মৌচাকের মোড় ঘুরতেই পিছনের ছেলেদের মাঝে একটা মৃদু শোরগোল উঠলো । "মামা জোরে" "মামা জোরে", প্রতিদিনই এই এক খেলা । "শ্রাবণের" সাথে "কিন্চিতের" একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা । সকাল সাতটার বাস । জয়ী বসে আছে সামনের সিটের জানালার পাশে । প্রতিদিন সকাল ৬টায় উঠে অনেক তাড়াহুড়া করে বাস ধরতে ছোটা । প্রায়ই ওঠার পর বসার জন্য সিট পাওয়া যায়না । সকালে অফিসমুখী মানুষের ভীড় বর্ধিষ্নু এখন । দিনের শুরুতেই ট্রাফিক জ্যাম, গরম আর ঘুমঘুমে ভাব কেমন যেন ক্লান্তির একটি বলয়ে মনটাকে আবৃত্ত করতে চায় । মৌচাকের মোড়ে প্রায়ই শ্রাবণের সাথে কিন্চিতের মোলাকাত হয় । তখন এই দুই বাসের মৃদু উত্তেজনার প্রতিযোগিতার খেলাটা জয়ী বেশ উপভোগ করে ।
মগবাজার, কাকরাইলের মোড় ঘুরে শাহবাগ পর্যন্ত একটা টানটান উত্তেজনা । নাহ! আজ কিন্চিত এগোতেই পারছেনা । শাহবাগের ফুলের দোকানগুলো তাদের পসরা সাজাচ্ছে । অক্টোবরের শুরু । শীত পড়বে পড়বে । ফুলের বর্ণিল মেলা শুরু হবে । জয়ী একটা বড় করে নিঃশ্বাস নিল । এতদিন হয়ে গেল ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে! আজও ইউনিভার্সিটিতে ঢুকলেই ওর মনটা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যায় । অনেক সময় সারাদিন তপ্ত রোদের পর হঠাৎ যখন আকাশে মেঘ ঘনায়, কোথা থেকে ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করে, প্রথম বৃষ্টির কয়েকটা ফোটা শুকনো ধূলায় কেন একটা সোঁদা গন্ধ ছড়ায় তখন মনটা যেমন একটা অন্যরকম আনন্দে কেমন করে ওঠে - জয়ীর মনে হয় ওর ইউনিভার্সিটিতে ঢোকার আনন্দটা অনেকটা ওরকম ।
পাশের মেয়ে দুটো পুরোটা পথ গল্প করছে । মনে হয় একই সাবজেক্টে পড়ে । নাম ধরে টীচারদের বদনাম হচ্ছে, হঠাৎ করেই অপ্রাসঙ্গিক ভাবে হলুদ জামা পড়া মেয়েটা একটা ডাই করা শাড়ি বের করলো ।
"কাল এটা করলাম - দ্যাখতো কেমন হয়েছে"?
ও মা!! কি সুন্দর!!! সাদা জামার উচ্ছ্বাস ।
ভালোই লাগছে তো শাড়ীটা!!
দেখতে দেখতেই বাসটা এসে মসজিদ গেটে থামলো । জয়ীর চোখ তৃষ্নার্ত । চেয়ে আছে মসজিদ গেটের পাশে ছায়া ছায়া রাস্তাটার দিকে । ছেলেমেয়েরা ধীর পায়ে দলবেধে হাটছে । হলুদ জামা.. সাদা জামাও হারিয়ে যাচ্ছে দূরে । আবার দেখা হবে?? জানেনা। হবে হয়তো!!
আর্টস ফ্যাকাল্টির সামনে আসলেই জয়ীর মনটা একটু খারাপ হয় । ওর মনে হয় ইকনোমিক্স না নিয়ে সায়েন্স পড়ার ডিসিশানটা নেয়া ওর জন্য ঠিক হয়নি । দুপুর বেলা কার্জন হলের নীরব পরিবেশ থেকে জয়ী রিকশা করে আর্টস ফ্যাকাল্টির পাশ দিয়ে যায়, ওর মনে হয় সামনে নানা রঙের বুননে একটা নির্বাক চলচ্চিত্র হচ্ছে - ও তার দর্শক । ছোট ছোট গ্রুপ, হাসি ঠাট্টার প্রান্জল চিত্র , কখনও হঠাৎ করে জোর গলার মিছিল, কোথাও হয়তো অজানা কোন উপলক্ষ্যের ছোট্ট সামিয়ানা টাঙানো অনুষ্ঠান, এমনকি ঝালমুড়ি মামাদের সংখ্যাও কার্জন হলের দশগুন । জয়ীর মনে হয় - এটা একটা অন্য জীবন । ওর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এই মাত্রাটা নেই ।
মনটা খারাপ হলো । ১১ মাস হতে চললো বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছে । সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে! "শ্রাবণ " ঘুরে কার্জন হলে নামিয়ে দিলো শেষ কজনকে । পরিচিত কাউকেইতো দেখা যাচ্ছেনা !! ক্লাসে এসে দেখে মিতু আর রিনি বসে আছে আগেই ।
কি রে?? মিতুর প্রশ্ন ।
"ভালো", কথাটা বলেই জয়ীর মনে পড়লো ৯টার ক্লাসের এ. কে.র এসাইনমেন্টটাই আনা হয়নি । কথাটা ভাবতেই জয়ীর মনে ক্লান্তি ঢুকে পড়লো এক টুকরো ।
"শোন! আমি এ্যাসাইনমেন্টটা বাসায় ফেলে এসেছি "।
"ওমা!! কি হবে?? এক কাজ কর! বাসায় যেয়ে নিয়ে আয়", রিনির সরল জবাব ।
জয়ীর খুব বিরক্ত লাগছে । কাল রাত সাড়ে বারোটা জেগে ও এ্যাসাইনমেন্টটা রেডি করেছে । এ. কে. এমনিতেই ভীষন রগচটা । তাকে কোনমতেই যুক্তি দিয়ে বোঝানোর সাহস জয়ী দেখাতে যাবেনা । আজকে আর ক্লাসই করবেনা - এই সিদ্ধান্ত জয়ী খুব দ্রুতই নিয়ে ফেললো । বন্ধুদের জানিয়ে বেরিয়ে আসলো বাইরে ।
বিরক্তির টুকরোটা বাড়তে বাড়তে মেঘ!! কি করা যায় !! কোথায় যাওয়া যায়!! বাসায় যাবে? নাহ!.... হেথা নয় .... হেথা নয়... অন্য কোথা... অন্য কোনখানে ।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ সকাল ৮:৩৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




