somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতি-বিস্মৃতিতে ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র’

০৯ ই আগস্ট, ২০২০ সকাল ১১:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[এই লেখাটি একজন প্রবাসীর, যিনি একটা বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত। তিনি আমার নিকটাত্মীয়ও বটে। এই ব্লগে তার কোন একাউন্ট নেই। আমি তাই লেখাটা তার অনুমতি নিয়ে, মুসলিম ভাই-বোনদের জন্য, আমার একাউন্টে শেয়ার করলাম।]


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। সকল প্রশংসাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার। সালাত ও সালাম রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর।

যারাই ইসলামের উসুল বা মূলনীতি নিয়ে পড়াশুনা করেছেন, তারা জানেন যে, ইসলামে কেবল কোন কাজের ফল (outcome) শুদ্ধ হওয়াটাই পর্যাপ্ত নয়, সেই ফল অর্জনের জন্য যে পদ্ধতি (means) অনুসরণ করা হচ্ছে তাও শরিয়াত সম্মত হওয়া আবশ্যক।

আল্লাহ কোরআনকে যে সকল নাম দিয়েছেন, তার একটি হচ্ছে নূর বা আলো। কোরআন আমাদের চিন্তাকে আলোকিত করে যাতে সত্য আর মিথ্যাকে আলাদা করে চেনা যায়। কোরআনের নূর হচ্ছে সেই আলো যা প্রত্যেক বস্তু বা চিন্তাকে তার প্রকৃত বাস্তবতার (actual reality) আলোকে দেখতে সাহায্য করে।

আর তাই ‘আলোকিত মানুষ’ তারাই, যাদের চিত্ত কোরআনের নূর দ্বারা আলোকিত, যাদের চিন্তা আল্লাহর পরিচয়ে আর একত্তবাদে পরিশুদ্ধ।

১৯৯৫। সবে এস-এস-সি পাশ করে নটর ডেম কলেজে ভর্তি হয়েছি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কলেজ পর্যায়ে বই পড়া কর্মসূচীর কথা আগে থেকেই জানতাম। আর তাই বই পড়া কর্মসূচীর রেজিস্ট্রেশান শুরু হতেই নাম লিখে এলাম। অধীর অপেক্ষা! আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ! যার কথা এতদিন কেবল শুনেছি আর টেলিভিশনে দেখেছি, এখন তাকে সরাসরি দেখব!

শুরু হলো! প্রত্যেক শুক্রবার সকালে একটি করে বই নিয়ে আলোচনা। বইটি পড়ে তার যে অংশগুলো ভাল লাগত তা লিখে রাখতে হত। আলোচনার সময় তা কাজে লাগত। প্রথম দিকে আমরা কেউই তেমন কথা বলতে পারতাম না, কিছুটা লজ্জা, কিছুটা ভয় আর কিছুটা confidence এর অভাব। স্যার রাগ করতেন, বলতেন ‘তোমাদের দিয়ে কিছু হবে না’। সেই খোঁচা খেয়ে আমরা বলতে শুরু করলাম। স্যার এর বুদ্ধিদীপ্ত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে চিন্তা করতে শিখলাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর ‘বিসর্জন’ নিয়ে আলোচনা এখনো পরিষ্কার মনে আছে। যেন গতকালের ঘটনা।

স্যার জানতে চাইলেন, ‘বিসর্জন’-এর নায়ক কে? কয়েকজন দাঁড়িয়ে কাহিনীতে যে মহারাজা ছিলেন, তার কথা বলল। কেউ কেউ বলল পুরোহিতের পালক পুত্রের কথা। স্যার-এর চেহারা দেখে বুঝলাম যে কোনোটাই তার পছন্দ হচ্ছে না। ততদিনে আমার ‘মুক্তচিন্তার’ বাঁধন ছুটে গেছে। দাঁড়িয়ে বললামঃ ‘‘বিসর্জন’-এর নায়ক হচ্ছে পুরোহিত।’ এর পক্ষে কিছু যুক্তিও দিলাম। স্যার-এর মুখে হাসি! Confidence এর যা ঘাটতি ছিল, তা সেদিনই পূর্ণ হয়ে গেলো।

কর্মসূচীর প্রথম পর্ব শেষে এক হাজার টাকার বই পুরস্কার পেয়েছিলাম। সেই সময়ের হিসাবে অনেক টাকার বই। আর আমরা ‘উড়নচণ্ডী’রা মিলে ‘কথক’ নামে ম্যাগাজিন বের করেছিলাম। সেই ম্যাগাজিনের নাম নির্বাচন থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপন জোগাড়, কত ঘটনা। আমার একটা লেখাও ছিল সেই ম্যাগাজিনে।

কর্মসূচীর প্রথম পর্ব শেষে ঐচ্ছিক দ্বিতীয় পর্বে খুব অল্প কিছু পড়ুয়া টিকে রইলাম। সেই পর্বও যখন শেষ হলো, তখন আমরা যারা ছিলাম তারা একেক জন একেক বিষয় বেছে নিলাম পড়ার জন্য। আমি বেছে নিলাম রুশ সাহিত্য। এই পর্যায়ের সবচেয়ে লোভনীয় দিক ছিল আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার এর সাথে একক ভাবে আলোচনার সুযোগ। একেকটি বই পড়তাম আর তারপর স্যার এর সাথে আলোচনা করতাম, মুখোমুখি। তলস্তয়ের ‘Resurrection’ নিয়ে আলোচনার কথা এখনো পরিস্কার মনে পড়ে। এভাবে কিছুদিন আলোচনার পর একদিন স্যার বললেন যে আমার আর তার সাথে আলোচনার প্রয়োজন নেই, আমি এখন স্বাধীন ভাবেই পড়ে যেতে পারি। বুঝলাম, ‘মুক্তচিন্তার’ সার্টিফিকেট পাওয়া গেল!

এরকমই কোন এক আলোচনার দিন, স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমার স্কুল নিয়ে। যখন শুনলেন আমি ‘আইডিয়াল স্কুল’-এ পড়েছি, তখন একটি ঘটনা বললেন। উনারা আইডিয়াল স্কুলে গিয়েছিলেন স্কুল ভিত্তিক বই পড়া কর্মসূচী চালু করতে। স্কুলের তৎকালীন principal ফয়জুর রহমান স্যার (রাহিমাহুল্লাহ) সেই বই পড়া কর্মসূচী চালু করতে রাজি হন নাই। ফয়জুর রহমান স্যার বলেছিলেন যে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইগুলো ‘অনৈসলামিক’। তবে তিনি (ফয়জুর রহমান স্যার) বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে বলেছিলেন যে উনারা নিজেরাই আইডিয়াল স্কুলে নিজেদের বেছে নেয়া বই দিয়ে বই পড়া কর্মসূচী চালু করবেন। তখন আমার মনে পড়ল যে স্কুলে আমাদের ক্লাসের শেষের দিকে ক্লাস রুমে সেলফ আর কিছু বই এসেছিল।

সায়ীদ স্যার আমার মত জানতে চাইলেন, ফয়জুর রহমান স্যার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইগুলো সম্পর্কে যে কথাগুলো বলেছিলেন সে সম্পর্কে। আমি তখন কেন্দ্রের পক্ষ নিয়ে কিছু কথা বলেছিলাম। এই ঘটনা ১৯৯৬-৯৭ সালের।

আমার আরো প্রায় ৭ বছর লেগেছিল এটা বুঝতে যে, আসলে ফয়জুর রহমান স্যার-এর কথাটাই ঠিক ছিল, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর নয়।

“…আগামীতে যদি দেশের সবখানে গুচ্ছ গুচ্ছ প্রদীপের মতো উজ্জ্বল, বুদ্ধিদীপ্ত, আলোকিত সন্তানেরা জন্ম নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারে, তবে, অনেক পরে, একদিন, ওইসব মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন, উদার ও প্রগতিশীল মানুষের উৎকর্ষমণ্ডিত বেদনাবান হৃদয়, নিজ-নিজ কর্মজীবনের বিচিত্র উদ্যোগ ও নির্মাণের ভেতর দিয়ে যে-দেশ ও জাতিকে রচনা করবে তা সমৃদ্ধতর হবে বলেই আমাদের আশা।” (বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ওয়েব সাইট থেকে নেয়া কেন্দ্রের ‘ব্রত-লক্ষ্য-উদ্দেশ্য’)।

কেন্দ্রের এই ‘ব্রত-লক্ষ্য-উদ্দেশ্য’ নিয়ে এক কথায় কিছু লিখতে গিয়ে আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর একটি কথা মনে পড়লঃ

“كلمة حق يراد بها باطل”

কথাটি সত্য, কিন্তু এর উদ্দেশ্য অগ্রহণযোগ্য (বাতিল)।


এতে সন্দেহ নেই যে জাতির ‘আলোকিত সন্তানেরাই’ সমৃদ্ধতর জাতিকে রচনা করবে। গোল বাধে তখনই যখন বলা হয় এই আলোকিত সন্তানদের বৈশিষ্ট্য হলো তারা ‘মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন, উদার ও প্রগতিশীল’। মুক্তবুদ্ধিতা, উদারতা আর প্রগতিশীলতা – তিনটি শব্দই মনোহর, কিন্তু তাদের সংজ্ঞা অস্পষ্ট। কী কী গুণ থাকলে একজন মানুষকে আমরা মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন বলব? প্রগতিশীলতা আর রক্ষণশীলতার মধ্যে সীমারেখাটা কোথায়?

কোরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মুনাফিকদের (hypocrites) কথা বর্ণনা করেন এভাবেঃ যখন মুনাফিকদের বলা হয় যে তোমরা ফাসাদ তৈরী করো না, তখন তারা (মুনাফিকরা) বলে – ‘আমরা তো কেবল সংস্কারবাদী (reformists)’। যুগে যুগে ফাসাদ সৃষ্টিকারীরা মানুষের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তুলতে এমন ভাবেই সব fuzzy বাক্য ব্যবহার করেছে। মুক্তবুদ্ধিতা, উদারতা আর প্রগতিশীলতা – এগুলো হলো ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের আলোর মুখোশ, এর আড়ালে আছে অন্ধকার প্রকোষ্ঠ।

তার মানে কি আমি ‘মুক্তবুদ্ধিতা, উদারতা আর প্রগতিশীলতা’র বিপক্ষে? মোটেই নয়! আমি সেই ‘মুক্তবুদ্ধিতা, উদারতা আর প্রগতিশীলতা’র বিপক্ষে যার সংজ্ঞা আসলে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ (secularism)। আমি সেই ‘মুক্তবুদ্ধিতা, উদারতা আর প্রগতিশীলতা’র বিপক্ষে যার সংজ্ঞা সময়ের প্রভাবে পরিবর্তিত হয়। আমি সেই ‘মুক্তবুদ্ধিতা, উদারতা আর প্রগতিশীলতা’র বিপক্ষে যার সংজ্ঞা অজ্ঞেয়বাদীতা কিংবা নাস্তিকতা।

Amjad M. Hussain এর লেখা ‘A Social History of Education in the Muslim World’ নামে একটা চমৎকার বই আছে। লেখক Ottoman সাম্রাজ্যের পতনের পেছনে ‘Young Turk’দের যে ভূমিকা তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন যে, Ottoman শিক্ষা ব্যবস্থায় French এবং British Curriculum প্রবেশের কারণে এমন একটি প্রজন্ম তৈরী হয় যারা শেষ পর্যন্ত তুরস্ককে সেকুলারিজমের পথে নিয়ে যায়। এখানে এই উদাহরণটা দিলাম এই জন্য যে, আপনি আপনার সন্তানের হাতে যে বইটি তুলে দিবেন, মনে রাখবেন যে আপনি আসলে সেই বই এর লেখককে আপনার সন্তানের মননের ছাঁচ গড়ে দেয়ার সুযোগ করে দিলেন।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বিভিন্ন বই পড়া কর্মসূচীর বইগুলো আসলে কোমলমনা পাঠককে তাদের (পাঠকের) অলক্ষ্যে সেকুলারিজমের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য সুচিন্তিত ভাবে নির্বাচন করা। অন্তত আমাদের সময় যে বইগুলো পড়তে দেয়া হত, সেগুলো তো বটেই। বুয়েটে পড়ার একদম শেষের দিকে বিভিন্ন কারণে আমাদের ‘মাননীয়’ সেকুলার পণ্ডিতদের থেকে এতদিন জেনে আসা ধর্ম (মূলত ইসলাম) বিষয়ক ‘তথ্য’ যাচাই করতে গেলাম। সুবহানাল্লাহ! আমার শ্রদ্ধেয় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ-এর শেখানো মুক্তচিন্তার সূত্র দিয়েই আল্লাহ দেখিয়ে দিলেন কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা। হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলাম এটা বুঝতে পেরে যে, আমাদের দেশের নামকরা সব পণ্ডিতেরা সৃষ্টিকর্তা এবং ইসলাম সম্পর্কে কত যে ভিত্তিহীন আর contradictory কথা বলেছেন।

এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করা প্রয়োজন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র যেসব মানবিক গুণাবলির কথা বলে, সেগুলো কিন্তু ইসলামের সঙ্গে পুরোপুরি mutually exclusive নয়। মুশকিল হচ্ছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তাদের পাঠ্যসূচীতে (অন্তত আমি যা দেখেছি) নিপূণভাবে ইসলামকে এড়িয়ে চলে। এটা যদি সব ধর্মের জন্য হত, তাহলে এক কথা ছিল। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার আমাদের এত কথা বলেছেন, কিন্তু তার কাছ থেকে কখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে কোনো কথা শুনিনি। অথচ তিনি (আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ) প্রায়ই আমাদের হিন্দু পুরাণ বা ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিতেন! আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বিভিন্ন লেখায় ‘মহাপুরুষদের’ কথা বলতেন। অথচ ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ‘মহাপুরুষ’ (অমুসলিমদের মাপকাঠিতেই) মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র একেবারেই নিশ্চুপ। আর সেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠ্যসূচীতে গৌতম বুদ্ধের জীবনীও আছে, আছে রামায়ন-মহাভারত। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার, শুদ্ধ চিন্তার সূত্র তো আপনার থেকেই শুরুতে শিখেছি; তবে এক যাত্রায় দুই ফল কেন? কেন পৌত্তলিকতা মহিমান্বিত হবে, আর এক আল্লাহর ইবাদাত হবে অবহেলিত?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার, আপনিই শিখিয়েছেন ‘নায়ক’ হচ্ছে সেই যার সংগ্রাম সর্বোচ্চ। সত্যের জন্য আজীবন সংগ্রাম করা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেন তাহলে আপনার ‘নায়ক’ হতে পারেন না, কিন্তু গৌতম বুদ্ধ হতে পারেন?

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত সংগঠকেরা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন যে বই পড়ে আলোকিত মানুষ হওয়া সম্ভব, যারা কিনা একটি জাতিকে সমৃদ্ধ করতে সক্ষম। তাদের এই বিশ্বাস না থাকলে এতো বছর ধরে কেন্দ্রের কার্যক্রম চালাতে পারতেন না।

যে কোনো বিশ্বাসের একটা ভিত্তি থাকে। ‘বই পড়ে আলোকিত মানুষ হওয়া’ যায়, এর প্রমাণ কী? ইতিহাসে কী এমন কোনো জাতির কথা লিপিবদ্ধ আছে যে জাতি ‘বই পড়ে’ সমৃদ্ধ হয়েছে?

আমি তো কেবল একটা উদাহরণই পাই। আর সেটা হচ্ছে কোরআনের দ্বারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীদের পরিবর্তন, আর সেই সাহাবীদের হাত ধরেই এক super power এর উত্থান। ইসলাম –পূর্ব আরবদের অবস্থা আর ইসলাম-পরবর্তী আরবদের অবস্থার মধ্যে ছিল অবিশ্বাস্য পার্থক্য। ইসলাম –পূর্ব যুগে যে জাতির কোনো মূল্যই ছিল না বিশ্ব ব্যবস্থায়, সেই জাতিই মাত্র ৩০ বছরের মধ্যেই হয়ে উঠেছিল বিশ্বের অন্যতম শক্তি। আর এর পেছনে ছিল কোরআন –এর শিক্ষা।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বা অন্য যারাই মানব-সৃষ্ট জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে লক্ষ্য কোটি আলোকিত মানুষ তৈরী করতে চান, তাদের সেই আকাঙ্খা পূরণ হবার নয়। মানুষ কেবল জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে আলোকিত হয় না, প্রকৃত আলোকিত মানুষ তার মূল্যবোধে বিশ্বাস করে। জ্ঞানী এবং বিশ্বাসী মানুষেরাই পারে জাতিকে পরিবর্তন করতে। আর তা সম্ভব কেবল অহী (revelation) ভিত্তিক জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে।

মানব-সৃষ্ট জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে আলোকিত মানুষ তৈরী করতে চাওয়া আসলে philosophical method। এই পদ্ধতি মূলত একটি open ended পদ্ধতি, কারণ এখানে জ্ঞানের পুরোটাই হলো probabilistic। আর এতে আজকে যা মূল্যবোধের মাপকাঠিতে ঘৃণিত, কাল সেটাই আধুনিকতা আর প্রগতিশীলতা। গতকাল যে সমকামীতা ঘৃণিত ছিল, আজ তা অনেকের কাছে স্বাভাবিক। আপনি কোন মূল্যবোধে আলোকিত মানুষ গড়বেন, যেখানে প্রকৃত অর্থে মূল্যবোধের কোনো মানদণ্ডই নেই?

‘এককে-দশকে নয়; সহস্রে, লক্ষে’ আলোকিত মানুষ পেতে হলে আমাদের আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার প্রেরিত জ্ঞানের দিকেই ফিরে যেতে হবে। আল্লাহ প্রেরিত মানদণ্ডই হচ্ছে মূল্যবোধের প্রকৃত এবং অপরিবর্তনীয় মানদণ্ড। এতে সময়ের সাথে ethical principles-এর পরিবর্তন হয় না। আল্লাহ অনুমোদিত মূল্যবোধে আলোকিত মানুষেরাই তাদের জাতিকে পরিবর্তন আর সমৃদ্ধ করতে নিজের জীবন দিতে প্রস্তুত থাকে।*

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র নিয়ে এরকম একটি লেখা আমি অনেক দিন থেকেই লিখব বলে ভাবছিলাম। লেখা হয়ে উঠছিল না। কয়েক দিন আগে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার-এর একটি সাক্ষাৎকার পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। সাক্ষাৎকারটি থেকে কিছু অংশ তুলে দিচ্ছিঃ

‘আমি একসময় মনে করতাম, প্রকৃতি হচ্ছে অচেতন প্রকৃতি, আর মানুষ সচেতন ও মেধাবী প্রকৃতি। কিন্তু এখন আমি এ ধারণা থেকে সরে এসেছি। এখন আমার ধারণা, প্রকৃতি অন্তহীন চৈতন্যসম্পন্ন, প্রকৃতি বুদ্ধিমান। এবং এই অন্তহীন বিশ্ব চরাচরের সমাপ্তি আমরা খুঁজে পাব না। আমি বিশ্বাস করি যে প্রকৃতির মধ্যে একটা চৈতন্য থাকার কথা; নইলে তা টিকে থাকতে পারত না। প্রকৃতি সুবিন্যস্ত, স্বয়ংক্রিয়, স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং যান্ত্রিকভাবে তার নিজস্ব নিয়মে নিখুঁতভাবে পরিচালিত হচ্ছে।’ (সাক্ষাৎকার: আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ – ‘পরস্পর যুক্ত হলেই মানুষ বাঁচে’. প্রথম আলো, ৩১ জুলাই ২০২০)

মনটা খারাপ হয়ে গেল এই জন্য যে অনেকের কাছে আদর্শ সায়ীদ স্যার এই মহাবিশ্বে একজন অন্তহীন চৈতন্যসম্পন্ন, সুবিন্যস্ত, স্বয়ংক্রিয়, স্বয়ংসম্পূর্ণ কারো অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারলেন না জীবনের সায়াহ্নে এসে। স্রষ্টার নামটাই কেবল নিলেন না, কিন্তু স্রষ্টার গুণাবলি প্রকৃতিকে দিয়ে দিলেন।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে কোরআনের নূর দ্বারা আলোকিত মানুষ হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমীন।

নিশ্চয়ই সকল সাফল্য কেবল আল্লাহর তরফ থেকেই।

অগাস্ট ৩, ২০২০

=====

* Philosophical methods এবং Qur’anic methods এর মধ্যে তুলনামূলক আলোচনার জন্য দেখুন Umar Suliman Al-Ashkar-এর Beliefs in Allah বইটি।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:০১
৪টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×