২১ বছর বয়সী বাংলাদেশি তরুণ কাজী রেজওয়ানুল আহসান নাফিস ধরা পরার পর থেকেই দেশী বিদেশী সংবাদ মাধ্যমগুলোতে ব্যপক হারে গুঞ্জন শুরু হয়। এরই মধ্যে বাংলাদেশের কিছু বুদ্ধিজীবি আর কিছু ব্লগার কানাঘুষা শুরু করে। তাদের মতামত ছিল নাফিস দেশে মান সম্মান রশাতলে নিয়ে গেছে। আমরা যে হুজুগে বাঙ্গালী তার আরো একবার প্রমানিত হল এই নাফিস বিষয়টি। কেননা কেউ এই বিষয়ে কথা বলেনি তখন যে ব্যাপারটিতে আসলেই নাফিসের দোষ কতটুকো। কিন্তু সময় অতিবাহিত হবার সাথে সাথেই বিষয়টি এখন একটু একটু করে পরিষ্কার হতে শুরু করেছে যে নাফিসের দোষ ১০০% এর মধ্যে ২০% আর ৮০% দোষই খোদ মার্কিনীদের। কেননা যদিও শেষে নাফিসের উপরই সকল দোষ চাপিয়ে দেয়া হবে যা তার আগের সবার সাথেই করা হয়েছে।
যেভাবে ঘটনাটি ঘোলাটে হতে থাকেঃ প্রথম সমস্যাটিই হলো মার্কীনিদের আন্ডারকভার অপারেশন বা স্টিং অপারেশন। এরা যেভাবে যে ভিত্তিতে নাফিসকে ধরার খবর প্রকাশ করতে থাকে তাকে অনেকটাই সন্দেহজনক বলে মনে হতে থাকে। এ বিষয়ে রেজওয়ানুল গ্রেপ্তারের পর ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর ডট কমে বলা হয়, ভুয়া সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা তৈরি করে দেওয়া ও অর্থ জোগানোর মাধ্যমে এফবিআই যেসব ফাঁদ পাতা অভিযান পরিচালনা করে, তা নিয়ে আবার বিতর্ক শুরু হয়েছে। নাম উল্লেখ না করে বলা হয়, এই পদ্ধতির সমালোচকেরা মন্তব্য করেছেন, এ রকম অপারেশন ‘নাজুক ব্যক্তিদের ভুয়া সন্ত্রাসবাদী ষড়যন্ত্রের দিকে প্ররোচিত করছে।’ বিলেতের গার্ডিয়ান অনলাইন মন্তব্য করেছে, ‘এফবিআই স্বীকার করেছে যে পুরো অপারেশনটি পরিচালনা করেছে তারাই। তাদের এই স্বীকৃতির ফলে তাদের বিরুদ্ধে ফাঁদ পাতার অভিযোগ অনিবার্যভাবে উঠবে।’ সুতরাং পশ্চিমা বিশ্বেই এই আন্ডার কভার অপারেশন নিয়ে ব্যপক সমালোচনা আছে তা এখানে পরিষ্কার।
দ্বিতীয়ত হলো এফবিআই নিজের ঢোল নিজেই পিটাতে থাকে কিভাবে এবং কিসের ভিত্তিতে নাফিসকে তারা গ্রেফতার করে। এফবিআই শুধু স্বীকার করেনি, বরং গর্বের সঙ্গে দাবি করেছে যে রেজওয়ানুলকে দিয়ে পুরো ঘটনাটি তারাই ঘটিয়েছে। সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে তারা আমিনি আল খালিফি নামে মরক্কোর এক নাগরিককে ঠিক একই কায়দায় ওয়াশিংটন ডিসিতে গ্রেপ্তার করে। ২৯ বছর বয়সী ওই মুসলমান যুবককে তারা নকল আত্মঘাতী বিস্ফোরকসহ জামা (সুইসাইড ভেস্ট) ও অকেজো আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ করেছিল। পরিকল্পনা ছিল, ওই জামা পরে খালিফি নির্বিচারে গুলি চালিয়ে লোকজনকে হত্যা করবেন। তার আগে ২০০৯ সালে নিউইয়র্কের রিভারডেল এলাকায় দুটি সিনাগগ (ইহুদি উপাসনালয়) বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করার দায়ে চারজন কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমান যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদেরও হামলার পরিকল্পনায় সহযোগিতা করা, অর্থ ও নকল বিস্ফোরক জোগান দিয়েছিল এফবিআই। সংস্থাটি এই কাজে ব্যবহার করেছিল একজন পাকিস্তানি নাগরিককে, যিনি পাকিস্তানি ধনী ব্যবসায়ী সেজে তাঁদের সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্র করেছিলেন। ওই ঘটনার মামলায় একজন বিচারক এফবিআইয়ের এই কর্মপদ্ধতিকে ‘ক্রিয়েটিং টেরোরিজম’ বা সন্ত্রাসবাদ তৈরি করা হিসেবে বর্ণনা করে এর সমালোচনা করেছিলেন। সুতরাং এটা নিয়ে অনেক বির্তক তাদের নিজেদের মধ্যে থাকলেও এরা মুলত মুসলিম দেশ গুলোকেই যে তাদের নিশানা বানাচ্ছে এটা অনুসন্ধানেই বের হয়ে আসছে।
এতদিন তারা আলকায়দা অনেকটা কৌশলে পাকিস্তানে ঢুকিয়েছে এজন্য অবশ্য সেই দেশটির শাসক শ্রেনীর লোভী মানুষগুলো প্রত্যক্ষভাবে জাড়িত ছিল। তাদের লোভকে পুজিঁ করেই তারা মুলত তাদের সৃষ্ট আল-কায়দা বাহিনী পাকিস্তানে তাদের কার্য পরিচালনা করার লাইসেন্স দিয়েছে। সবই তাদের কটু কৌশল তা সবাই জানে কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারেনা কেননা তারা দাদা।
এবার আসি নাফিস যেভাবে ধরা পরল সেই বর্ননা। রত্যেকটি ৫০ পাউন্ড ওজনের মোট ২০টি বিস্ফোরক তারা রেজওয়ানুলকে দিয়েছে ফেডারেল রিজার্ভ ভবন উড়িয়ে দেওয়ার জন্য। একটি মোটরভ্যানে করে সেগুলো ভবনটির কাছে নিয়ে যাওয়া, ভ্যানটি সেখানে পার্ক করে রাখা, ভবনটি থেকে কিছু দূরে ম্যানহাটনের একটি হোটেলে বসে রেজওয়ানুল যে মুঠোফোন ব্যবহার করে বিস্ফোরণ ঘটানোর চেষ্টা করছিলেন, সেটিও ছিল তাদেরই দেওয়া। রেজওয়ানুল জানতেও পারেননি সেগুলো আদৌ বিস্ফোরক ছিল না। পুরো ঘটনাই একটা ‘ফেক টেরর প্লট’ বা ভুয়া সন্ত্রাসী ষড়যন্ত্র যা একমাত্র রেজওয়ানুল ছাড়া আর কারও জন্য কোনো বিপদ ডেকে আনতে পারত না, পারেনিও। এই সুনিশ্চিত নিরাপদ ‘সন্ত্রাসবাদী ষড়যন্ত্রের’ একমাত্র লক্ষ্য ছিল, রেজওয়ানুল আমেরিকার বিরুদ্ধে বিরাট এক আঘাত হানার আকাঙ্ক্ষা মনের মধ্যে পোষণ করেন। পোষণ করেন মাত্র। যুক্তরাষ্ট্রের মোট স্বর্ণের বিরাট অংশের সংরক্ষণাগার, দেশটির সবচেয়ে সুরক্ষিত ভবনগুলোর অন্যতম ফেডারেল রিজার্ভ ভবনে হামলা চালানোর মতো বাস্তবিক সামর্থ্য মাত্র ২১ বছর বয়সী এই তরুণের ছিল না, যিনি মাত্র নয় মাস আগে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র গেছেন পড়াশোনা করতে। একা এমন সাহসও হয়তো তাঁর ছিল না, তাঁর বাবার বর্ণনা থেকে অন্তত সে রকমই মনে হয়। এফবিআইয়ের প্রত্যক্ষ মদত ছাড়া একা এই কাজ করার সাহস কোন সাধারনের পক্ষে করা সম্ভব নয়। আর তারা কি পরিমান তত্তাবধান করেছিল নাফিসকে তার সম্পর্কে কোন পরিষ্কার ধারনা তারা সরবরাহ করেনি। আর এই তথ্যের উৎসও মার্কিন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যে নাফিস যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে চান না । এখন পর্যন্ত রেজওয়ানুলের নিজের কোনো বক্তব্য সরাসরি তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। সুতরাং তারা স্বীকার করাতে নাফিসকে কি পরিমান নির্যাতন একমাত্র সৃষ্টি কর্তা আর নাফিস আর তারই জানে। আর তাদের নির্যাতনের নমুনা এর আগেও বিশ্ববাসী দেখেছিল ইরাকের আবু গারিব কারাগারের ভয়ানকতা দেখে।
রেজওয়ানুল যদি মুসলমানদের বিরুদ্ধে আমেরিকার অন্যায়-অবিচারের প্রতিশোধের সুপ্ত ইচ্ছা বুকে ধারণ করেও থাকেন, যদি তিনি ওসামা বিন লাদেন ও আল-কায়েদার সন্ত্রাসবাদী দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়েও থাকেন, তাঁকে আমেরিকার আইনের আওতায় আটক বা বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব ছিল না। সে জন্য তাঁকে নিষ্ক্রিয় (সুপ্ত) আমেরিকা-বিদ্বেষী থেকে সক্রিয় আক্রমণকারী হয়ে উঠতে প্রথমে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে, তারপর আক্রমণের পরিকল্পনা সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তা বাস্তবায়নে সব রকমের সহযোগিতা করা হয়েছে। আসলে নিছক সহযোগিতা নয়, পুরো ঘটনার বিবরণ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এফবিআই রেজওয়ানুলকে মানসিক ও আচরণগত দিক থেকে প্রত্যক্ষভাবে পরিচালনা করেছে। তিনি যদি সক্রিয় সন্ত্রাসবাদী হয়ে থাকেন, তবে তাঁকে তা করে তোলার দায় একান্তই এফবিআইএর। ফেডারেল রিজার্ভ ভবন উড়িয়ে দিতে গিয়েছিলেন যে রেজওয়ানুল, তিনি এফবিআইএর তৈরি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন এমন করা হচ্ছে। কিছুদিন আগেই আমরা একটা সুপ্ত গুঞ্জনের আভাস পেয়েছিলাম যে মার্কীন বাহিনী বাংলাদেশে তাদের ঘাটি গাড়তে চায়। কিন্তু মার্কীন জেনারেল তা উড়িয়ে দিয়ে এই বিষয়টি এড়িয়ে চলে গিয়েছিল। এখন কথা হচ্ছে আমরা এমন গুঞ্জন কেন শুনলাম যা আসলেই গুজব ছিল? আমার ধারনা এখন সেটিই তারা বাস্তবে রুপ দান করতে চাইছে যা একটি নির্দিষ্ট নাটকের মধ্য দিয়ে না আনলে সম্ভব নয়। এর জন্যও যে এই নাটক হতে পারে তার সম্ভবনা কিন্তু এখন বেড়ে গেল। আরেকটি বিষয় হচ্ছে মুসলীম বিশ্বের প্রতি পশ্চিমে একটু বেশীই বাজে ধারনা আছে। তাই তারা একে একে সব মুসলীম বিশ্বকে দমিয়ে রাখার নানা কৌশলের মধ্যে এটিও একটি হতে পারে।
এ না হয় গেল বিদেশীদের ধারনা। এবার আসি আমরা দেশের মানুষ কি করেছিলাম নাফিস ইস্যুতে। ধরা পরার সাথে সাথেই আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি নাফিসের নাগরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন যা ওনার দুর্বল কুটনৈতিক আচরনের বহি:প্রকাশ। এই সমস্যা সমাধান করতে হলে অবশ্যই ভাল কুটনৈতিকতার পরিচয় দিতে হত। কিন্তু তিনি শুরুতেই আজব এক প্রশ্ন দাড় করিয়ে দিয়েছিলেন। আর আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অনেকেই নাফিসকে এবং তার পরিবারকে যতটুকো তুলোধুনা করা যায় তার সবটুকোই প্রয়োগ করেছিলেন। কিন্তু তাদের আরো ধৈর্য্য দেখানো উচিৎ ছিল যা তারা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
এখন কথা হচ্ছে আমরা যদি নিজেরাই একত্রিত না থাকি তবে বাইরের শক্তির প্রয়োজন নেই নিজেরাই নিজেদের ধ্বংশ করে দেব। আর এই ঘটনার বলির পাঠা হয়েছে নাফিস তা বিশ্ব আরো পরে জানতে পারবে। কিন্তু তাকেও আবার দোষের বাইরে রাখা ঠিক হবে না। কিন্তু সে যেই কাজ করতে চেয়েছিল তার জন্য যতটুকু মাসসিক শক্তির প্রয়োজন ছিল তার সবটুকুই কিন্তু মার্কীনিরা যোগান দিয়েছিল। আরা তাদের এই স্টিং অপারেশন যদি স্বার্থকই হতো তবে কিছুদিন আগে আফগানিস্তানে তাদের আফগান সহকর্মীদের হাতে মারা যাবার বহু পুর্বইে তারা তাদের ধরতে সক্ষম হত। সুতরাং এখন শুধু টার্গেট যে শুধু নাফিস তাই নয় বরং মুসলমান সংখ্যা গরিষ্ঠতা থাকা বাংলাদেশ নিজেই মার্কীন টার্গেটে পরেছে নাফিস তারই উদাহরন। এটাতো ওদের নাটকের একটা পর্ব মাত্র।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০১২ রাত ১২:৪৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




