‘হুঁশিয়ারি’ কী ও কেন
অনিকেত চক্রবর্তী
‘‘বিরুদ্ধ মত প্রকাশে অক্লান্ত পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন চ্যানেলের নাম উল্লেখ করে সি পি এমের যে কাউন্টার রিপোর্ট, তার ভাষা, ভঙ্গি প্রায়শই বিশুদ্ধ ‘Threatening’। এবার রাস্তায় নেমে হুঁশিয়ারি। এরপর কি বলপ্রয়োগ?’’
আনন্দবাজার পত্রিকায় ১২ই আগস্ট ’০৯ চতুর্থ পৃষ্ঠায় এভাবেই বক্তব্য পেশ করেছেন একজন লেখক। তাঁর লেখায় শিরোনাম ‘হেস্টিংস থেকে বামফ্রন্ট হুঁশিয়ারি দেওয়া চলছে’। লেখাতে ২২৯ বছর আগে ভারতে ব্রিটিশ বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস কীভাবে ‘বেঙ্গল গেজেট’ পত্রিকার মালিক-সম্পাদক জেমস অগাস্টাস হিকিকে ‘টাইট’ দিয়েছিলেন, তার তথ্যাদি পরিবেশন করেই, একলাফে তিনি পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট আমলে চলে এসেছেন। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে গোছের সিদ্ধান্ত টেনে তিনি তফাৎ করেছেন এইভাবে যে, ‘ওয়ারেন হেস্টিংস প্রশাসন সরাসরি গলা টিপে ধরেছে, আর বামফ্রন্ট আপাতত হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে।’
কেন তাঁর এমন কথা মনে হয়েছে? তিনি নিজেই তাঁর লেখাতে ২১শে জুলাই ’০৯ তারিখে আনন্দবাজার পত্রিকাতেই প্রকাশিত একটি সংবাদের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ‘রাস্তায় নেমে এবার সরাসরি সংবাদ মাধ্যমকেই হুঁশিয়ারি দিলো বামফ্রন্ট’ শিরোনামের ওই লেখায় আনন্দবাজার লিখেছিলো, ‘বামফ্রন্টের (মূলত সি পি এমের) এগারোটি ছাত্র-যুব সংগঠন ধর্মতলায় সমাবেশ ডেকে জানিয়ে দিলো, পশ্চিমবঙ্গে বিরোধীরা নৈরাজ্য সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। আর সেই নৈরাজ্যে মদত দিচ্ছে সংবাদমাধ্যমই। একদিকে নৈরাজ্যে মদত, অন্যদিকে আবার প্রশাসনকে কড়া ব্যবস্থা নিতে প্ররোচনা এই রকম দ্বৈতভূমিকা নিয়ে তারাও রাজ্যে সাতের দশক ফেরানোর চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ তাঁদের।’’ সংবাদের এই উদ্ধৃতি দেখিয়ে লেখক মনে করিয়েছেন ওয়ারেন হেস্টিংস-এর কথা। তুলনা টেনেছেন হেস্টিংস প্রশাসনের সঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের।
কোনভাবেই এমন তুলনা আসে না। তবুও লেখক যে এমন তুলনা টেনেছেন, সেটাই প্রমাণ করছে রাজ্যে বামফ্রন্ট-বিরোধী নৈরাজ্য সৃষ্টিতে সংবাদমাধ্যমকেও অভিযুক্ত করে ছাত্র-যুবদের অভিযোগ কত বাস্তব। এবং এটাও বাস্তব যে, এমন হাস্যকর ও প্ররোচনামূলক বক্তব্যসহ লেখা পেশ করার পরও লেখক বামফ্রন্ট আমলে যথারীতি শান্তিতেই বসবাস করতে পারবেন, আরো এমন লেখা লিখতে পারবেন। কেউ তাঁকে কিছু করবে না। সাতের দশকে কংগ্রেসী আমলে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় যেমন আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্ত ও গৌরকিশোর ঘোষকে কংগ্রেস-বিরোধী লেখার দায়ে জেলে পাঠিয়েছিলেন, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আরো রোষানলে পড়ার ভয়ে আনন্দবাজার যেমন সেই গ্রেপ্তারের খবর পর্যন্ত ছাপার সাহস করেনি — তেমন কোনও ঘটনা ঘটবে না এই রকম লেখকদের ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট আমলে। সাতের দশকে কংগ্রেসী জমানায় কেন গণশক্তিতে বিজ্ঞাপন দিয়েছে বোরোলিন কোম্পানি, সেই ‘অপরাধে’ বোরোলিনের কোম্পানিতে কোনও কারণ ছাড়াই স্রেফ ভয় দেখাতে, গণশক্তিতে বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করাতে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় যেমন খানা তল্লাশি চালিয়েছিলেন — তেমন কোনও ঘটনা ঘটবে না এইরকম লেখক ও তার পত্রিকার ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট আমলে। হবে না প্রেস সেন্সরশিপ। রাইটার্সে গিয়ে আগে দেখাতে হবে না কী ছাপা হবে পরদিন সংবাদপত্রে। যেমন করতে হতো কংগ্রেসী আমলে জরুরী অবস্থায়।
এটা জানেন ওই লেখক এবং তাঁর পত্রিকাও। তাই নির্ভয়ে যা খুশি তা-ই করা, যা খুশি তা-ই লেখা অনায়াসে চলে বামফ্রন্ট আমলে। অবাধ গণতন্ত্রের এমন বাস্তবতাই কার্যত আনন্দবাজারে এদিনের ওই লেখাকে বিদ্রূপ করছে। মুখোশ খোলার জন্য গণশক্তিতে আরেকটি পালটা লেখা লিখে বা কাউন্টার রিপোর্ট ছাপিয়ে ‘Threatening’-এর প্রয়োজন নেই। তবুও কলম ধরতেই হলো গণশক্তিতে। তার কারণ, দুটো গুরুত্বপূর্ণ অথচ প্রাসঙ্গিক তথ্য সচেতনভাবেই গোপন করেছেন ওই লেখক আনন্দবাজারে তাঁর লেখায়। একটা হলো, সাতের দশকে আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসে কীভাবে কংগ্রেসীরা সংবাদমাধ্যমের গলা টিপে ধরেছিল ওয়ারেন হেস্টিংসকেও হার মানিয়ে, সেটা উনি একদম চেপে গিয়েছেন। চাপার জন্যই হেস্টিংস-এর আমল থেকে একলাফে বামফ্রন্ট আমলে পাড়ি দিতে হয়েছে তাঁকে। আরেকটা যে তথ্য চেপে গিয়েছেন তিনি তা হলো, ছাত্র-যুবরা কেন ২০শে জুলাই ধর্মতলায় রাস্তায় নেমেছিল, রাস্তায় নেমে তাদের যে কথাকে হুঁশিয়ারি বলে মনে হয়েছে ওই লেখকের!
কেন ছাত্র-যুবরা ২০শে জুলাই নেমেছিলো রাস্তায়? সেই কারণটা অবশ্য আনন্দবাজার পত্রিকায় উল্লেখ করলে লেখাটা ছাপতোই না আনন্দবাজার। লক্ষ্য করবেন, আনন্দবাজার তাদের ২১শে জুলাইয়ের খবরেও ছাত্রযুবদের রাস্তায় নামার মূল কারণটা অনুল্লেখ রেখেই হুঁশিয়ারি সংক্রান্ত তথ্য পরিবেশন করেছে! ছাত্রযুবরা রাস্তায় নেমেছিলেন ২০শে জুলাই কারণ, ১৭ই জুলাই প্রথম পাতায় আনন্দবাজার গোষ্ঠীরই টেলিগ্রাফ পত্রিকা তাদের প্রথম পাতায় কম্পিউটারের প্রযুক্তি কৌশল ব্যবহার করে মুখ্যমন্ত্রীসহ রাজ্যের মোট পাঁচজন শীর্ষ প্রশাসনিক কর্তার শাড়ি পরান ছবি ছেপেছিল সভ্যতা-ভদ্রতা-সৌজন্য সব কিছু বিসর্জন দিয়ে। এরপরও বলা হয়, এরাজ্যে গণতন্ত্র নেই! এরপরও বলা হয়, কণ্ঠরোধ হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের। এরপরও বলা হয়, থ্রেটনিং হচ্ছে! স্মরণ করা হবে ওয়ারেন হেস্টিংসকে! অথচ ওই ছবির পরিবেশনা একদিকে মহিলাদের কাছেও অপমানসূচক ছিলো। সব মিলিয়েই তাই ছাত্রযুবরা ধর্মতলায় রাস্তায় নেমেছিল প্রতিবাদ জানাতে। ক্ষোভ প্রকাশ করতে। পত্রিকা অফিস তো ভাঙচুর করতে যায়নি! আমরা অনেকেই কী করি? আমাদের ঘরের ছেলেপিলেরা যদি দেখি স্কুলে পড়াশুনায় ফাঁকি দিচ্ছে, তাহলে কেউ কেউ আমরা সেই ছেলেমেয়েকে মারধর করে শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু এই পথ ঠিক নয় বলে আমরা অনেকে করি কী, সন্তানকে বলি, শোন হে বাপু! এই যে ফাঁকি দিচ্ছো, এতে ভবিষ্যতে নিজেই ফাঁকে পড়ে যাবে। কেউ বাঁচাতে আসবে না। নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনবে ....।
এই যে কথাগুলি বলা, সন্তানকে অন্যায়ের পথ থেকে সরিয়ে আনার জন্য, এটাকেই কেউ কেউ ‘হুঁশিয়ারি’ মনে করতে পারেন! কিন্তু শেষ বিচারে এটা সন্তানকে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কেই খেয়াল করিয়ে দেওয়া। বাবা-মা তা না করলে পাড়াপ্রতিবেশীরাও এমন হুঁশিয়ারি দেন। যেমন ছাত্রযুবরা সেদিন ধর্মতলায় সমাবেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির মদতদানের অভিযোগ জানিয়ে একাংশের সংবাদমাধ্যমের সমালোচনা করে আনন্দবাজার গোষ্ঠীর উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘প্রশাসনের সমালোচনার অন্য কোনও ভদ্রসভ্য রীতি জানা ছিলো না? ভদ্রতা সভ্যতার পাঠ জানা না থাকলে, বললে তো আমরাই শেখাতে পারি। আপনাদের আচরণে যে অসহিষ্ণুতা প্রকাশিত হয়েছে, তাতে আপনাদের চিন্তন, মনন, রুচিবোধের দৈন্যতাই প্রকাশিত হয়েছে!’ ব্যস! এতেই আনন্দবাজারের মনে হয়েছে এই ‘হুঁশিয়ারি’ হলো ‘সংবাদমাধ্যমের গলা টিপে ধরা ... হেস্টিংস যেমন করতেন ... এরপর কি বলপ্রয়োগ! কণ্ঠরোধী আইন?’। এই মনে হওয়ার সময় একবারও আনন্দবাজারের মনে হয়নি সাতের দশকে জরুরী অবস্থা ও সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের তুলনার কথা! কী ভয় এখনও! অথচ নির্ভীক, নিরপেক্ষ!
যাক, সেই কথা। বরং আনন্দবাজারও যে নৈরাজ্যে মদত দেয় ভবিষ্যৎ না ভেবে, সেই নৈরাজ্যে আনন্দবাজারও যে আক্রান্ত হয়, তারপর আনন্দবাজারেরও যে বোধদয় হয়, এর সবকটা উদাহরণই একটি ঘটনায় আনন্দবাজারের পাতার একটি লেখা থেকেই আজ মনে করিয়ে দেওয়া যাক। ২০০৬ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের মাইন বিস্ফোরণে নিজের চোখ হারিয়েছিলেন আনন্দবাজারের চিত্র সাংবাদিক সোমেশ্বর মণ্ডল। তখন মাওবাদী নেতা সোমেনের উদ্দেশে আনন্দবাজার পত্রিকায় ২৬শে সেপ্টেম্বর একটি খোলা চিঠি বেরিয়েছিল ‘এইভাবে আপনারা গরিবের ভালো করবেন?’ শিরোনামে। তাতে একটা জায়গায় আনন্দবাজার কী স্বীকারোক্তি করেছিল, তা আজও প্রাসঙ্গিক। লিখেছিল ওরা মাওবাদীদের উদ্দেশে, ‘‘.... জানেন, এতদিন বুঝিনি। মেনে নিতে দ্বিধা নেই। আপনাদের পুঁতে রাখা মাইনে এতবার যখন সাধারণ নিরীহ পুলিসকর্মীদের মৃত্যু হয়েছে, তখন তো মন ভিতরে ভিতরে এতটা নাড়া দেয়নি? উলটে মনে হয়েছে, যাক। এই পুলিসকে, এই সরকারকে নাড়া দিতে তো কেউ না কেউ সফল? কোনও না কোনওভাবে? কিন্তু আজ আঘাত তো আমাদের ঘরে। তাই মনে হচ্ছে, সোমেনবাবু, আপনারা এতদিন ঠিক কী বিপ্লব করেছেন? এটা যদি আজ স্বীকার না করে নিই, তাহলে কাল থেকে সাধারণ মানুষ আমাদের বলতে শুরু করবে, আপনি মানুষ না সাংবাদিক?’’
কেন হুঁশিয়ারি দিতে হয় রাস্তায় নেমে, তা বোঝাতে এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কী হতে পারে? না। বলপ্রয়োগ হবে না। কণ্ঠরোধও হবে না। নিশ্চিত থাকুন। তবে এটা জানি, হুঁশিয়ারিতেও কাজ না হলে, নিজের ঘরেই আঘাত আসার পর বোধদয়ের সময় ফের একবার আসবেই।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



