somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুক্তিযুদ্ধে চুয়াডাঙ্গাঃ সপ্তম পর্ব : অধ্যক্ষ হামিদুল হক মুন্সী

১১ ই ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১২:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জীবননগর থানায় ধুপাখালী সীমান্তে ৭ই আগষ্ট ১৯৭১ মুক্তিযোদ্ধা নিয়মিত বাহিনীর সাথে পাকসেনাদের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে উভয় পক্ষের মধ্যে বহুসময় ধরে গুলিবিনিময় হয়। যুদ্ধে অসংখ্য পাকসেনা মারা যায় এবং ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ২ জন আহত হন। ১২ ই আগষ্ট আলমডাঙ্গা ও হালসা রেলওয়ে ষ্টেশনের মধ্যবর্তী কালিদাসপুর গ্রামের উত্তরে পাকসেনাদের একটি টহল ট্রেন উড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধারা রেললাইনের নিচে প্রেসার চার্জে এন্টিট্যাংক মাইন স্থাপন করেন। স্থাপিত মাইনের উপর দিয়ে ট্রেন যাবার সময় প্রেসারে বিষ্ফোরন হবার কথা। কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে মাইন না ফাটায় পাকসেনারা রক্ষা পায়।


১৩ ই আগষ্ট ১৯৭১ আলমডাঙ্গা থানা সংলগ্ন মিরপুর থানার শুকচা গ্রামের পূর্বপাশে ওয়াপদা ক্যানেলের কাছে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকসেনাদের মধ্যে যুদ্ধ হয়। ১২ আগস্ট গেরিলা কমাণ্ডার আবদুল হান্নান’র নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা মিরপুর থানার শোক্‌চা বাজিতপর গ্রামে অবস্থান নেয়। ওই দলের অন্যতম সদস্য খন্দকার জামশেদ নূরী টগর। প্রাণ চাঞ্চল্ল্যে ভরপুর এক সংগ্রামী সৈনিক। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। খুলনা সিটি ল’কলেজের ছাত্র। কিন্তু দেশ-মাতৃকার টানে হাতে অস্ত্র তুলে নেন। ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। রণ কৌশলে তার ছিল অসামান্য দক্ষতা। একের পর এক সফল অভিযান।

ওইদিন সন্ধ্যায় শোক্‌চা গ্রামের লালান মণ্ডলের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা রাতের খাবার খান। তারপর আলমডাঙ্গার জগন্নাথপুর, শ্রীরামপুরের দিকে রওনা হয়। সাথে ছিলেন কমাণ্ডার আবদুল হান্নান, খন্দকার আব্দুর রশিদ, বদরুল আলম, বাজিতপুরের আজিবার রহমান ও মুনতাজ মোল্লা, পারকুলার শাজাহান, নওলামারীর রবিউল, বাঁশবাড়িয়ার লালচাঁদ, শ্রীরামপুরের কুদ্দুছ আলী, ভদুয়ার খবির প্রমুখ।

কালিদাসপুরের অদুরে রেল লাইনের নিচে প্রেসার চার্জে বিষ্ফোরিত এন্টি ট্যাংক মাইন স্থাপন করে। উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর ট্রেন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে মাইনটি বিষ্ফোরিত হয়নি। হতাশ হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে আসে। রাতে মিরপুরের চক-হারদি গ্রামে আশ্রয় নেয়। গৃহ মালিকের দেওয়া গুড়-মুড়ি খাওয়ার সময় টগর সঙ্গীদের সাথে রসিকতা করে বলে, ‘আমার মুখে তুলে না দিলে খাবো না।’ তখন বন্ধু আজিবার তার মুখে খাবার তুলে দেয়।

১৩ আগস্ট ভোর থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। মুনতাজ মোল্লার ডাকে ওদের ঘুম ভাঙে। খবর আসে শোকচা বাজিতপুর গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী প্রবেশ করেছে। বিন্দুমাত্র দেরি না কেও সবাই কাঁধে রাইফেল তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বিকল্প পথ না থাকায় বিলের জল মাড়িয়ে শোক্‌চা ব্রিজের উত্তরে এম্বুশ করে। দক্ষিণে খরস্রোতা কুমার, পিছনে জি.কে ক্যানেল আর সামনে ইটভাটা। এল.এম.জি’র দায়িত্বে হান্নান ও টগর, রশিদের হাতে এস.এল.আর, অনান্যদের থ্রি নট থ্রি রাইফেল।


এদিকে পাকিস্তানি সেনারা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে না পেয়ে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়। বাড়ি ঘরে আগুন লাগায়; ব্যাপক লুটপাট করে। প্রায় ঘন্টাখানেক পর, গরু ছাগল নিয়ে ফিরতি পথ ধরে।


নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে ওরা তিনটি দলে বিভক্ত। প্রথম দলে তিন, দ্বিতীয় দলে ২০ আর তৃতীয় দলে ১০ জন। মুক্তিযোদ্ধাদের ইচ্ছে ছিল তিন গ্রুপকে একসাথে আক্রমণ করবে। কিন্তু প্রথম গ্রুপ ৩০ গজের মধ্যে চলে এলে কৌশলগত কারণে গর্জে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতিয়ার। শুরু হয় সম্মুখ যুদ্ধ। প্রথম দলের দুইজন পাকিস্তানি সেনা ততক্ষণাৎ নিহত হয়।
দ্বিতীয় দলকে লক্ষ্য করে টগর ব্রাশফায়ার করেন। দু’পক্ষের মধ্যে বৃষ্টির মত গুলি বিনিময় হয়। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের লাইট মেশিনগানের গ্যাস রেগুলেটর জাম হয়ে যাওয়ায় ফায়ার বন্ধ হয়ে যায়। ফলে, পাকসেনারা অনুকূল অবস্থা বুঝে মুক্তিযোদ্ধাদের জীবিত ধরার জন্য চেষ্টা করে। অবস্থা বেগতিক দেখে কমাণ্ডার সবাইকে পালানোর নির্দেশ দেয়। কিন্তু টগর রাজি হননি। একাই লড়ে যেতে চান। বাধ্য হয়ে সঙ্গীরা তাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে আসে। ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে সবাই পিছু হটে।

রবিউল রাইফেল নিয়ে ক্যানেলে ঝাঁপ দেয়। আজিবার সোনা-কান্দরের বিল সাঁতরে পাগলা গ্রামে আশ্রয় নেয়। আর জামশেদ নূরী টগরের ঠাঁই হয় মৃত্যুর হিম-শীতল কোলে। হঠাৎ শত্রুপক্ষের একটা বুলেট তার মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়। শোক্‌চা ব্রিজ থেকে আধা কিলোমিটার উত্তরে সিতারাম বিল সংলগ্ন ক্যানেলের পাশে লুটিয়ে পড়ে তার দেহ।
লাশের সাথেও চলে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম পৈশাচিকতা। রশি দিয়ে শক্ত করে টগরের পা বেঁধে স্থানীয় কৃষক ইয়ার আলীকে দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যায় আলমডাঙ্গা শহরের চারতলা মোড়ে।

তাছাড়া তারা সর্বসাধারণের প্রদর্শনের জন্য আলমডাঙ্গা শহরের চার তলা ভবনে বাঁশ দিয়ে লাশ ঝুলিয়ে রাখে। চার দিন পর্যন্ত লাশ ঝোলানো থাকে। পরে লাশ থেকে গন্ধ বের হলে আলমডাঙ্গা বাজারের টগরের পিতা নূর উদ্দিনকে বাড়ি থেকে জোর পূর্বক ধরে আনে লাশ সনাক্ত করার জন্য। কিন্তু ভয়ে পিতা তার ছেলের লাশ দেখেও তা নিজের ছেলের লাশ নয় বলে জানাতে বাধ্য হন। এই যুদ্ধে আমিরুল ইসলাম ও খবির আলী বিশেষ দক্ষতা ও সাহস দেখিয়েছেন। ১৭ই আগষ্ট দামুড়হুদা থানার নাটুদহ স্কুলের সন্নিকটে এক খন্ড যুদ্ধে অংশ নিয়ে দূর্ভাগ্যজনক ভাবে মুক্তিযোদ্ধা চিত্ত মল্লিক পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন।


পরে পাকসেনারা তাকে হত্যা করলে তিনি শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধারা খলিশাকুন্ডিতে ১৯ শে আগষ্ট রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ করেন। মুজিব বাহিনীর কমান্ডার মারফত আলী ও আব্দুল হান্নানের যৌথ নেতৃত্বে এই হামলা পরিচালিত হয়। এই হামলায় রাজাকার ক্যাম্পের মারাত্মক ক্ষতি হয় এবং রাজাকাররা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে ফারুক নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। ২৫ শে আগষ্ট আলমডাঙ্গা থানার বলিয়ারপুর ও বেনগাড়ী গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে এবং কাথুলী, সোনাতনপুর, বলেশ্বরপুর ত্রিমোহনীতে ভোর বেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকসেনাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। বলিয়ারপুর বেনগাড়ী যুদ্ধে টেংরামারী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা ধরা পড়েন। বেশ কয়েকজন পাকসেনা ও রাজাকার এই যুদ্ধে নিহত হয়। কাথুলী, সোনাতনপুর, বলেশ্বরপুর ত্রিমোহনীর যুদ্ধে আলমডাঙ্গা থানার পাইকপাড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। ৩১শে আগষ্ট চুয়াডাঙ্গার উপর দিয়ে প্রবাহিত মাথাভাঙ্গা নদীর তীরে কালুঘাট গ্রাম। নদীতে তখন প্রবল স্রোত। সন্ধ্যার দিকে ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৭ জনের একটি সেনাদল নৌকায় নদী পার হবার সময় মাঝনদীতে দুই মাঝি নৌকা ডুবিয়ে দিলে সাতজন পাকসেনা মারা যায়। আগষ্ট মাসের বিভিন্ন তারিখে চুয়াডাঙ্গা জেলার বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি খন্ড যুদ্ধ হয়। এই সমস্ত যুদ্ধে পাকসেনা বাহিনীর বহু ক্ষতি হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু কিছু ক্ষতি হয়। কার্পাসডাঙ্গার যুদ্ধে কার্পাসডাঙ্গার শুকলাল মন্ডল ও দৌলৎদিয়াড়ের মতিয়ার রহমান আহত হন। মেহেরপুরের জোড়াপুকুরের যুদ্ধে আলমডাঙ্গা থানায় ভুগাইল বগাদীর আব্দুল হান্নান আহত হন। অস্ত্রের ব্যবহার দেখতে যেয়ে হাট বোয়ালিয়ায় আবুল কাশেম মিস ফায়ারে আহত হন।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১২:৩৮
২৯টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×