যে কথা বলা হয় না
অনিকেত চক্রবর্তী
কমরেড রামপদ মাঝির তো তথাকথিত কোনও প্রাসাদোপম বাড়ি ছিলো না।
ছোট্ট একটা ঘর। উপরে চিলেকোঠা। টালির চালা। কোঠায় উঠলে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো যাবে না। ঢুকতেও হবে মাথা নিচু করে। এতটাই নিচু সেই ঘর। ঘরে কোনও আসবাবপত্র নেই। শুধু কয়েকটি বড় মাটির জালা। আর কিছু বাসনপত্র। শোয়ার জন্য দুটো ছেঁড়া মাদুর। স্বামী-স্ত্রী-র এই খেতমজুর পরিবারে দারিদ্র্য এমন প্রকট যে, বাইরে জল পড়ে পড়ে মাটি খসে ছিটেবেড়া বেরিয়ে যাওয়া তাদের ঘরও সেই সাক্ষ্য দিতে কুণ্ঠিত নয়।
সেই কমরেড রামপদ মাঝিকেও ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাতের অন্ধকারে ঘর থেকে টেনে নিয়ে বার করে স্ত্রী আরতির সামনেই নৃশংসভাবে খুন করেছিল মাওবাদীরা বাঁকুড়ার রানীবাঁধ ব্লকের বেথোয়ালা গ্রামে। ভাঙচুর করেছিল সেই ঘরও।
কমরেড রামপদ মাঝির কোনও তথাকথিত প্রাসাদোপম বাড়ি ছিলো না।
কিন্তু পশ্চিম মেদিনীপুরের লালগড় ব্লকের ধরমপুরে সি পি আই (এম) জোনাল কমিটির সম্পাদক অনুজ পাণ্ডের বাড়িটা মাওবাদীরা ভাঙচুর করার সময় বাড়িটা দেখানো হলো। তুলনা করা হলো প্রাসাদের সঙ্গে। বলা হলো, জনগণের টাকা মেরেই এই বাড়ি। প্রশ্ন তোলা হলো, সি পি আই (এম)-র একজন হোলটাইমার হয়ে ৪০ লক্ষ টাকার বাড়ি তাঁর হলো কী করে?
বলা হলো না যে কথা, তা হলো অনুজ পাণ্ডের একান্নবর্তী পরিবারের তিন ভাইয়ের যৌথ সম্পত্তি ওই বাড়ি। অন্য দুই ভাই উজ্জ্বল পাণ্ডে ও মানস পাণ্ডে সি পি আই (এম)-র হোলটাইমার নন। এক ভাইয়ের ধান-সার-কীটনাশক-বীজের ব্যবসা। অন্যভাই নিজের জমিতে নিজেই চাষে খাটেন। ১৮ বিঘা পারিবারিক জমিতে বছরে দু’বার ধান ছাড়াও আলু সবজি চাষ হয়।
বলা হলো, ধানবাদ থেকে নিঃস্ব অবস্থায় এসে অনুজ পাণ্ডে লালগড়ের গ্রামে হঠাৎ ‘বড়োলোক’!
বলা হলো না যে কথা, তাহলো পাঁচ পুরুষ আগে থেকেই অনুজ পাণ্ডের বাবা-ঠাকুরদা বিহার থেকে এসে লালগড়ের এই এলাকায় বসবাস শুরু করেছিলেন। ২৯টি মৌজার মালিকানাসহ বিশাল সম্পত্তি ছিলো পাঁচ পুরুষের সেই পরিবারের। অনুজ পাণ্ডের জন্ম, তাঁর বড় হওয়া এই ধরমপুরেই।
বলা হলো না যে কথা, তা হলো, ধরমপুরে স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ, প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ, গ্রন্থাগার নির্মাণ, পার্টি কার্যালয় নির্মাণ ছাড়াও গোহমী উচ্চ বিদ্যালয় নির্মাণের জন্য বিনা পয়সায় জমি দিয়েছে অনুজ পাণ্ডের যৌথ পরিবার। বলা হলো না যে, নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তির সাড়ে ৩৩ একর জমি খাস করে ৩৩ জন গরিব ভূমিহীন পরিবারকে বিলিয়ে দেয় অনুজ পাণ্ডের যৌথ পরিবার। একাজে নেতৃত্ব দেন অনুজ পাণ্ডে নিজে।
বলা হলো না যে কথা, তা হলো, ৪০ লক্ষ টাকা নয়, বাস্তবে অনুজ পাণ্ডেদের তিনভাই মিলে যৌথ পরিবারের চার ঘরের দোতলা সেই বাড়িটা তৈরি হয়েছে ৯৬৪ বর্গফুট এলাকায়, সাড়ে ৬ লক্ষ টাকা খরচে। বাবা জীবিত থাকতেই বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিলো। কিন্তু নির্মাণ সম্পূর্ণ করতে অর্থের সমস্যা হচ্ছিলো। তাই চার বছর লেগেছে বাড়িটি সম্পূর্ণ করতে। এরই মধ্যে মারা গিয়েছেন বাবা। বাড়ি নির্মাণ সম্পূর্ণ করতে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ করতে হয়েছে ২ লক্ষ টাকা। ছত্রধর মাহাতোর খুড়তুতো দাদা জলধর মাহাতোর রড ও সিমেন্টের দোকানে ধার এখনও ১ লক্ষ ৩ হাজার টাকা। টাকা শোধ হচ্ছে কিস্তিতে। ছোট ভাইয়ের বিয়ে সামনে। তাই বাড়িটিতে রঙ হয়েছে মাত্র ৮দিন আগে।
কিন্তু এসব কিছুই বলা হলো না। কিস্তিবন্দী জীবন না দেখিয়ে দেখানো হলো বাড়ি। বলা হলো জনগণের টাকা মেরে হোলটাইমারের প্রাসাদ! তাই শাস্তি দেওয়া হলো ভাঙচুর করে, লুঠতরাজ চালিয়ে!
তাহলে তো রানীবাঁধের কমরেড রামপদ মাঝির উপর আক্রমণের কোনও যুক্তি ছিলো না। তাঁর তো তেমন বাড়ি ছিল না। তাহলে তো ধনেখালির লনচো মাণ্ডির বাড়িতে চড়াও হয়ে তার স্ত্রী-মেয়েকে পুড়িয়ে মারার কোনও কারণ ছিলো না। তারও তো ‘প্রাসাদ’ ছিলো না।
এরপরেও কেউ কেউ বলছেন, ইনিয়ে-বিনিয়েও বলছেন, ‘তবুও লালগড়ের গ্রামে ওই বাড়ি না বানালেই কি ...।’ চলুন। তাদের নিয়ে যাই খেজুরির গ্রামে। এখন খেজুরিতে তৃণমূলের দখলদারি। ঘরপোড়ানো-লুঠ-জরিমানা চলছেই। এখন খেজুরির কোন গ্রামে সেই সি পি আই (এম) কর্মীটি থাকেন, তার নাম কী, তা প্রকাশ করা গ্রামটির পক্ষেও নিরাপদ নয়। লোকসভা নির্বাচনের আগে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো। দেখেছিলাম সেই পার্টিকর্মীর প্রায় ভেঙে নুয়ে পড়া মাটির দেওয়াল খড়ের চালার সেই ঘর। সেই গ্রামে আশেপাশে অনেক গরিব পরিবার। তাদেরও ঘরের হাল একই। কেউ কেউ নতুন ঘর বানিয়েছেন ইন্দিরা আবাস যোজনার টাকায়। কেউ কেউ সেই টাকা পেয়ে নতুন ঘর বানাতে উদ্যোগী হয়েছেন। কিন্তু এই সি পি আই (এম) কর্মীটি ইন্দিরা আবাস যোজনার টাকা পাননি সি পি আই (এম)-র গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে। কেন পাননি? উনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘পাইনি নয়। আসলে, নিইনি আমিই।’ কেন? তাঁর উত্তর, ‘পঞ্চায়েত দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি ভাবলাম, সি পি এম করি। অন্য গরিবরা পেয়েছে। পাক। কিন্তু আমিও যদি পাই তাহলে এখন যা সময় বিরোধীরা দু চার কথা বলবে, সহ্য হবেনি।’ ফলে তাঁর ঘর ভেঙে নুয়ে পড়া এখনও। পঞ্চায়েত বলেছিল তাঁকে, ‘সি পি এম কর্মী তো কী হয়েছে, গরিব তো তুমি। ঘরটাও খারাপ। নিয়ে নাও তোমার হকের টাকা।’ তিনি তবুও তাঁর অবস্থান থেকে নড়েননি।
সেই সি পি আই (এম) কর্মীটিও কিন্তু এখন ঘরছাড়া। তৃণমূল দখল করেছে খেজুরি। অতএব আরও অনেকের মত তাঁরও থাকার অধিকার নেই।
কেন? তিনি সি পি আই (এম) করেন। তাই।
এটাই হচ্ছে আসল কথা। কমরেড রামপদ মাঝি খুন হয়ে যান, অনুজ পাণ্ডের পরিবার আক্রান্ত হয়, লনচো মাণ্ডির স্ত্রী-মেয়ে খুন হয়ে যান, অভিজিৎ মাহাতোর আর পরীক্ষায় বসা হয় না — এসবের কারণ একটাই। তাদের অপরাধ তাঁরা সি পি আই (এম) করেন। বাড়ি থাকুক বা না-থাকুক, দিন এনে দিন খান বা না-খান, ওসব কোনও কারণই নয়। তারা সি পি আই (এম)। এটাই যথেষ্ট অপরাধ। তারপর ছুতো তৈরিতে কতক্ষণ! কখনও বলা হয় সি পি এম নেতার প্রাসাদ হওয়ার কথা। কখনও বলা হয় সি পি এম হলো হার্মাদ, ডাকাত!
যেমন কমরেড সৈয়দ ভুঁইয়ার কথা মনে পড়ছে এই সময়।
বাঁকুড়া জেলার জয়পুর সি পি আই (এম) জোনাল কমিটির সদস্য ছিলেন। ছিলেন পঞ্চায়েতের নির্বাচিত সদস্য। লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে সেই কমরেড সৈয়দ ভুঁইয়াকে গুলি করে মারলো তৃণমূলী দুষ্কৃতীরা। তিনি টার্গেট ছিলেন আজকের নয়। সেই ২০০০ সাল থেকেই। পাঁশকুড়া লাইনে তৃণমূলীরা ১৯৯৮ সাল থেকে দু-আড়াই বছর ধরে কেশপুর-গড়বেতাসহ বাঁকুড়ার কোতুলপুর-জয়পুরেও যে সন্ত্রাস চালিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে গণ-প্রতিরোধী লড়াইয়ে সৈয়দ ভুঁইয়া ছিলেন অন্যতম নেতা। সাহসী ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী। তাঁকেও আরো অনেকের মতো টার্গেট করেছিল তৃণমূলীরা সেই সময় থেকেই। এতদিনে তাদের সেই উদ্দেশ্য পূরণ হলেও, সেই ২০০০সাল থেকেই তারা তাদের এমন বর্বরতার কাজে আগাম বৈধতা আদায়ের জন্য মিডিয়াকে ধরেছিলো। আনন্দবাজার পত্রিকাকে দিয়ে একদিন বড় করে খবর লিখিয়েছিল সি পি আই (এম) নেতা সৈয়দ ভুঁইয়াকে ‘ভাড়াটে ডাকাত’ আখ্যা দিয়ে। ২১শে জুন ২০০০ তারিখে আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘২৫ হাজার পারিশ্রমিক পেয়ে সৈয়দরা চমকাইতলায়’ শিরোনামে খবরে তৃণমূল লিখিয়েছিল, ‘‘সৈয়দ হলেন সি পি এম-এর অ্যাকশন পার্টির সদস্য।’’ তিনি নাকি ‘ডাকাত’ ছিলেন, এমন কথা জানিয়ে ওই লেখায় আনন্দবাজার সৈয়দ ভুঁইয়ার বয়ানে নিজেদের সাজানো কথা বসিয়ে বলেছিলো, ‘‘কখনওন বৈতল, কখনও মুরুলীগঞ্জ, কখনও নিশ্চিন্তপুর, আবার কখনওখ চমকাইতলায় থাকি। যেখানে আমার দরকার লাগে আর কী! পার্টি এই ট্রিপে আমাদের ২৫ হাজার দিচ্ছে। আমরা ছ’জন এসেছি। কাজ শেষ হলে টাকা নিয়ে কেটে পড়ব।’’ আনন্দবাজার ওই খবরে জানিয়েছিল ‘চমকাইতলা দখলের জন্য’ সি পি এম এইসব ডাকাতকে ভাড়া করেছে।
পেশায় ছোট কাপড়ের দোকান ব্যবসায়ী, পঞ্চায়েত-এর প্রাক্তন প্রধান, পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ তিনি তখন, একটি হাইস্কুলের পরিচালন সমিতিরও সম্পাদক, এমন পরিচিত মানুষটিকে কেন ‘ডাকাত’ আখ্যা দিয়ে আনন্দবাজার খবর লিখেছিল? ওই যে! তৃণমূল যাতে এই লোকটাকে খুন করতে পারে! খুন করার পর ‘ডাকাত’ মরেছে ‘জনরোষে’ — এমন যুক্তি দাঁড় করিয়ে তৃণমূলকেও বাঁচানো যায়, আবার সি পি এম নিধনও সম্পন্ন হয়। তাই আগাম অজুহাত তৈরি করা হয় খুন ও খুনীদের হয়ে। লুঠ- লুঠেরাদের হয়ে।
যেমন হয়েছে অনুজ পাণ্ডের পরিবারের যৌথ সম্পত্তির বাড়িকে ‘অনুজ পাণ্ডের বাড়ি’ হিসাবে দেখিয়ে, ‘রাজপ্রাসাদ’ আখ্যা দিয়ে, ‘জনগণের টাকা মারা’র অজুহাত লিখে!
সেইসব অজুহাতকে অপরাধের বৈধতা দেওয়ার জন্য তর্কের খাতিরে যদি ‘সত্য’ বলে ধরেও নিই, তাহলেও প্রশ্ন জাগে, পারা যায় নাকি এইভাবে চড়াও হয়ে কারো বাড়ি ভাঙচুর করতে?
এই যে কলকাতা টিভি নামে মমতাময়ী টিভি চ্যানেলটির মালিক, ওই চ্যানেলের সংবাদ কর্মীদের পাঁচ মাসের বেতন বকেয়া রেখে এখন যে হাত ধুয়ে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে, বঞ্চিত সংবাদ কর্মীরা যদি এখন ওই মালিকের বাড়ি কিংবা অফিসে চড়াও হয় কুড়ুল, শাবল, গাঁইতি নিয়ে, মিডিয়ায় যারা তৃণমূলী মাওবাদী তারা, কিংবা মিডিয়া জগতে যেসব সহকর্মী এখন ‘অমর সিংহ’ হয়েছেন, তারা এসব মেনে নিতে পারবেন তো!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



