শহীদকন্যার পড়ার খাতার লেখা দেখে জল আসে চোখে
অনিকেত চক্রবর্তী
আচমকাই ভীষণ অসহায় বোধ করতে থাকি। চেষ্টা করি আটকাতে। কিন্তু পারি না। দু’চোখের কোল বেয়ে নেমেই আসে জলের ধারা। বুঝতে পারি, এখানে আর বসে থাকা অসম্ভব। সহকর্মী রাজীব চৌধুরীকে বলি, ‘চল্, আর পারছি না এখানে থাকতে।’ সে অবাক। মৃদু স্বরে বলে সে, ‘উঠে যাবে এখনই? কথা তো তেমন হলোই না এখনও।’ কোনোমতে মাথা ঝুঁকিয়ে তাকে জানাই, হ্যাঁ। উঠে যাবো। চল্।
কী করে তখন বোঝাই আমার সহকর্মীকে যে, একটা খাতার পাতা আমার ভিতরের সব কিছু তছনছ করে দিচ্ছে! ঘটনার সময়কে বুঝতে সাংবাদিকতার পেশাগত দায়কে ঘিরে থাকে যে আপাত কাঠিন্য ও উদাসীনতা কিন্তু একই সঙ্গে থাকে কীভাবে কী হয়েছে তার সমস্ত তথ্য সংগ্রহের মরিয়া প্রয়াসও, সেইসব কিছু ভেঙে চুরমার করে দিয়ে সেই খাতার পাতার একটা লেখা আমাকে নিষ্ঠুরভাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে পিতাকে হারানো শহীদ কন্যার অপরিসীম যন্ত্রণার মুখোমুখি। এখনও ভুলতে না পারা সেটা এমন যন্ত্রণা যে, মনে হয় এখনই স্তব্ধ হয়ে যাবে জীবনের সব ধর্ম।
অথচ বুধবার পঞ্চমীর সকালে বহরমপুর শহরের পূর্বে কৃষ্ণমাটিতে এই বাড়িতে ঢোকার সময়ও মনে হয়নি যে এমন হবে! ভাগীরথী নদীর ধার ঘেঁষে বাইপাস পিচ রাস্তার সড়ক থেকে নেমে, কৃষ্ণমাটির এই বাড়িতে ঢোকার সময়, সরু গলিতে পরপর নয়নতারা ফুলের গাছকে বাঁ পাশে রেখে, দরজায় কড়া নেড়েছি যখন, তখনও মনে হয়নি, এখনই ফিরে আসতে হবে এই বাড়ি থেকে।
এই বাড়িতে পৌঁছাবার আগে, ওই পিচ রাস্তার ধারেই তো একটু তফাতে যেখানে দেশবন্ধু সেবক সমিতি নামে ক্লাব, তার পিছনে ফাঁকা মাঠের দেয়াল ঘেঁষে গুলি আর বোমায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যে মাটিতে পড়েছিল কমরেড গোপাল মণ্ডলের মৃতদেহ, সেই জায়গাটা দেখে এসেছি। কষ্ট হয়েছে দেখে। কিন্তু তখনই মনের ভিতরে এমন ভাঙচুর হয়নি।
ওই যে একটু দূরে, ভাগীরথীর যে বাঁধ সেই বাঁধের উপর দিয়েই দুটো মোটর সাইকেলে চড়ে দু’জন আততায়ী সেদিন এসেছিল এখানে। বটগাছের গুঁড়ির পাশ দিয়ে মাঠে নেমে, গোপাল মণ্ডলের একবারে কাছে পৌঁছে প্রথমে গুলি, তারপর বোমা মেরেছিল আততায়ীরা। দিনটা ছিলো এই বছরেরই ১৮ই মার্চের দুপুর! অকুস্থল ঘুরে এসে, কাছেই যে শারদ উৎসবের প্যান্ডেল বাঁধার আয়োজন চলছে, তার সামনে দিয়ে বেরিয়ে, পিচরাস্তায় উঠে বিপরীতে একটি মাটির বাড়ির দেয়ালে চোখেও পড়েছে সি পি আই (এম)-র দেয়াল লেখা, ‘কমরেড গোপাল মণ্ডলের খুনীদের শাস্তি চাই।’ ওখানেই শুনে নিয়েছি, বহরমপুরের এই হরিদাসমাটি, অযোধ্যানগর, ভাকুড়, মণীন্দ্রনগর এলাকায় জমিজমা বেআইনীভাবে কবজা করতে সক্রিয় অধীরবাহিনী এবং তার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সি পি আই (এম)-র বহরমপুর পূর্ব লোকাল কমিটির সম্পাদক কমরেড গোপাল মণ্ডল। তাই তাকে খুন হতে হয়েছে। মন খারাপ হয়েছে শুনে। কিন্তু তেমন ভাঙচুর তখনও কিছু হয়নি মনের ভিতরে।
এরপরই কৃষ্ণবাটিতে এসে শহীদ পরিবারের দরজায় কড়া নাড়া। শহীদের স্ত্রী কমলা মণ্ডল ছিলেন না বাড়িতে। বাজারে গিয়েছেন। শহীদ কন্যা কাবেরী মণ্ডলও বাড়িতে নেই। পড়তে গিয়েছে। দরজা খুলে দিয়েছিল সুপ্রিয় মণ্ডল। মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৬৯ শতাংশ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ শহীদ পুত্র সুপ্রিয় এখন বলরামপুর স্কুলে উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র কলা বিভাগে। ঘরে বসে যখন তার সঙ্গেই কথা বলছিলাম, তখনও মনে হয়নি একটু বাদেই একটা খাতা দেখে ভেঙেচুরে যাবে ভিতরটা। সুপ্রিয় বলছিল, ‘‘বাবা রোজ সকালে বেরিয়ে যেত। দু’চাকায় চেপে। পার্টির কাজে। কোনোদিন দুপুরে ফিরতো। কোনোদিন ফিরতো না। যেদিন দুপুরে ফিরতো, একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করতাম। পুজোর সময় বাবা মোটর সাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে যেত চুয়াডাঙা মোড়ে। ওখানেও একটা পুজো হয়। ওখানে বুক স্টল দেয় পার্টি। সেখানেই নিয়ে যেত বাবা। ....যেদিন বাবা খুন হয়ে গেল, দিদির উচ্চমাধ্যমিকের ইংরাজী পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষা দিয়ে দিদি বাড়ি ফিরেছিল। বাবা দিদির সঙ্গে একসঙ্গে বসে দুপুরের খাওয়া দাওয়া করেছিল। তারপর বেরিয়ে গিয়েছিল বাবা। আমিও কাছেই সেদিন রাস্তায় ছিলাম। কিন্তু পরে শুনি, দেশবন্ধু ক্লাবের সামনে খুন হয়েছে। সবাই মিলে গিয়ে দেখি, বাবা! বাবা খুন হয়েছে।’’
শহীদের পুত্র খোলাজানালা দিয়ে তাকিয়ে বলতে থাকে কথাগুলি। জানালার বাইরে এক খণ্ড মাঠ। তাতে ঠিক ছ’খানা কাশফুল। সবকটা নুয়ে পড়া। দূরে প্যান্ডেলের বাঁশ বাঁধা চলছে। সুপ্রিয়র কথা থামতেই ঘরে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা। মাথার উপর ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানের আওয়াজ যেন আরো বেশি বিষণ্ণতাকে উসকে দিচ্ছিল। সেই ফ্যানের হাওয়াতেই চৌকির সামনে পড়ার টেবিলের ওপরে রাখা খাতা বইগুলির পাতা উড়ছিলো। অস্বস্তি কাটাতে সুপ্রিয়’র দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে টেবিল থেকে একটা খাতা তুলে নিই। ফুলস্কেপ পাতার খাতা। মলাটে নাম লেখা ইংরাজীতে ‘কাবেরী মণ্ডল। বহরমপুর কলেজ। ইকনমিক্স (ম্যাক্রো)’। মলাট উলটাই আনমনে। খাতার প্রথম পাতা। খবরের কাগজে প্রথম পাতায় বড় খবরগুলির হেডিং-এর অক্ষরগুলির আকার যেমন, তেমনই বড় বড় অক্ষরে ইংরাজীতে নীল কালির ডট পেনে প্রথমে লেখা, ‘‘বাবা, ডো’ন্ট ফরগেট মি।’’ পড়ে বুকের ভিতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠে। সুপ্রিয়কে জিজ্ঞাসা করি, তোমার দিদি কোথায়? সুপ্রিয় বলে, ‘দিদি পড়তে গেছে।’ শহীদকন্যার পড়ার খাতার প্রথম পাতায় ফের চোখ রাখি। এরপরের লেখাটা দেখে আর স্থির থাকতে পারি না। শহীদকন্যা লিখেছে তার পিতার উদ্দেশে, ‘‘বাবা, আই লাভ ইউ টু মাচ।’’
আর পড়তে পারি না। চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে থাকে। টেবিল থেকে আরেকটি খাতা তুলে নিই। তাতেও মলাটের পর প্রথম পাতায় বাবাকে নিয়ে একই লেখা।
অসহায় বোধ করি। ভাঙচুর হতে থাকে মনের ভিতরে। উঠে যেতে চাই। উঠে যাই। শহীদ পুত্রকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে আসি সেই বাড়ি থেকে। সুপ্রিয় জিজ্ঞাসা করে, ‘মা’র সঙ্গে দেখা করবেন না? বাজারে গেছে। আসবে এখনই।’ ওকে মিথ্যা কথা বলি। বলি, ‘বাজারে গিয়ে দেখা করে নিচ্ছি এখনই। তুমি ঘরে যাও।’
সত্যি কথা বলতে পারিনি শহীদ পুত্রকে। কী করে বলব যে, চোখে জল নিয়ে শহীদের স্ত্রী’র সামনে যেতে পারবো না। কেননা, শোককে শপথে পরিণত করার শপথ নিয়েই কমরেড গোপাল মণ্ডলের স্ত্রী গত ৩১শে আগস্ট গিয়েছিলেন কলকাতায়। শহীদ স্মরণে সমাবেশে। তাঁর সামনে চোখের জল ফেলা অন্যায়। সে যত কষ্টই হোক।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



