স্বাধীনতার পর ভারতীয় বাহিনী ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে মার্চ ১৯৭২ পর্যন্ত সময় বাংলাদেশে অবস্থান করে। এই সময়ে কি পরিমাণ লুটপাট তাঁরা করে তা বর্ণনাতীত। তাঁদের লুটপাট মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষদেরকে হতবাক করে দেয়। ২১ শে জানুয়ারি ১৯৭২ সালে ব্রিটেনের বিখ্যাত গার্ডিয়ান পত্রিকায় সাংবাদিক মার্টিন ঊলাকট (Martin Woollacott) Indians ‘loot whole factory ‘শিরোনামে লেখায় লিখেন ; “Systematic Indian army looting of mills, factories and offices in Khulna area has angered and enraged Bangladesh civil officials here. The looting took place in the first few days after the Indian troops arrived in the city on December 17”.

সে সময় খুলনার ডিসি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের ক্যাবিনেট সচিব ডক্টর কামাল সিদ্দিকী। তিনি সে সময় ভারতীয় বাহিনীর এই লুটপাটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে চিঠি লিখেন। কামাল সিদ্দিকী পরবর্তীতে লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে করা তার পিএইচডি থিসিসে বাংলাদেশের দরিদ্রতার কারণ হিসেবে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তার থিসিসটি পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান থেকে বই আকারে বের হয়,সেই হিসেবে এটি সরকারী ভাষ্য হিসেবেও বিবেচনা করা যায়।
কামাল সিদ্দিকি নিজে সরকারী কর্মকর্তা হওয়ায় বিভিন্ন জেলার ডিসিদের সাথেও কথা বলে জানতে পারেন অন্যান্য জেলাতেও ভারতীয় বাহিনী একই ধরণের লুটপাট করে। ভারতীয় সৈন্যরা পাকিস্তানীদের ফেলে যাওয়া সকল অস্ত্র এবং ৮৭ টি ট্যাংক নিয়ে যায় যার মূল্য ৭৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
অনিক নামের একটি ভারতীয় সাপ্তাহিক পত্রিকার বরাতে কামাল সিদ্দিকি আরো লিখেন ভারতীয় সৈন্যদের লুটপাটের মধ্যে অস্ত্র ছাড়াও ছিল মজুদকৃত খাদ্য শস্য, কাঁচা পাট,সুতা, গাড়ি, জাহাজ,শিল্প প্রতিষ্ঠানের মেশিন ও যন্ত্রাংশ এবং অন্যান্য খাদ্য দ্রব্য। কামাল সিদ্দিকীর মতে সব মিলিয়ে কম করে ধরলেও এই লুটপাটের পরিমাণ ছিল তৎকালীন হিসেবে ২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! সে সময়ে সারা বাংলাদেশের ১৯টি জেলা থেকে লুটপাটের পরিমাণ কেমন হতে পারে সেটা অনুমান অসম্ভব নয়।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের আত্মজীবনীতে
বঙ্গভবনে ভারতীয় সৈন্যদের লুটপাটের বর্ণনা:
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পর ইত্তেফাকের নিখোঁজ সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেনকে মিরপুরে বিহারী বসতিতে খুঁজে না পেয়ে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বঙ্গভবনে দেখা করেন ভারপ্রাপ্য রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে। এ সময় তিনি সাবেক গভর্নর হাউসে ভারতীয় সৈন্যদের লুটপাটের চিত্র প্রত্যক্ষ করেন। এ ব্যাপারে তিনি ‘আমার জীবন আমাদের স্বাধীনতা’ শিরোনামে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের ১০৭ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন,
‘দেখলাম বঙ্গভবনে কার্পেট, ঝাড়বাতি কিছুই নেই। সম্পূর্ণ খালি করে ভারতীয় সৈন্যরা নিয়ে গেছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে এসব কাজ কী করে শেষ করলো তাই ভাবছিলাম। অন্যান্য জায়গা থেকেও কার্পেট ইত্যাদি যা কিছু মূল্যবান পেয়েছে তাই তারা নিয়ে গেছে। বিডিআর ক্যাম্পে গিয়ে দেখি সেখানে সব ফাঁকা। যুদ্ধ শেষ। অতএব বিজয়ী শক্তি হিসেবে সব তাদের প্রাপ্য। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সোনার বারসমূহ নেয়া হয়েছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা এক মাসে আমাদের কাছ থেকে যেসব সম্পদ লুটপাট করে ক্যান্টনমেন্টে রেখেছিল তাও পাকিস্তানিদের ভোগে আসেনি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কারা বিজয়ী শক্তি? আমাদের জনগণের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী শক্তি তো আমরা। তাহলে মূল্যবান জিনিসপত্র ভারতীয় সৈন্যরা নিল কি করে?'
১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে বিশ্বাসঘাতক দেশদ্রোহী আওয়ামীলীগ ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দেবার ৭ দফা গোপন চুক্তি করে!
সোর্স: হক কথা পত্রিকা, ২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭২
এক: যারা সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে শুধু তারাই প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে নিয়োজিত থাকতে পারবে। বাকীদের চাকুরীচ্যুত করা হবে এবং সেই শূন্যপদ পূরণ করবে ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা।
দুই: বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে অবস্থান করবে [কতদিন থাকবে তার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় না]। ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাস থেকে আরম্ভ করে প্রতি বছর এ সম্পর্কে পুনরীক্ষণের জন্য দু'দেশের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
তিন: বাংলাদেশের কোন নিজস্ব সেনাবাহিনী থাকবে না।
চার: অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মুক্তিবাহিনীকে কেন্দ্র করে একটি প্যারামিলিশিয়া বাহিনী গঠন করা হবে।
পাঁচ: সম্ভাব্য ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে অধিনায়কত্ব দেবেন ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান; মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নন এবং যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়কত্বে থাকবে।
ছয়: দু'দেশের বাণিজ্য হবে খোলা বাজার (ওপেন মার্কেট) ভিত্তিক। তবে বাণিজ্যের পরিমাণ হিসাব হবে বছর-ওয়ারী এবং যার যা পাওনা সেটা স্টার্লিং -এ পরিশোধ করা হবে।
সাত: বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের প্রশ্নে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলবে এবং ভারত যতদূর পারে এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে সহায়তা দেবে।
** ভারত ও আওয়ামীলীগের মধ্যে আরেকটি অলিখিত গোপন চুক্তি ছিলো সেটি পাকিস্তান ভাগ করে বাংলাদেশ সৃষ্টির পরে বাংলাদেশে থাকা বিহারী, গুজরাটী, অবঙ্গালী পাকিস্তানীদের সকল অস্থাবর সম্পত্তি ভারত লুটপাট করে নিয়ে যাবে ও স্থাবর সম্পদ আওয়ামীলীগ নিবে। এই অলিখিত চুক্তির ফলেই বাংলাদেশ সৃষ্টির পরে ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানীদের সকল অস্ত্র, গোলাবারুদ, সোনা, টাকা, পাকিস্তানী মালিকানাধীন বিভিন্ন ফ্যাক্টরি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মেশিনারিজ ও কাচামাল থেকে শুরু করে সকল প্রকার অস্থাবর সম্পদ লুটপাট করে ভারতে নিয়ে যায়। আওয়ামীলীগ নেতারা ভারতীয় বাহিনীর লুটপাট ডাকাতির পাহারাদার ও সহযোগীতাকারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করে। এবং ভারতীয় বাহিনীর লুটপাটে বাধা দেবার কারনে মেজর জলিলকে গ্রেপ্তার করে কারাবন্দী করে রাখে।

"মেজর জলিল" কত বড় দাড়ি দেখেছেন, চুল বাবরিও রেখেছিলেন! মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র সেক্টর কমান্ডার যিনি কোন খেতাব পাননি!! তাঁর অপরাধ ছিল, যুদ্ধ শেষে যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের বিপুল অস্ত্রভান্ডার লুট করছিল, তখন তিনি বাঁধা দিয়েছিলেন, যশোর বেনাপোল সীমান্তে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এই অপরাধে? গ্রেফতারও হয়েছিলেন। হয়েছিলেন জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে স্বাধীন করা নিজ দেশে প্রথম রাজবন্ধী। মেজর এম এ জলিল সামরিক বাহিনীতে চাকুরিরত অবস্থায় বি.এ পাশ করেন৷ ১৯৬৫ সালে তিনি কমিশনপ্রাপ্ত হন এবং ১২নং ট্যাঙ্ক ক্যাভালরি রেজিমেন্ট অফিসার হিসেবে তৎকালীন পাক-ভারত যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন৷ ১৯৭০ সালে মেজর পদে উন্নীত হন৷ ১৯৭১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ছুটি নিয়ে বরিশালে আসেন এবং মার্চে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি নবম সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব লাভ করেন৷ গোটা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের ভিত্তি ছিলো হিট অ্যান্ড রান পদ্ধতি যা মেজর জলিলের উদ্ভাবন। গেরিলা যুদ্ধের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি এটি।
পূর্ব পাকিস্তানের ৭১ প্রকল্পটা ছিল আওয়ামী ভারতীয় মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডা গুজব আর জুলুমের উপর প্রতিষ্ঠিত, যার শুরুটা হয়েছিল নিরীহ বিহারী ও অবাঙ্গালী গণহত্যার মধ্য দিয়ে। এজন্যই এই ভূখন্ডে গত ৫৪ বছরে শান্তি আসেনি। দেশের অল্প বয়সি ছাত্র যুবকদের স্বাধীনতার কথা বলে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে দলে ভিড়ায়, আর মুক্তিযুদ্ধের ও তথাকথিত স্বাধীনতার পরে দেখা গেলো বাংলাদেশ হয়ে গেলো ভারতের কদর রাজ্য। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পরে ভারতীয় বাহিনীর নব্বই হাজার কোটি টাকা অস্ত্র গোলা বারুদ লুট, অন্যান্য পণ্য লুন্ঠন ডাকাতি পাচারে ও মুক্তিযুদ্ধের শুরু করা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের ব্যক্তিরা ও মুক্তিযোদ্ধারা পর্যন্ত কোন বাধা দেয়নি (শুধুমাত্র মেজর জলিল ছাড়া) কেউ। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো তাদের অনেকেই ভারতীয় বাহিনীর লুন্ঠন, ডাকাতি আর ধর্ষনে সহযোগীতা করেছে। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হলো ভারতীয় বাহিনীর লুন্ঠন ডাকাতি ও পাচারে বাধাদানকারী হিসাবে মেজর জলিলকে গ্রেপ্তার পর্যন্ত করেছে তথাকথিত স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন।
১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারী প্রেস কনফারেন্স করে জহির রায়হান ভারতীয় বাহিনীর সকল অপকর্মের তথ্য পুরো পৃথিবীর কাছে উন্মোচন করতে চেয়েছিলেন। সেইদিনই উনাকে মিরপুর থেকে গুম করে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যাকরে ভারত। আজপর্যন্ত তার লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



