১
ইন্টারমেডিয়েট পর্যায়ের পড়াশোনার জন্য যখন ঢাকা কলেজে ভর্তি হই, তখন বামপন্থী রাজনীতির সাথে প্রথম পরিচয় হলো। পৃথিবীর তাবৎ নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষকে উদ্ধার করার পবিত্র ও মহান দায়িত্ব যে কলেজ-পড়ুয়া সাহসী ও প্রগতিশীল তরুনদের উপরই বর্তায়, তা একপ্রকার নিশ্চিত জেনেই কারণে-অকারণে বড় ভাইদের সাথে মিছিল-মিটিং-এ অংশ নিতাম। তখন "বুর্জোয়া" ছাড়াও, "প্রগতিশীল"-এর উল্টো আর একটা অভিব্যক্তি খুব উচ্চারিত হতো বড়ভাইদের মুখে মুখে - সেটা হচ্ছে "প্রতিক্রিয়াশীল"। প্রাথমিকভাবে জামাত-শিবির বা ধর্ম-কর্ম যারা পালন করেন, তাদের বোঝাতে শব্দটা ব্যববহার করলেও - যারাই "কমরেডতন্ত্র"কে অপছন্দ করতেন, এটা ছিল তাদের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেয়া একপ্রকার গালি।
২
এই ব্লগে অনেকদিন ধরেই নাম লেখানো থাকলেও, আমি নিয়মিত ব্লগার নই - আমার ব্লগে আসাটা অনেকটা ঝটিকা সফরের মত। সেই ঝটিকা সফরে লেখাগুলোতে চোখ বুলাতে বুলাতে যদি কোন লেখা ভালো লাগে, তবে হয়তো ২/১ টা মন্তব্য করা বা প্লাস দেয়া হয়। আর যদি খুব বেয়াদবী কোন লেখা চোখে পড়ে, যেখানে কেউ আমাদের মত গণ-মানুষকে, আমাদের বিশ্বাসকে আক্রমণ করে - অথবা, আমরা কি ভাববো কি ভাববো না, কি বিশ্বাস করবো বা করবো না তা ঠিক করে দিতে চায় - তখন হয়তো সেটার প্রতিবাদ করতে চেষ্টা করেছি। আল্লাহ অথবা তাঁর রাসূলকে (সা.) কেউ যখন অপমান করে, বা যখন দেখি কেউ ইসলামকে বিনির্মাণ করার চেষ্টা করছে তখন মুসলিম হিসাবে স্বভাবতই বুকে লাগে - তাই প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছি। অনেক সময়ই যেখানে বা যে পোস্টে কোন বক্তব্যে/মন্তব্যে খারাপ লাগে, সেই পোস্টে প্রতিবাদ করাটা যথার্থ মনে হয় না। বরং সে বিষয়ে আলাদা একটা পোস্ট দিয়ে আমার অবস্থান ও বক্তব্যকে উপস্থাপন করাকে যথার্থ মনে হয়। সেজন্যই দুর্ভাগ্যবশত, আমার অধিকাংশ পোস্টকে কারো কাছে proactive মনে না হয়ে reactive মনে হতে পারে। আজকেরটাও তার ব্যতিক্রম নয়।
৩
তার সাথে মাত্র কয়দিন আগে ব্লগে পরিচয় হলো। তার একটা লেখা স্টিকি হয়েছিল - জনকল্যাণমূলক তথ্য সম্বলিত লেখা -খুবই সুন্দর! তার লেখায় দেখলাম সকল মতের পাঠক-পাঠিকা জড়ো হয়ে বাহ্বা দিচ্ছেন - রীতিমত "বাঘে-মহিষে" এক ঘাটে পানি খাওয়ার মত ব্যাপার।বুঝলাম তিনি খুবই জনপ্রিয় ব্লগার ছিলেন - মাঝখানে বেশ কিছু সময় অনুপস্থিত থেকে এখন আবার ব্লগে এসেছেন। করোনা ভাইরাস নিয়ে লেখা তথ্যবহুল ঐ পোস্টটার লিংক আমি আমার পরিবারের সদস্যদের দিয়েছি - তারা যেন তথ্যগুলো সম্বন্ধে অবগত হয় সেজন্য। এরপরই দেখলাম ঐ জনপ্রিয় ব্লগার, কুর'আনের ভাষা (আরবী) নিয়ে একটা সুন্দর লেখা পোস্ট করলেন। আমি খুব অবাক হলাম ২ টা কারণে: ক) সামুতে কুর'আনের ভাষা শিক্ষা নিয়ে পোস্ট দিয়েছেন বলে। খ) পোস্টটা তিনি শুরু করেছেন "বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। আসসালামু আলাইকুম।" বলে। নাস্তিক/মুরতাদ infested সামুতে দু'টো বিষয়ই আমার কাছে অভাবনীয় মনে হয়েছে। আমার ব্যক্তিগত জীবনের জাহেলী অধ্যায়ে "রবীন্দ্র সঙ্গীত সন্ধ্যায়" যখন শিল্পকলা একাডেমীতে গান শুনতে যেতাম, তখন খেয়াল করতাম যে, ৮৭% মুসলমানের দেশের নাগরিক হলেও, (আমি সহ) শ্রোতা দর্শকদের মাঝে ধর্ম-কর্মের কোন বালাই নেই (নাউযুবিল্লাহ্ ও আস্তাঘফিরুল্লাহ্) - কোনদিক দিয়ে মাগরিবের সময় চলে যাচ্ছে বা এশার আযান ধ্বনিত হচ্ছে - তার কোন প্রভাবই ঐ অডিটরিয়ামের উপর নেই। পরে, ইসলামে ফিরে আসার পর (অর্থাৎ practicing Muslim হবার পরে), ভাবতে চেষ্টা করেছি যে, কখনো যদি ভরাট গলার ঢুলু চোখের জাতীয় পর্যায়ের গাইয়ে, তার স্বাগত ভাষণ "আস সালামু আলাইকুম ও রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু" বলে শুরু করতেন, তা হলে ঐ অডিটরিয়মে কি অবস্থা দেখা যেতো? ৮৭% মুসলিমের দেশের রবীন্দ্র অনুরাগীদের অনেকেই হয়তো মূর্ছা যেতেন - মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত স্বাভাবিক ও সুন্নাহ্ ঐ সম্ভাষণে! কারো হয়তো ব্যাপাটাকে মনে হতো, শীতের রাতের "ভরা মজলিসে" ঠান্ডা পানি স্প্রে করে পরিবেশ প্রতিবেশকে "বরফ শীতল" করে দেয়ার মত। অথচ, ঐ গাইয়ের বাবা তাকে একটা সুন্দর ইসলামী নাম দিয়েছিলেন - যার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্টময় অংশটা পরবর্তীতে তিনি "ছেঁটে" বাদ দিয়েছেন। নামের "তাক্বিউল্লাহ্" অংশটা বুঝিবা রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাথে "যায়" না বলে তার মনে হয়েছে! এত কথা বললাম এটা বোঝাতে যে ঐ জনপ্রিয় ব্লগারের "বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। আসসালামু আলাইকুম।" লেখা দেখে আমি কেন অবাক হয়েছি! ঐ ক'টি শব্দের ভিতর আল্লাহর ৪টি নাম রয়েছে। আল্লাহ্-রাসূলের নাম শুনলে ব্লগের ৫-তারাদের অনেকেরই চুলকানি শুরু হয়। তা জেনেও ঐ জনপ্রিয় ব্লগার কেন ঐ শব্দগুলি ব্যবহার করেছেন, সেটা আমাকে বেশ ভাবিয়েছে। একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি: "বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। আসসালামু আলাইকুম।" তিনি কেবল আরবী ভাষা নিয়ে লেখা ঐ পোস্টেই যুক্ত করেছেন - এর আগের বা পরের পোস্টে করেন নি! এটাও হতে পারে যে, আযান শুনলে শয়তান যেমন নিষ্ক্রান্ত হয়, তেমনি ৫-তারা কাফির/মুশরিক/মুরতাদ/নাস্তিকরা আরবী লেখা দেখেই ঐ পোস্ট আর ঢুকবে না, কেবল মুসলিমরাই পড়বে লেখাটি - এটা ভেবেই হয়তো তিনি আল্লাহর নামগুলো যুক্ত করেছেন।
"৪"
যে কারনে এই লেখাটার চেষ্টা সেটা বলার আগে ছোট্ট একটা গল্প বলে নিই: পেশাগত পড়াশোনার জন্য একসময় যখন উত্তর-পূর্ব ইংলন্ডের একটা শহরে থাকতাম, তখন আমার ক্লাসে খুব হাসিখুশী নাদূস-নূদূস একটা শ্রীলংকান ছেলে ছিল। পড়াশোনার পর্ব শেষে পরীক্ষার আগে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। একেকজন একেক সেন্টারে পরীক্ষা তথা orals দেই। তখনকার দিনে orals শেষেই আমাদের বলে দিত কে পাশ করেছি, কে করিনি। পরীক্ষার ক'দিন পরে শহুরে রেলে বাসায় ফিরছি, হঠাৎ মিটার ৫০-এক দূরে দেখি ঐ শ্রীলংকান ছেলেটা - সদাহাস্য মুখে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। তার হাসি দেখে আমি ভাবলাম, সে নিশ্চয়ই পরীক্ষায় উৎরে গেছে। কাছে এসে বললো যে, তার পরীক্ষক তাকে orals-এ ঘন্টখানেক আটকে রেখে পরে একটা বিশেষ দিনের পরীক্ষার ২ পেপার সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বললো: "Your morning paper was good ...." - এই বলে আমার সেই শ্রীলংকান সহপাঠী হা হা করে হেসে বললো: "তার মানে বুঝলে না? My afternoon paper was not good! বেটা আমাকে একঘন্টা ধরে আটকে রেখে কত প্রশ্ন করলো - তারপর ফেল করিয়ে দিল!"
"শেষ"
আমার এই লেখায় উল্লেখ করা শ্রদ্ধেয় ঐ জনপ্রিয় ব্লগারের পরবর্তী লেখাটা ছিল আরেকটি "বাঘে-মহিষে" এক ঘাটে পানি খাওয়ানো লেখা - যথারীতি আরেকটি "হিট": লাভ অবসেশনঃযে প্রেম জীবন তছনছ করে দিতে পারে। এধরনের লেখায় আমি সাধারণত উকি দিই না আমি - আমার কাছে এসব বিষয়কে "talking for talking's sake" মনে হয়। কিন্তু ভদ্রলোকের সাথে পরিচয়ে একধরনের সমীহের বোধ জন্ম নেয়ায় ভাবলাম একটু পড়ে দেখি। দেখলাম অনেক তথ্য ও তত্ত্ব রয়েছে। দেখলাম Love Vs Obsession-এর একটা তালিকা রয়েছে (পাশে ভালোবাসা নিবেদনের একটা ছায়া-চিত্রও রয়েছে)। যেখানে "অবসেশনের" মত অসূরের বিপরীতে "লাভ"কে স্বর্গীয় দেবতার মত করে উপস্থাপন করা হয়েছে। Obsession খারাপ, কিন্তু Love মহৎ - এমনটাই বুঝবে যে কেউ! আচ্ছা এ পর্যন্ত এই লেখাটা যারা পড়েছেন, তারা সত্যি করে বুকে হাত রেখে একটা কথা বলুন তো: এই যে এতক্ষণ ধরে যে "লাভ" শব্দটা শুনলেন, আপনাদের কি বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার কথা মনে হয়েছে? নাকি pre-marital বা extra-marital passionate love-এর কথা মনে হয়েছে? নিশ্চয়ই বিবাহপূর্বক বা বিবাহবহির্ভূত আবেগঘন ভালোবাসার কথাই মনে হয়েছে?? আমি ঐ পোস্টে মন্তব্যে লিখলাম: "সকল মুসলিমের জানা উচিত যে, passionate love ইসলামে হারাম!" প্রতিউত্তরে তিনি বললেন: "আমরা এখানে এমন একটা রোগ নিয়ে আলোচনা করছি যেটা সকল ধর্মের মানুষ এবং নাস্তিকদেরও হতে পারে। আপনার ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে উচ্চারিত কথার প্রতি পূর্ণ সম্মান জানাচ্ছি।" আমার তখন মনে হলো তিনি আমাকে বলছেন: "এসবের ভিতর আবার ধর্মকে টেনে আনা কেন?" অথচ, তার তো জানার কথা, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের বিষয়ে ইসলামের একটা say রয়েছে! সকালে ঘুম থেকে উঠে বসার পর থেকে, রাতে অবসরে বা বিছানায় যাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি কাজের ব্যাপারে ইসলামের দিক-নির্দেশনা রয়েছে। কাউকে মুসলিম হতে হবে এমন কোন কথা নেই! কিন্তু যিনি নিজেকে মুসলিম বলবেন, তাকে তো ইসলামকে একটা পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থ হিসাবে গ্রহণ করতে হবে, তাই না? যেমনটা অস্ট্রীয়-জার্মান ধর্মান্তরিত মুসলিম মুহাম্মদ আসাদ তার বইতে বলেছেন: "Islam leads a man to a unification of all aspects of life. Being a means to that goal, this religion represents in itself a totality of conceptions to which nothing can be added and from which nothing can be subtracted" [Page#93, Islam at the Crossroads]
শ্রদ্ধেয় ব্লগার "আপনার ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে উচ্চারিত কথার প্রতি পূর্ণ সম্মান জানাচ্ছি।" বলে কি বোঝাতে চেয়েছেন আমি ঠিক বুঝিনি। "ধর্ম যার যার, ভালোবাসা সবার" - এমন কিছু কি? আমি তো তার ধর্ম এবং আমার ধর্ম, বা সকল মুসলিমের ধর্ম ও আমার ধর্ম এক জেনেই সবাইকে সতর্ক করতে চেয়েছি। ঐ পোস্টে "বাক-বাকুম" করা সকল বিশ্বাসী মুসলিমকে জানাতে চেয়েছি: passionate love ইসলামে হারাম!
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০২০ রাত ১:৩৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




