ক। অন্যদিকে পার্টির সন্দেশখালি জোনাল কমিটির সদস্য আবু বক্কর লস্কর উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষও বটে।
এই জায়গাটা ধামাখালির ‘লাস্ট পয়েন্ট’। ইছামতীর ধারেই জমজমাট ঘাট। লঞ্চ-নৌকা-ডিঙি-ভুটভুটির নোঙর করে ভেসে থাকা। গত সপ্তাহ দেড়েক ধরে এইসব ফেরিতে শুধু যাত্রী পারাপারই হচ্ছে না। চাল-ডাল-চিঁড়ে-গুড়-জামাকাপড়-জলের পাউচ প্যাক- দুধ বস্তা-বস্তা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে লঞ্চ-নৌকায় করে আইলা ত্রাণে। ফলে ভিড় আরো জমজমাট ধামাখালির লাস্ট পয়েন্টে।
ত্রিপল কাপড় দিয়ে, জেনারেটর চালিয়ে আলোর ব্যবস্থা করে ক্যাম্প হয়েছে এখানে। চিকিৎসকরা বলেছেন। হোমিওপ্যাথিক আর অ্যালোপ্যাথিক দুটোই। কারো জ্বর, কারো পেটব্যাথা, কারো চামড়ার রোগ, কারো খারাপ পায়খানা এমন রোগীরা আসছেন। দেখাচ্ছে ডাক্তারদের। ওষুধ নিচ্ছেন।
সেই ক্যাম্পেরই এক প্রান্তে একটা জমাটবাধা ভিড়ের বৃত্তের ঠিক মাঝখানে আবু বক্কর লস্কর। এত ব্যস্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলতে যে, কোথাও নতুন ঘরবাড়ি তৈরি হচ্ছে কীনা আইলা-ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য, প্রশ্নটা তিনি শুনতেই পাননি প্রথমে।
কী করে শুনবেন? ওই ভিড়ের মধ্যে এসেছেন বেড়মজুর ২নং গ্রাম পঞ্চায়েতের দক্ষিণ ঝুপখালি গ্রামের ভোলানাথ দাস। মা মারা গিয়েছেন আইলার ঝড়ে বেসামাল মাটির ঘরের দেওয়াল চাপা পড়ে। সুরতহাল রিপোর্টের জন্য কী করতে হবে, তাঁকে পাখি পড়ার মত বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন আবু বক্কর লস্কর। বেড়মজুর ২নং জি পি চালায় তৃণমূলীরা। যদি প্রধান লিখে না দেয় সুরতহালের কাগজ তাহলে জেলেখালির গ্রাম পঞ্চায়েতের সি পি আই (এম) প্রধান ভাস্বতী আগুয়ার কাছ থেকে যে কীভাবে লিখিয়ে নিতে হবে, তা-ও বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি মাতৃহারা ভোলানাথ দাসকে।
কী করে শুনবেন অন্য প্রশ্ন? ওই ভিড়ের মধ্যে চোঙতলা থেকে আসা যুবকের দলকে বলছিলেন তিনি, ‘কী কী পেয়েছো বলো তোমরা! ৫ হাজার গানিব্যাগ, ৫শো বাঁশ আর ৫০ কোজি পেরেক তো! ঠিক আছে। লোকজন জড়ো করে লেগে যাও। দেখো বাবারা। কাজটা ঠিক করে করো। বাঁধটা ঠিকমত না বাঁধতে পারলে কিন্তু বিপদ হবে। কাজে ফাঁকি দিলে, নিজেরাই ফাঁকে পড়বে তোমরা। খেয়াল রেখো’।
ওই ভিড়ের মধ্যেই এবার আবু বক্কর লস্করের সামনে সন্দেশখালির বিমল সিংহ। তাঁকে নিয়ে পড়েন তিনি, ‘শোন বিমল, গ্রামের লোকজনকে নিয়েই চার-পাঁচটা গ্রুপ করো। এক-একটা গ্রুপ মিনিমাম দেড়শোটা করে ব্যাগে মাটি ভরবে। দেড়ে হাজার ব্যাগে মাটি ভরতে তাহলে বেশি দেরি হবে না। কাল সকালেই কাজটা শুরু দেবে। আমি কিন্তু সাত সকালেই তোমাদের এলাকায় টহল দিতে যাবো। দেখবো যেন কাজটা ঠিকঠাক শুরু হয়েছে।’
ফোন বেজে ওঠে এবার। মোবাইলে বি ডি ও-র কল। আবু বক্কর লস্কর ফোনে তাঁকে বলেন, ‘হ্যাঁ স্যার! আমি যাচ্ছি এক্ষুণি। ...না না স্যার। আসলে এত মানুষ এখানে। কথা না বলে উঠতে পারছি না।.... না না। স্নান খাওয়া হয়নি এখনও!.... তাতে কী হয়েছে!.... আমি যাচ্ছি স্যার। এক্ষুনি। একটু দেরি করুন স্যার। রাখছি স্যার। .... ঠিক আছে।’
এক্ষুণি যাচ্ছি বলেও তক্ষুণি যাওয়ার কি উপায় থাকে তাঁর? এবার নিরাপদ সর্দার সামনে। সি পি আই (এম) জোনাল সদস্য। সন্দেশখালির খুলনা গ্রামে বাড়ি। জল সেই গ্রামেও। তাতেও তিনি থেমে নেই। অন্যদিনের মতই সকালেই বেরিয়েছেন গ্রামের বাড়ি থেকে। প্রথমে গেছেন সন্দেশখালি রুরাল হাসপাতালে। আইলা তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক মানুষ নানা রোগে সেই হাসপাতালে ভর্তি। ৩০টা বেড। তার চেয়ে বেশি রোগী। সমস্যা হচ্ছে। তাই ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলা। সেখান থেকে ধামাখালি পৌঁছবার আগে মণিপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বড় কলাগাছিয়ার গোপালের ঘাটে একবার উপস্থিতি। ওখানে ১০০০ ফিট বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। সি পি আই (এম)-র স্থানীয় নেতা প্রশান্ত নায়েক গণউদ্যোগে নেতৃত্ব দিয়ে সেই বাঁধ বাঁধার পরই অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রেশারের রোগী। দু’দিন ধরে রাতদিন খেটে বাঁধ মেরামতিতে লাগায় এই অসুস্থতা। সেই প্রশান্ত নায়েক কেমন আছে, তা দেখতে যাওয়া একবার গোপালের ঘাটে। গিয়ে নিরাপদ সর্দার দেখেছেন ওখানে বাঁধের কাছেই রেস্ট হাউসে রয়েছে প্রশান্ত নায়েক। কিন্তু নজর বাঁধের দিকে। ধামাখালিতে পৌঁছানোর পরই নিরাপদ সর্দারকে শুনতে হলো আবু বক্কর লস্করের জিজ্ঞাসা, ‘পার্টির পাঠানো রিলিফ মেটিরিয়ালগুলি ডেসপ্যাচ করতে পেরেছো?’ এবার নিরাপদ সর্দার ব্রিফ করেন জোনাল পার্টিতে তাঁর সহযোদ্ধাকে, ‘হ্যাঁ। পেরেছি। কাল তো মণিপুর-আতপুর-গোপালের ঘাটে চাল-চিঁড়ে-গুড় পাঠালাম দুটো বোট ভাড়া করে। একটা বোট ভাড়া নিলো আটশো। আরেকটা হাজার। পার্টির থেকে মিটিয়ে দিয়েছি। আজকেও বোট ভাড়া করে গোরামারী, সিতুলিয়া, আতপুর, বেড়মজুর এক নম্বরে পাঠিয়েছি পার্টির পাঠানো ত্রাণ। তবে বোট ভাড়ার টাকা ছিলো না। ইরান গাজীকে (সন্দেশখালি সি পি আই (এম)-র ৪নং লোকাল কমিটির সম্পাদক।) ফোন করলাম। বললাম দুটো বোটের ব্যবস্থা করো। পাঠিয়েছিল। তা দিয়েই রিলিফ পাঠিয়েছি।’’
নিরাপদ সর্দারের কথা ধৈর্য ধরে শোনেন আবু বক্কর লস্কর। তারপরই খোঁজ নেন পার্টির জোনাল কমিটির আরেক সদস্য অমর বেরার। মীরখালি গ্রামে তার বাড়ি। আইলাতে নিশ্চিহ্ন তাঁর বাড়ি। পরিবার নিয়ে মণিপুর গ্রাম পঞ্চায়েতেই অন্য দুর্গত গ্রামবাসীদের সঙ্গে তিনিও ফ্লাড সেন্টারে। ত্রাণশিবিরে রোজ ৫০০ জন দুর্গতের রান্না খাওয়ার পার্টিগত দায়িত্ব তাঁর উপরেই বর্তেছে। নিজেই দুর্গত তো কী, অন্য দুর্গতদের পাশে তিনি যেন ত্রাতার মতই, সি পি আই (এম) নেতৃত্বের ভূমিকায়। সেই পার্টিনেতা অমর বেরার খোঁজ নিয়েই আবু বক্কর লস্কর এবার যখন উঠতে যাবেন বি ডি ও-র কাছে যাবেন বলে, তখনই ভিড়ের মধ্যেই দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করতেই তাঁর নজরে পড়ল, ধামাখালির এই শেষ পয়েন্টে এলো পি এইচ ই-র পাঠানো জলের পাউচ প্যাক ভর্তি বস্তা বোঝাই লরি। সঙ্গে সঙ্গে অপেক্ষমাণ জনা চল্লিশ কর্মীর দিকে ফেরেন তিনি, ‘আরে বসে আছিস কীরে! যা যা। কোন গ্রামের দিকে কোন লঞ্চে তুলতে হবে জলের বস্তাগুলি, জেনে নিয়ে লরিটা তাড়াতাড়ি ফাঁকা করে দে। হাতে হাত লাগিয়ে লেগে পড়। যা’। কথা শেষ হয় না। ছুটে যায় ছেলেগুলি। তখনই আবু বক্কর লস্করের সামনে এসে পড়ে তালিকা। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদ এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন ত্রাণ পাঠিয়েছে। কটা শাড়ি, কটা ধুতি, কটা লুঙ্গি, কটা জামা তার তালিকা ইউনিয়নের কর্মীরা রাখেন তাঁর কাছে। দেখে নিয়ে সেগুলি পাঠাবার ব্যবস্থা করতে করতেই ফের যেন কার ফোন! কথা বলে ‘এখনই আসছি’ বলে পা বাড়াতেই তাঁর চোখ পড়ে ‘জল সহায়ক’ লেখা নীল টুপি পরা একদল মানুষকে। ‘কী গো, কোন কোন গ্রামে নলকূপ পরীক্ষা হলো আজকে? একটু বলে যাবে? তাহলে জেনে নিয়ে বাকি গ্রামগুলির জন্য পাঠাবার অনুরোধ করবো বি ডি ও কে।’ তাদের কাছ থেকে তালিকা নিয়ে চোখ বুলিয়ে নেন আবু বক্কর লস্কর। তারপরই যেন ফুরসত মিলল সহকর্মী চিত্রসাংবাদিকের জিজ্ঞাসা শোনার, ‘হ্যাঁ, কী বলছিলে? নতুন ঘরবাড়ি? না গো! আরে জলই তো নামেনি এখনও। ঘর হবে কী করে! জানো কি, নদীবাঁধ মেরামত করে তা পাহারাও দিতে হচ্ছে আমাদের!’’
কেন? পাহারা কেন? ভরা কোটালের বিপদ তো এখন কেটে গেছে। ঘূর্ণিঝড় আর আসছে না। তাহলে পাহারা কেন?
‘ওটাই তো খবর! জেলেখালি গ্রাম পঞ্চায়েতটা আমাদের পার্টির পরিচালনায় চলে। আইলা এসে ভাঙাতুষখালিতে ছোট কলাগাছিয়ায় বোয়ালিয়া নদীর বাঁধের যে ৬০০ ফুট ভেঙে দিল, সেই জায়গাটা মেরামতির জন্য পঞ্চায়েত থেকে যেই উদ্যোগ নিলাম, অমনি তৃণমূল এসে বললো, যে জায়গায় এই বাঁধ ভেঙেছে, সেই আসনে আমরা জিতেছি। আমাদের মেম্বার। বাঁধটা আমরা ঠিক করবো। কিন্তু করলো না। আমরা তখন করলাম কি পার্টি থেকেই কর্মী সমর্থক ও আরো মানুকে নিয়ে নেমে বাঁধটা মেরামত করলাম। কিন্তু হলে কী হবে! তৃণমূল হুমকি দিল, বাঁধ কেটে দেব। বুঝলাম ওদের কারবার। তখনই ঠিক করলাম, পাহারা দেব। তাই রাতদিন ওই বাঁধ এখন পাহারা দিতে হচ্ছে পার্টিকে।’’
পার্টির স্থানীয় নেতা দুঃখীরাম শিট-এর নেতৃত্বে তাই রোজ পালা করে ৭জন পার্টিকর্মী রাতদিন পাহারা দিচ্ছেন ভাঙাতুষখালির সেই নদীবাঁধ। যাতে তৃণমূলীরা তা কেটে দিতে না পারে।
কত যে কাজ পার্টির, কত রকম। করতেও হচ্ছে তা পার্টি কর্মীদেরই।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুন, ২০০৯ বিকাল ৪:৫১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



