এরপর রব উঠবে, মাওবাদীরা ছিলোই না!
অনিকেত চক্রবর্তী
আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে হবে। কেন্দ্র ও রাজ্যের পুলিসবাহিনী জঙ্গলমহলের মাওবাদী কবলিত এলাকায় পুরোপুরি আইনের শাসন যদি প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তেমন লাশ যদি না পায় রাজ্যের সি পি আই (এম)-বিরোধী শক্তির জোট, মাওবাদী জঙ্গীদের নেতারা যদি পালিয়ে যেতে পারে কোনওভাবে, তাহলেই দেখবেন তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি থেকে শুরু করে তাঁর জোটসঙ্গী বিদ্বজ্জন ও মিডিয়ারা একসুরে রব তুলবে, জঙ্গলমহলে মাওবাদী বলে কোনও গোষ্ঠী আদৌ ছিলো না!
যৌথবাহিনীর অভিযান শুরুর আগেই অবশ্য মমতা ব্যানার্জি চিৎকার করে শুনিয়ে দিয়েছেন, মাওবাদী আবার কী? ওসব মাওবাদী-ফাওবাদী কিছু নেই। সব সি পি এম!
মমতা ব্যানার্জি কলকাতায় বসেই একথা বলেছিলেন। এখনও বলেন। কিন্তু বিদ্বজ্জন বলে অভিহিত যাঁরা, তাঁরা বিদ্বজ্জন বলেই কলকাতায় বসে এমন বলার ঝুঁকি নেননি। অভিনয় তাহলে কাঁচা হয়ে যাবে। পাকা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তো ভালোই জানেন কীভাবে অভিনয় করতে হবে, তারজন্য কীভাবে সেট সাজাতে হবে। অতএব, লালগড়ে যখন যৌথবাহিনীর অভিযান সাফল্যের সঙ্গেই এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বিদ্বজ্জনরা প্রশাসনের বারণ না শুনেই লালগড় ঘুরে এসে এখন তাঁদের মিডিয়ায় লেখালেখি করে বলছেন, কোথায় মাওবাদী? মাওবাদী বলে কী কিছু আছে ওখানে?
ভাবখানা এমন যেন, কপালে সাইনবোর্ড লটকে মাওবাদীরা এসে তাঁদের সামনে দেখা দেবে! তারপর তা দেখে ওঁনারা বুঝবেন, উহারা মাওবাদী! মাওবাদীদের মুখপাত্র গৌর চক্রবর্তীকে সঙ্গে নিয়ে, গণপ্রতিরোধ মঞ্চ নামে মাওবাদীদের ছায়া সংগঠনের নেতা প্রসূন চ্যাটার্জিকে সঙ্গে নিয়ে লালগড়ে গিয়ে ছত্রধর মাহাতোর সঙ্গে দেখা করে কথা বললেও মাওবাদীরা যে আছে, তা বোঝা যায় না। কারণ, তাদের কারো কপালেই যে ‘আমি মাওবাদী’ বলে সাইনবোর্ড লটকানো নেই।
অতএব লালগড় থেকে কলকাতায় ফিরে বলা হচ্ছে, মাওবাদীরা নেই। বিদ্বজ্জন শাঁওলী মিত্র একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকায় তো তাঁর লেখাতেই শিরোনাম দিয়েছেন এখনই, ‘লালগড়ে মাওবাদী কারা? এতদিন কোথায় ছিলেন?’ লেখার ভিতরে ছত্রে ছত্রে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, মাওবাদীদের অস্তিত্ব সম্পর্কেই সন্দেহ রয়েছে তাঁদের। বলেছেন, ‘অনেক ক্ষেত্রেই এরকম সন্দেহ করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’ কেন? শাঁওলী মিত্রের ব্যাখ্যা, ‘লালগড় পৌঁছে হাজার চেষ্টাতেও কোনও চিহ্ন খুঁজে পাইনি।’
অর্থাৎ তিনি লোকমুখে নয়, ‘নিজের অভিজ্ঞতা’ থেকেই এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।
ভালো কথা। আসুন ২০০৭ সালের ১৪ই মার্চ তারিখের ঘটনায়। নন্দীগ্রামে আরো অনেক কিছুর মতো এমনও কাণ্ড নাকি হয়েছিল যে, একটা পুকুরের জল রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। পুলিস নাকি একরাতের মধ্যে পাম্প করে সেই রক্তাক্ত জল হলদি নদীতে ফেলে দিয়ে, নদী থেকে স্বাভাবিক জল ওই পুকুরে রিপ্লেস করে দিয়েছিল। তো, কলকাতা টিভিতে নন্দীগ্রাম নিয়ে এক আলোচনাসভায় শাঁওলী মিত্র যখন এমন কথা বললেন, তখন দুঃশীল বুদ্ধিজীবী অনিন্দিতা সর্বাধিকারী তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি কি বিশ্বাস করেন এমন ঘটনা? নিজে দেখেছেন? উত্তরে শাঁওলী মিত্র বলেছিলেন যে, তিনি নিজে দেখেননি কিন্তু তা বিশ্বাস করেন কারণ, একজন সাংবাদিক তাঁকে এমন ঘটনার কথা বলেছিলেন!
পরের মুখে ঝাল খেয়ে অসত্য কথা বলা যে ধরা পড়ে যায়, তা ভেবেই হয়তো ওই বিদ্বজ্জনরা এবার লালগড় অভিযানের সময়ই ওখানে গিয়েছিলেন। আর ফিরে এসে বলছেন, যেমন শাঁওলী দেবী লিখেছেন ‘কোথায় মাওবাদী’? অথচ যা বলছেন বা লিখছেন, এরজন্য টাকাপয়সা খরচ করে (হোক না অন্যের টাকা, তবুও খরচ তো!), তারজন্য গরমে এত কষ্ট করে লালগড় যাওয়ার কোনও দরকারই ছিলো না। বামফ্রন্ট ৩২ বছরে কিছু করেনি, মাওবাদীরা নেই লালগড়ে, যা হচ্ছে তা আসলে জনরোষ—এমনসব সস্তা কথা বলার জন্য লালগড় যাওয়ার কোনও দরকারই ছিলো না। কলকাতায় বসেই বলা যায়। প্রচারের জন্য মিডিয়া তো আছেই।
কিন্তু সমস্যা হলো, যে পত্রিকায় নিজের কলমে শাঁওলী দেবী লালগড়ে মাওবাদীদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যেদিন, ঠিক তার ২৪ ঘণ্টা আগেই একই পত্রিকায় একটি লেখায় ওই পত্রিকারই সাংবাদিক ‘লালগড় : গণতন্ত্র এখন প্রশ্নচিহ্নের মুখে’ শিরোনামে একটা লেখায় লালগড়ে যে মাওবাদীরা আছে, ভালোভাবেই আছে, সেটাই শুধু লেখেননি, কী কী অপকর্ম করছে তারা, সেই তথ্য দিতেও বাধ্য হয়েছেন। ওই সাংবাদিক ওই লেখায়, ‘খুনোখুনির রাজনীতিতে বরাবরই ওস্তাদ’ মাওবাদীরা কীভাবে ছত্রধর মাহাতোকে সামনে রেখে পুলিসী সন্ত্রাসবিরোধী জনসাধারণের কমিটি গঠন করলো, ‘জমি ফিরে পেলেই যে হবে না, প্রতিপক্ষকে শেষ করতে হবে’ বলে মাওবাদীরা কাকে কাকে কীভাবে খুন করলো, তার বিবরণ দিয়ে অবশেষে দিয়েছেন স্বীকারোক্তি, ‘‘...নিরঙ্কুশ আধিপত্য ক্রমশ দুর্বিনীত করে তুললো জনগণের কমিটির আড়ালে থাকা মাওবাদীদের। জঙ্গলমহলে ছোট দোকানদার থেকে ইন্ডিয়ান অয়েলের ডিলার, সবার থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ থেকে অন্তত দু’শো টাকা পর্যন্ত তারা তোলা তুলতে শুরু করলো। মদতদাতাদের এই ভূমিকায় উৎসাহ পেল জনগণের কমিটির ছোটখাটো সদস্যরা। চমকে টাকা আদায়ের সহজ রাস্তায় নেমে পড়ল তারা। কেবল টাকা নয়। চুরি-ছিনতাইও শুরু হলো। শুক্রবার পীড়াকাটায় ওরাই ছিনতাই করেছিলো সাংবাদিকদের চারটে মোবাইল ও পাঁচশো টাকা।... ভেতরে ভেতরে ক্ষেপে উঠলেন বেলপাহাড়ি-বাঁশপাহাড়ির মানুষ। তোলাবাজির জন্য জনতার বেদম মার খেল জনগণের কমিটির কানাই ভৌমিক। একই কারণে শিলদায় আরো একবার জনতার আড়ং ধোলাই খায়। জঙ্গলমহলে টহল মেরে দেখা গিয়েছে ৭৫ শতাংশ এখন জনগণের কমিটির বিরোধী। কিন্তু মাওবাদীরা বন্দুকের নলকে ক্ষমতার উৎস বলে মনে করে। কেউই স্বতঃস্ফূর্তভাবে কমিটির বিরোধিতায় আসতে পারছে না।...গত একমাস বেলপাহাড়িতে বিভিন্ন ইস্যুতে ২৪ ঘণ্টা বন্ধ হয়েছে। খাবারের সঙ্কট, জলের সঙ্কট, পরিবহন বন্ধ, স্কুল, দোকান, বাজার বন্ধ। মানুষ তিতিবিরক্ত হয়ে উঠলো। ...প্রশ্ন হলো, কেশপুরে সি পি এম যদি সন্ত্রাস করে থাকে, তাহলে শ্রেণী সংগ্রামের নামে জনগণের কমিটি জঙ্গলমহলে কী করছে?’’
এই হচ্ছে সি পি আই (এম)-বিরোধী বাংলা দৈনিক স্টেটসম্যানের প্রতিবেদন। আর সেই পত্রিকাতেই শাঁওলী মিত্র লিখছেন, কোথায় মাওবাদী? চিহ্ন পেলাম না!
তবে এমনই হয়। হতে হয়। তালজ্ঞান থাকে না। যেমন রবিবারই দেখুন। তৃণমূলের মুখপত্র প্রতিদিন পত্রিকা ‘লালগড় কাণ্ড কেন, আসল লাভ কাদের’ বলে একটি লেখায় অনেকটা শাঁওলী মিত্রের মতোই লালগড়ে মাওবাদীদের আড়াল করতে প্রশ্ন তুলেছে, ‘সত্যিই যদি মাওবাদীরা এত বিপজ্জনক, তাহলে পুলিস কীভাবে বাহিনী নিশ্চিন্তে এগলো?’
কিন্তু বাহিনী কি নিশ্চিন্তে এগোচ্ছে? প্রতিদিন পত্রিকায় রবিবারই পাশেই আরেকটা প্রতিবেদন, যা কীনা ওদের সাংবাদিক ‘রণাঙ্গন’ থেকে পাঠিয়েছেন, তাতে কী আছে? সেখানে মাওবাদীরা যে ছিল এবং আছে, তা জানিয়েই বিবরণ দেওয়া হয়েছে এইভাবে, ‘‘গোয়ালতোড়ের বাহিনী মাইন ও গুলির লড়াইকে অগ্রাহ্য করে কাদাশোল, মহুলতলা, চৌবিশোল এবং সুকুমাশুলির জঙ্গল এলাকা পেরিয়ে রামগড় দখল করতে সক্ষম হলেও লালগড়ের দিক থেকে আসা বাহিনী দু’টি মাইন ও কয়েক রাউন্ড গুলির প্রতিরোধের মুখে পড়ে মাত্র ৩ কিমি এগিয়ে ফের পিছু হটে চলে আসে থানায়।’’
মাওবাদীরা নেই? নিশ্চিন্তে এগোচ্ছে যৌথবাহিনী?
প্রতিদিনের স্পট রিপোর্টে বলা হচ্ছে, ‘‘শুক্রবার গোয়ালতোড় থেকে কাদাশোল আসার পথে তমাল খাল পার হয়ে যে ডাইরেকশনাল মাইনটি পেয়ে বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াড নিষ্ক্রিয় করেছিলো, সেটা পশ্চিমবঙ্গে প্রথম দেখা গেল বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। শুধু তাই নয়, জিলেটিন জেন ভর্তি এই মাইনটি ফাটলে তা একসঙ্গে ৩০ জনের প্রাণ নিত বলেই শঙ্কা বাহিনীর।’’
নিশ্চিন্তে এগোচ্ছে বাহিনী? মাওবাদীরা নেই?
স্পট রিপোর্ট করছে প্রতিদিন, ‘‘যখন বাহিনী এগোচ্ছে, সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ মুহুলতলার জঙ্গল থেকে ছুটে আসতে থাকে গুলি।...দুধারের জঙ্গলের আনাচে-কানাচেও মাইন ফাটার আওয়াজ কানে আসে।’’
মাওবাদীরা নেই? নিশ্চিন্তে এগোচ্ছে বাহিনী?
লালগড় কাণ্ড কেন, সেই প্রশ্ন তুলে বলা হয়েছে মাওবাদীরা যখন জঙ্গলমহলে ঘাঁটি করছিল, তখন সি পি এমের সংগঠন কী করছিল? কেন জানতে পারেনি? কিন্তু বলা হয়নি যে, জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের এই ঘাঁটি করতে সি পি এমের সংগঠন বাধা দিচ্ছিল বলেই আজ পর্যন্ত সি পি আই (এম)-র ৭৩ জনকে খুন করেছে মাওবাদীরা। এমনিতেই খুন করলো ওরা?
আসলে মাওবাদীরা জঙ্গলমহলে আছে কীনা, ওরা কেমন ভয়ঙ্কর, তা জানার জন্য শাঁওলী মিত্ররা যেতে পারেন আনন্দবাজার পত্রিকার চিত্র সাংবাদিক সৌমেশ্বর মণ্ডলের কাছে। আনন্দবাজার যে কেমন সি পি আই (এম)-বিরোধী তা সবাই জানেন। সেই কাগজের চিত্র সাংবাদিকও তাঁর চোখ হারিয়েছেন মাওবাদী ল্যান্ডমাইনে। জঙ্গলমহলেই। পরদিন আনন্দবাজার মাওবাদীদের বিরুদ্ধে কলম কড়া হাতে ধরতে বাধ্য হয়েছিল। মাওবাদীদের মাইন বিস্ফোরণে জঙ্গলমহলে নিহত ডাক্তার-নার্সদের কথা ছেড়ে দিলাম।
শাঁওলী মিত্ররা সেই সৌমেশ্বর মণ্ডলের কাছে গিয়ে বলুন, মাওবাদী কোথায়?
উত্তর পেয়ে যাবেন।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



