বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস দেশের জাতীয় পতাকাবাহী বিমান সংস্থা। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হতে পারেনি। কেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস লাভজনক নয়, সেই কারণগুলো বিশ্লেষণ করা জরুরি।
১. অদক্ষ পরিচালনা ও রাজনৈতিক প্রভাব
বিমান পরিচালনায় কখনোই অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। বরং রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বা সরকারি সচিবরা এই সংস্থার পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। তাদের অ্যাভিয়েশন বিষয়ে দক্ষতা না থাকায় নীতিনির্ধারণে ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে, যা বিমানের আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২. অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ও লিজ বাণিজ্য
২০০৯ সালের পর বিমানের পরিচালনায় ব্যাপক দুর্নীতি ও লিজ বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। বিশেষ করে ২০১৪ সালে মিসরের ইজিপ্ট এয়ার থেকে বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর মডেলের দুটি প্লেন লিজ নেওয়ার চুক্তিটি ছিল ত্রুটিপূর্ণ। মাত্র দেড় বছরের মাথায় বিমান দুটির ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়, ফলে বিমানের বড় অঙ্কের ক্ষতি হয়। পাঁচ বছরে প্রায় ১২০০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে এই চুক্তির ফলে।
৩. বিপুল ঋণ ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা
বিমানের অনিয়মিত আয় এবং ব্যয়বহুল পরিচালনার কারণে এটি ক্রমাগত ঋণের বোঝায় ডুবে যাচ্ছে। ইজিপ্ট এয়ার থেকে লিজ নেওয়া দুটি উড়োজাহাজের কারণে ৮৩৭ কোটি টাকা লোকসান হয়, যার জন্য বিমান স্থানীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। এর ফলে সুদসহ বিমানের দায়বদ্ধতা আরও বেড়ে যায়।
৪. রুট পরিকল্পনায় অদক্ষতা
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের রুট পরিকল্পনায় রয়েছে দুর্বলতা। লাভজনক রুটের চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় রুট নির্বাচন করা হয়েছে। ফলে লাভজনক রুটগুলোতে প্রতিযোগিতা বাড়লেও, বিমান তার সেবা উন্নত করতে পারেনি। তদুপরি, অনেকে অভিযোগ করেছেন যে, বিমানের টিকিটের মূল্য অন্যান্য এয়ারলাইন্সের তুলনায় বেশি, কিন্তু সেবার মান অনেক ক্ষেত্রে নিম্নমানের।
৫. সরকারি কর্মকর্তাদের বিলাসিতা ও দেনা
সরকারি কর্মকর্তারা ইকোনমি ক্লাসের টিকিট কেটে বিজনেস ক্লাসে ভ্রমণ করেন, যার ফলে বিমান রাজস্ব হারায়। এছাড়া, সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কাছে বিমানের টিকিট বাবদ কয়েক কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে, যা আদায় না হওয়ায় বিমানের আয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
৬. দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি
বিমানের বোর্ড ও প্রশাসনে বছরের পর বছর একই ব্যক্তিরা বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছেন, যার ফলে দক্ষ জনবল নিয়োগের সুযোগ কমে গেছে। অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির ফলে বিমানের উন্নতি সম্ভব হয়নি।
কী করা উচিত?
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে লাভজনক করতে হলে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি:
অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ: দক্ষ পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের দায়িত্ব দেওয়া উচিত।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা: রাজনৈতিক চাপের কারণে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা বিমানের ক্ষতির কারণ। এই প্রবণতা বন্ধ করা জরুরি।
দুর্নীতি দমন: দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে বিমানের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
সেবার মান উন্নয়ন: যাত্রীসেবার মান উন্নত করে প্রতিযোগিতার উপযোগী হওয়া দরকার।
লাভজনক রুট চিহ্নিতকরণ: লাভজনক রুটে বিমান পরিচালনার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বাণিজ্যিক ক্ষতির মূল কারণ অদক্ষ পরিচালনা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, দুর্নীতি এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। যথাযথ পরিকল্পনা ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা থাকলে বিমান লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারে। এখনই সময় পদক্ষেপ নেওয়ার, নতুবা জাতীয় পতাকাবাহী এই সংস্থার ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকার হতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ সকাল ১০:০০