আমাদের বাড়ির সবচাইতে যেই জিনিসটা ভালো লাগতো, তা হলো বর্ষাকালে ট্রলার করে আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া (ট্রলার / টলার এইটা আসলে মাছ ধরার ট্রলার নয় ,মুন্সিগঞ্জ জেলায় বর্ষাকালে যোগাযোগের ক্ষেত্রে খুবই জনপ্রিয় একটি নৌযান) বর্ষাকাল এলেই আমাদের বাড়ির সবাই টলারে করে আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে যেতাম ।অনেক দূর ঘুরে ঘুরে, মাঝে মাঝে বিরানি বা খিচুরি রান্না করে নিয়ে যাওয়া হতো ।মাঝ পথে নদী বা খালে টলার থামিয়ে সবাই আনন্দ করে সেই খিচুরি বা বিরানি খেতাম ।প্রতি বর্ষায় কম করে হলেও ৮-১০ বার হতো এমন ঘুরতে যাওয়া ।বিনা কারণে টলার করে বাড়ির সবাই দূরের আত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে যেতাম ।এমন কি বাজার সদাই করে নিয়ে যাওয়া হতো ।যাতে সেই আত্মীয়র তেমন খরচ পাতি না হয় ,আমাদের আপ্যায়নের জন্য ।বড়বড় ইলিশ মাছ কচু এবং বিভিন্ন রকমের তরকারী বাজার করে নিয়ে যাওয়া হতো ।সারাদিন থেকে সন্ধার আগ দিয়ে আবার বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দেওয়া হতো ।অনেক দূর ঘুরে ঘুরে ।আর আমরা সব ছেলেরা টলারের ছাদে বসে আড্ডা দিতাম ।ব্যাটারি চালিত ক্যাসেট পেলেয়ার নিয়ে যেতাম ,টলারের ছাদে ফুল সাউন্ড দিয়ে জমজমাট গান ছেড়ে রাখতাম ।আরেকটা জিনিস আর সেইটা হলো আমাদের বাপ চাচারা আমাদের অনেক শাসনে রাখতো ,কিন্তু যখন টলারে করে ঘুরতে যেতাম সবার সাথে তখন কারফিউ শিথিল করা হতো ,বাপ চাচারা আমাদের শাসন করতো না বরং আমাদের দুষ্টামি ফাজলামি দেখে মাজ নিতো ।
২০০২ সালে আমার মেজু ফুপুর মেয়ের বিয়ে।মানে ফুপাতো বোনের বিয়ে ।আমাদের বাড়ির সবাই এবং অন্য দুই ফুপুকে আগেই ফোন করে আমাদের বাড়িতে আনা হয়েছিল ।আর সেই দুই ফুপুর পরিবারের সবাই এবং আমাদের চাচা ,চাচী, মা বাবা ,কাজিন-ভাই বোন সবাই মিলে প্রায় ৫০ জনের বেশি হয়ে ছিল ।মোট কথা আমার দাদার বংশের সবই ( শুধু মেজু ফুপুর ফেমেলি ছাড়া )ছিলাম ।সেই দিন অনেক বড় একটি টলার ভাড়া করে আমরা ফুপাতো বোনের বিয়ে খেতে গিয়েছিলাম ।
ফুপুর বাড়ি যেহেতু মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানায় আর আমরা শ্রীনগর থানার ,তাই আমাদের বাড়ি থেকে যাওয়ার জন্য দুইটা পথ ছিল ।এক গ্রাম এলাকা দিয়ে আর দ্বিতীয়টি লৌহজং এর বালিগাও বাজারে দিয়ে পদ্মা নদীর মাঝ মাঝি গিয়ে ফির লৌহজংএর দিকে আসা । আর আমাদের উদ্দেশ্যও ছিল পদ্মা নদী দিয়ে যাওয়ার ।কারণ পদ্মা নদী দিয়ে ঢুকলে অন্তত ১ ঘন্টা পদ্মা নদীতে টলার থাকবে ।এতে করে বিয়ের,বিয়েও খাওয়া হবে এবং পিকনিকও হয়ে যাবে ।আমাদের পরিকল্পনা ছিল সকাল ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত পদ্মা নদীতে ঘুরে বেরানো ।আর সেই হিসাব মতই আমরা সকাল ৭টা বাজে টলারে করে রওনা দেই ফুপুর বাড়ির উদ্দেশ্য ।বড় ডেকচিতে সেই দিনও খিচুরি রান্না করা হয়েছিল ।পদ্মা নদীতে গিয়ে খিচুরি খাবো সেই দিনের খিচুরি ছিল ভিন্ন রকমের !ইলিশ মাছের খিচুরি সেরাম মজাও হয়েছিল খিচুরি ।
লৌহজং এর বালিগাও বাজারের পশ্চিম পাশ দিয়ে একটি বিশাল খাল আছে ,ঐ খালটি পদ্মা নদীর সাথে যুক্ত হয়েছে ।আমরা সেই পথ ধরেই গিয়েছিলাম ।সকাল ৯.৩০ মিনিটেই আমরা বালিগাও বাজার দিয়ে পদ্মা নদীতে ঢুকে যাই । এবং পদ্মায় গিয়ে পদ্মার ইলিশ দিয়ে রান্না করা খিচুরি খুবই মজা করে খেয়েছিলাম এবং পদ্মা নদীতে দীর্ঘক্ষণ ঘুরে বেরিয়ে ছিলাম । প্রচণ্ড মজা করেছিলাম সেই দিন ।পদ্মায় দুইঘন্টা ঘুরে,সকাল ১১-৩০ এর দিকে আমরা পদ্মা নদী দিয়ে ফুপুর বাড়ির দিকে যেতে থাকি এবং ১২টা ১৫-২০ এর দিকে ফুপুর বাড়িতে চলে যাই ।সারাদিন খুবই মজা হয়েছিল বিয়ে বাড়িতে ।কিন্তু বিকাল ৫টার এর দিকে আমরা চলে আসতে হয়।কারণ ৫০-৬০ জন মানুষের থাকার মত জায়গা বিয়ে বাড়িতে ছিলনা ।আর শতশত মেহমান ছিল বাড়িতে । তাই আমরা বিদাই নিয়ে চলে আসি ।আর যখন পদ্মা নদীতে ঢুকি তখনই প্রচণ্ড বাতাস এবং বৃষ্টি শুরু হয় । এবং নদীতে সেই সময়ে ছিল অনেক বড় বড় ঢেউ ,যা দেখে মনে হয়েছিল যেই কোন মুহূর্তে আমাদের টলার ডুবে যেতে পারে ।তাই সবাই চিন্তায় পরে যায় ।যখন পদ্মার মাঝেমাঝি আসি তখন বাতাস এবং বৃষ্টি দুইটাই বেড়ে যায়।যা লিখে বা বলে বুঝানো যাবেনা । নদীতে যেমন ঢেউ তেমনই স্রোত ছিল ।আমাদের টলার চালক পাশের বাড়ির হসান ভাই ,মাঝি বা নাবিক যাই বলিনা কেন তিনি ছিলেন অনেক অভিজ্ঞ লোক ।কিন্তু সেই সময়ে তার চেহারা ছিল খুবই মলিন ।তার চেহারার দেখেই বুঝা গিয়েছিল আমরা কি পরিমাণের বিপদের মধ্যে পড়তে যাচ্ছি ।টলারে থাকা ৯০ ভাগ মানুষই সাঁতার জানে কিন্তু তারপরেও এমন ঢেউ এ বেচে থাকা সম্ভব নয় ,যদি ট্রলার ডুবে যায় ।যখন বড় বড় ঢেউ গুলো এসে টলারে আঘাত করতো তখন মা চাচীরা চিৎকার দিয়ে উঠতো ।আমার বড় চাচা তখন টলারে নিচের তলায় গিয়ে জানালার সব পর্দা খুলে দেয় ,যদি টলার ডুবে যায় তাহলে যেন টলার থেকে বের হওয়া যায় ।আর আমাদের সবাইকে ছাদে পাঠিয়ে দিলো এই বৃষ্টির মধ্যে ।সবার মুখে তখন আল্লাহ আলাহ আল্লাহ্ ।তখন নদীর ঢেউ দেখে মনে হয়েছিল টলার'টা টাইটানিকের মত মাঝে ভেঙে ডুবে যাবে ।
এমন বিপদের সময়ও কিছু বিনোদনও ছিল।কিন্তু তখন এই বিনোদনটি উপভোগ করতে পারিনি ।কারণ তখন প্রচণ্ড ভয় কাজ করেছিল মনে, টলার ডুবে গেলে কি হবে এই ভেবে । আমাদের গুষ্টির সবই এক সাথে শেষ হয়ে যাবে ।বিনোদনটি হলো আমাদের ছোট ফুপু !! তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক,ঢাকাতে তার দুইটা বাড়ি আছে ৫ তালা । আমার এই ফুপু তখন চিৎকার করতে কাদতে ছিল আর বলতে ছিল ,আল্লাহ্ আমরা যদি এখানে মারা যাই তাহলে আমার এই কোটি টাকার কি হবে ?আমার ঢাকার বাড়িতে কে থাকবে ? কি হবে ?আল্লাহ্ জলিল শেখ এর গুষ্টি কি তুমি এখানেই শেষ করে দিবে ? ( জলিল শেখ,আমার দাদার নাম ,আর দাদার নাতি নাতনী ছেলে মেয়ে সবাই এই টলারে ছিল ) আমার ফুপু তখন এতই ভয় পেয়েছিল যে উনি মুখ দিয়ে কি বলছেন হয়তো নিজেও জানেনা ।সেই সময়ে উনার টাকার চিন্তায় আর বাড়ির চিন্তায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলার অবস্থা হয়েছিল ।মানুষ জীবন মরণের মুখোমুখি হলে সব কিছু বিনিময়ে হলেও বাচতে চায় ।কিন্তু তখন আমার ফুপু উনার ধনসম্পদ নিয়ে এতোই বেশি চিন্তিত হয়ে গিয়েছিল যে বলে বুঝানো যাবেনা ।উনি মারা গেলে এই ধনসম্পদ কি হবে ,তার এতো এতো টাকার কি হবে ?ঢাকার শহরে দুই দুইটা বাড়ির কি হবে ? উনি এই চিন্তা ঐ অস্থির ছিলেন !! এবং কেদে কেদে বলেছিল আল্লাহ্ বেচে গেলে গরু কেটে ফকির মিসকিনদের খাওয়াবো ,তুমি আমাদের বাচাও ।আর তখন টলারে থাকা সবাই কিছুনা কিছু আল্লাহর কাছে মানতি করেছিল বেচে গেলে এই করবে সেই করবে ।
যাই হোক সেই সময়ে টলার চালকের কৌশলে পদ্মা নদী থেকে কোন রকমে বালিগাও বাজারের সামনে চলে আসি আমরা,কিন্তু সময়েও বিপদ কাটেনি আমাদের,পদ্মা নদীর চাইতেও ভয়াবহ অবস্থার ছিল বালিগাও খাল এবং পদ্ম নদীর মিলন স্থান ।বালিগাও বাজার দেখে সবার মনে তখন যুদ্ধ জয়ের আনন্দ চলে এসেছিল ।কিন্তু পদ্মা নদী আর বালিগাও বাজারের খাল যেখানে মিলন হয়েছে সেইখানের পরিস্থিতি ছিল চর্ম ভয়াবহ ।পদ্মা আর খালের পানি এক সাথে বারি খেয়ে ওখানে কয়েকটি ঘূর্ণি সৃষ্টি হয়েছিল।বিষণ স্রোতে পানি ঘূর্ণি খেয়ে বিশাল বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছিল ,ঐ গর্তের চারপাশ দিয়ে পানি চরকির মত ঘুরতে ছিল ।যেমনটি ছবিতে দেখা যায় বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এ ।তখন অল্পের জন্য আমরা বেচে যাই ।ঐ ঘূর্ণির মধ্যে টলার পরলে টলার সহ আমরা কোথায় যেতাম আল্লাহ্ মালুম ।
ফুপুর কথা মত বলতে হয় সেই দিন জলিল শেখ এর বংশ আল্লায় রক্ষা করেছি যখন বালিগাও খালের ভিতরে ঢুকে যাই তখন সবার চোখে মুখে ছিল যুদ্ধ জয়ের আনন্দ ,যেন কঠিন কোন যুদ্ধ জয় করে ফিরছি আমরা ।তখন বালিগাও খালে শুশুক নামে ক্ষয়রি রং এর এক ধরনের ডলফিন ছিল আমাদের টলারের চারিপাশে ৫-৬টি শুশুক (ডলফিন) অনেক্ষন পর্যন্ত লাফিয়ে ছিল ।এই দৃশ্য দেখে সবার মন মুহূর্তের মধ্যে ভালো হয়ে গিয়েছিল । তখন আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম একটু আগেও আমরা মৃত্যুর হাত থেকে বেচে এসেছি । তারপর আর কোন দিন টলারে করে পদ্মা নদী দিয়ে সেই ফুপুর বাড়িতে যাওয়া হয়নি । এখন গেলে বাস ভাড়া করে সবাই চলে যাই ,তবে টলারে করে নয় । হ্যাঁ টলারে যাওয়া হয় অন্য আত্মীয়দের বাড়িতে তবে পদ্মা নদী দিয়ে নয় । কারণ ন্যাড়া বেল তলায় নাকি একবারই যায় ।
গাড়ি বা লঞ্চ দুর্ঘটনার আমার আত্মীয় স্বজনের মধ্যে কেউ কখনই মারা যায়নি ।তাই হয়তো বুঝতে পারিনা ,লঞ্চ বা গাড়ি দুর্ঘটনায় যাদের আত্মীয় স্বজন অকালে মারা যায় তাদের মনের অবস্থা !!!তবে এই সব দুর্ঘটনা দেখে মাঝে মাঝে চিন্তা করি আমার পরিবারের কেউ যদি দুর্ঘটনায় অকালে মৃত্যুবরণ করে তবে আমাদের কি অবস্থা হবে ? তখন আর মাথায় কোন কাজ করেনা চিন্তা করতেই ভেঙে পরি ।
আল্লাহ্ কোন দুর্ঘটনায় যেন কারোই অকালে মৃত্যু না হয় ।আর যাদের আত্মীয় স্বজন গতকাল লঞ্চ ডুবিতে মারা গেছে তাদের শোক সহ্য করার মত ক্ষমতা দেও । আমীন ।