somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শব্দকরদের বাঁচাতে এগিয়ে আসুন

১৩ ই জুলাই, ২০১০ রাত ১:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দরিদ্রতা এবং সভ্য সমাজের বিরূপতার শিকার হয়ে চরম বিপন্নতার মুখে পড়েছে শব্দকর জনগোষ্ঠি। হতদরিদ্র এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠির বাস বাংলাদেশের সিলেট ও মৌলবীবাজার জেলায়। সমকালীন ইতিহাসে দারিদ্রের যে সীমারেখা চিন্হিত করা হয় শব্দকরেরা তার চেয়ে অনেক নীচু অবস্থানে জীবন অতিবাহিত করে। স্থানীয়ভাবে তারা 'ডুকলা' নামে পরিচিত। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদিত "বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান" পুস্তকে ‌ডুকলা শব্দের অর্থ হিসেবে বলা হয়েছে অসভ্য,নিকৃষ্ট জাতি বা সম্প্রদায়। তারা সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। প্রধান পেশা হলো ঢোল ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র বাজানো।

শব্দকরেরা ভারতবর্ষের কুল, ভীল, সাঁওতাল, শবর, মুন্ডা ইত্যাদির মতোই একটি প্রাচীন অনার্য জনগোষ্ঠি যারা বৈদিক বর্ণাশ্রম ধর্মের শিকার হয়ে যুগে যুগে সভ্য সমাজের হাতে নিগৃহীত হয়ে আসছে। বর্তমানে তারা সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের শরীক হলেও বৃহত্তর হিন্দু সমাজের কাছে তারা অচ্ছ্যুত এবং অস্পৃশ্য হিসাবে গন্য। বাঙালি বর্ণহিন্দুরা ডুকলাদের হাতে জল খায় না, নিজেদের চেয়ারে বা বিছানায় ডুকলাদের বসতে দেয় না, শব্দকরেরা বাঙালিদের সাথে বড়জোড় প্লে­ট ছাড়া বিশেষ কাপে চা খেতে পারে। দোকানে বা অন্য কোথাও সবার সাথে বসে কোনো কিছু খাওয়া বারণ, এমনকি ধর্মীয় বা সামাজিক উৎসবগুলোতেও। তাদের সাথে একঘরে ঘুমালে, একসাথে উঠলে বসলে, একসাথে খেলে, হাতের রান্না বা জল খেলে বাঙালি বর্ণহিন্দুর নাকি জাত চলে যায়!

শব্দকরদের সমৃদ্ধ ও বৈচিত্রপুর্ণ অতিপ্রাচীন সাংস্কৃতির উপাদান রয়েছে। এমনিতে তাদের সংস্কৃতি ভোগপ্রবল। তারা অদৃস্টবিশ্বাস প্রবল এবং প্রতিদিনের দুঃখ ও কষ্ট থেকে মুক্ত হতে না পারলেও তারা গান-বাজনায় মত্ত থাকে। তাদের উপাস্য দেবতা হচ্ছে শিব বা মহাদেব। তারা বাদ্য বাজিয়ে শিবের গান, রাজার গান গেয়ে থাকে। ঢোল, ঢাক, করতাল, বাঁশি এগুলো তাদের জীবনের অংশ। চড়কপুজা ও গাঁজন উৎসব তাদের প্রধান উৎসব। বছরের শেষে চড়কপুজা হয়ে থাকে। শরীরের পেছনের অংশে বিশালাকার বরশি গেঁথে চড়কিতে ঘুরা তাদের কাছে পূণ্যের অংশ, অন্য সমাজের কাছে যা চিত্তবিনোদন। চড়কপূজা প্রক্রিয়ার সাথে নানান গান ও নাচ জড়িত। এ জাতীয় একটি গানের অংশ -

ও শিব আওরে জগত জটা
জগত জটারে শিব পাগলা বেটা
শিব আইলা সিনান করি
গেরি দিলা সিদ্ধি ভারি

ও মাই ও মাই ও মাইগো
অউনি গৌরির জামাইগো

খাইয়া ভাঙের গুড়া
গৌর করিয়া চায়
তারে দেখি উমার মা
উল্টা পাকে ঘরে যায়
খাওয়ায় বেনি কামাই গো
লেমটা বেটা, জগত জটা।

এছাড়াও আছে আগুনে হাঁটার গান, গাঁজার গান, জামাইষষ্ঠীর গান, ভাইফোঁটার গান, বিয়ের গান, তিননাথের গান, কালীনাচের গান ইত্যাদি। সবগুলো গানই তাদের জীবন ও জীবিকার সাথে সম্পর্কিত।

শব্দকর সমাজের ছেলেমেয়েরা বরাবরই নানান দৃশ্য ও অদৃশ্য বাধার সম্মুখীন হয়ে, বৃহৎ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ও অবহেলিত হয়ে হীনমন্যতাবোধে নিয়ে বড় হতে থাকে। বেশীর ভাগ শিশুই প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করতে পারেনা। বয়স্করা এখনো ১০০ পর্যন্ত গুনতে পারেনা। শব্দকর সমাজ আজন্ম দারিদ্রকে নিয়তি বলে মেনে নিয়েছে। তাদের পিতামাতা ও সন্তানদের চোখে কোন স্বপ্ন নেই। সবাই অবধারিত ধরে নেয় মা-বাবারা যেভাবে নিদারুন দারিদ্র ও হতাশার মধ্যে জীবন কাটায়, তারাও সেভাবে জীবন কাটাবে। একটা অদ্ভুত সত্য এদের বিশ্বাসে গেঁথে থাকে যে, তাদের এই দুর্দশার জন্য বিশেষ কোন দেবতার অভিশাপ দায়ী, অথবা ঈশ্বর নিজেই চান না তারা ভাল থাকুক। রাস্ট্রে জনসংখ্যা দমন যখন একটা প্রধান সমস্যা, তখন শব্দকরদের জন্মের চেয়ে মৃত্যুহারই বেশী।

১৯০৫ সালে বি.সি. এলেন সম্পাদিত Assam District Gazeteers -এর সিলেট খন্ডে শব্দকরদের জনসংখ্যার হিসেব দেয়া হয়েছিল ১০,১০৩ জন। অধ্যক্ষ রসময় মোহান্তের লেখা একটি সমীক্ষা গ্রন্থ থেকে জানা যায় মৌলবীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় ১৯৯৫ সালে শব্দকরদের জনসংখ্যা ছিল সর্বমোট ৪,০৭৩ জন। এদের মধ্যে ২০৭৭ জন পুরুষ এবং ১৯৯৬ জন মহিলা। মোট পরিবার সংখ্যা ৯০০ এবং গ্রামসংখ্যা ৩৫। বিদ্যালয়গামী ছাত্রসংখ্যা ৩০৯, বাল্যবিবাহ ৩৪৩টি এবং বসতভিটা সাকুল্যে তাদের জমির হিসাব সর্বমোট ১০১৮৬ শতক যার মধ্যে উৎপাদনশীল জমি প্রায় শুন্যের কোঠায়।

এতটা মুল্যহীন, স্বপ্নহীন ও সম্পদহীন হয়ে কোন জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকা কি সম্ভব?

আমাদের রাষ্ট্রের বড় বড় নথিপত্রে বাঙালিভিন্ন অন্য সকল জাতির কোন তথ্য নেই। কে কোথায় বাঁচলো বা মরলো তা নিয়ে রাষ্ট্রের কোন মাথাব্যাথা নেই; রাষ্ট্র ও তার সুবিধাভোগী মানুষজন ব্যস্ত আইনের প্যাঁচে ফেলে বিপন্নপ্রায় মানুষের ভূমি আর পাহাড়ের দখল নিয়ে। সেটা যদি ১০০ কিম্বা ১০০০ লাশের বিনিময়ে হয় তাও সমস্যা নেই। শব্দকরদের খবরও সেভাবেই রাষ্ট্র রাখেনা, রাখার দরকারও মনে করে না কোন কালে। অবহেলা ও বৈষম্যের এ ধারা অব্যাহত থাকে, আর নিজভুমে পরবাসী ডুকলারা হারাতে থাকে নিজেদের অস্তিত্ব, জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতি, গানবাজনা, ঢোল, বাদ্য সবকিছু। নিশ্চিহ্ন হতে থাকে মানুষ আর মানুষের জনপদ, মানুষেরই দাপটে!

মুলসূত্র:
১. প্রাবন্ধিক ও গবেষক আহমদ সিরাজের লেখা 'শব্দকর একটি চরমবিপন্ন জনগোষ্ঠি'। মণিপুরী থিয়েটারের পত্রিকা, ৭ম সংখ্যা।
২. পাভেল পার্থের লেখা 'ডুকলাদের সকল ঢোল বেজে ওঠুক বর্ণদাপটের বিরুদ্ধে'। মৃত্তিকা, ২য় সংখ্যা।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুলাই, ২০১০ রাত ১২:৫০
১৩টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×