somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্তকে কবর দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার

২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জাতির ইতিহাসে ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। এ মাসের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়। অবশ্য ১৬ ডিসেম্বর ৭২-এর পর কয়েক বছর পর্যন্ত মওলানা ভাসানী ১৬ ডিসেম্বরকে কাল দিবস হিসেবে উদযাপন করেছেন। এটা ছিল তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। এর পক্ষে তার শক্তিশালী যুক্তিও ছিল। বলা হয়—যখন জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করেন; তখন (ভারতীয়) জেনারেল অরোরার সঙ্গে ছিলেন ১০০ জন ভারতীয় ব্যবসায়ীর একটি দল, ১৫০ জন সাংবাদিক এবং ২০০ জন আমলা (দি টেলিগ্রাফের রিপোর্ট, সাংবাদিক আকবর ইমাম, ১৬ ডিসেম্বর-১৯৯২)। মনে করা হয়—এসব ব্যবসায়ী ও আমলারা এসেছিলেন বাংলাদেশের ব্যবসা ও প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য। অর্থাৎ, এইদিন বাংলাদেশকে নতুন করে পরাধীন করার আয়োজন হয়েছিল। এছাড়া আরো অনেক যুক্তি মওলানা ভাসানীর ছিল

যাক এসব কথা! ১৬ ডিসেম্বর ৭১-এ যাদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ ছিল, সেই পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং আমাদের দেশ ও জনগণ মুক্ত হয়। ডিসেম্বর ৭১-এ আরেকটা বড় ঘটনা ঘটে, সেটা বুদ্ধিজীবী হত্যা। বিজয়ের আলোয় যখন দেশ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে, ঠিক সে সময় বাংলাদেশের কিছু খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, পেশাজীবী বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। চোখ বন্ধ করে এর দায় চাপানো হয় রাজাকার, আলবদর এবং পাকিস্তান বাহিনীর ওপর। সে সময়ের জন্যে এটাই ছিল স্বাভাবিক। পরবর্তীকালেও এ নিয়ে ব্লেম-গেম চলেছে, কিন্তু কোনো তদন্ত, অনুসন্ধান হয়নি, সত্যও উদঘাটিত হতে পারেনি। দায় চাপানো, দায় এড়ানোর কাজ কিন্তু খুব জোরেশোরেই চলেছে-চলছে। সৈয়দ মবনু তার ‘লাহোর থেকে কান্দাহার’ বইতে আত্মসমর্পণকারী একজন পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে তার এক কথোপকথনের বিবরণ এভাবে লিখেছেন—
‘আপনারা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলেন কেন?’
রাও ফরমান আলী : ... ‘তখন ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণে ঢাকাসহ গোটা পূর্ব পাকিস্তান ছিল। আমার প্রশ্ন হলো—তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করল কে? আমি মনে করি, এ জন্য যদি কাউকে দায়ী করতে হয়, তবে তা অবশ্যই ভারতকে।
‘আচ্ছা বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে রাজাকার বাহিনী কি জড়িত ছিল?’
‘আমি কী বলব। তবে আমার ধারণা ওরা জড়িত ছিল না। কারণ আমাদের আত্মসমর্পণের দুদিন আগেই ওরা পালাতে শুরু করে। রাজাকারদের অবস্থা (ছিল) না ঘরকা না ঘটকা। তাদের পক্ষে এত বড় কাজ করার সুযোগই ছিল না।’
‘তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন ভারত করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—তারা করবে কেন?’
‘হ্যাঁ, ভারত করতে পারে। আমাদের বা রাজাকারদের যে কারণে সন্দেহ করা হচ্ছে, একই কারণে ভারতও করতে পারে।’ (আবাবীল পাবলিকেশন্স, ২০০০, পৃষ্ঠা : ১৫৬-১৫৭)

আরেকটি চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে। সাংবাদিক আকবর ইমাম স্বনামে অধুনালুপ্ত ‘দি টেলিগ্রাফ’ নামক ইংরেজি দৈনিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বরাত দিয়ে লেখেন, ‘১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঐ শিক্ষক তাকে জানান যে, ভারতের ছত্রীসেনারা ৮ ডিসেম্বরের মধ্যেই ঢাকায় অবতরণ করে এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। এই কথা জানতে পেরে ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ভারতীয়রা আত্মসমর্পণের মুহূর্তটি দুদিন পিছিয়ে ধার্য করে ১৬ ডিসেম্বর। এ সময়ের মধ্যে বিশেষ করে ১৪ ডিসেম্বর তারা বুদ্ধিজীবী নিধন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে।’ (আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল, সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা : ৫৭৫-৫৭৬, বুকস ফেয়ার, মে ২০০৪)

সরকার শাহাবুদ্দীন তার ‘আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল’ গ্রন্থে লেখেন, ‘একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বরের দিকে ঢাকা শহরে রাজাকার, আলবদরদের কোনো কার্যকারিতা ছিল না। সে সময় কারা হত্যা করেছিল নিজ নিজ গৃহে অবস্থানকারীদের—এ নিয়ে ৩৩ বছর ধরে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। নিহত বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের চাপে পরবর্তীকালে যে তদন্ত কমিশন (দেশি) গঠন করা হয়েছিল, এর রিপোর্ট আজ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। যখন তদন্ত কমিটির রিপোর্ট সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়, তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। অথচ রহস্যজনক কারণে এই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ধামাচাপা দেওয়া হয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে—রাজাকার-আলবদররা যদি সত্যি সত্যিই এর জন্য দায়ী হয়ে থাকে, তাহলে তখনই তাদের বিচার করে কঠোর শাস্তি দেওয়া হলো না কেন? যুদ্ধের পরপরই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং শাস্তিই তো স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু কেন কোনো সত্যকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সব ব্যাপারকে রহস্যময় করে রাখা হলো?’ (ওই, পৃষ্ঠা : ৫৭১)
শুধু রিপোর্ট ধামাচাপা দেওয়া নয়, বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কিত সংগৃহীত দলিলপত্রও গুম করে ফেলা হয়। উল্লেখ্য, বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং তার কয়েক দিন পর শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারের ছোট ভাই প্রতিভাবান, অনুসন্ধিৎসু ও সাহসী চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানও গুম হন। বুদ্ধিজীবী হত্যার মতো তারও গুম বা হত্যার কোনো তদন্ত হয়নি। বুদ্ধিজীবী হত্যার দলিলপত্রের মতো জহির রায়হানের গুম হওয়া-সংক্রান্ত পুস্তকাদি এবং তার সংগৃহীত বিপুল পরিমাণ ফুটেজ, রেকর্ড ও দলিলও গুম হয়ে যায়। এ সম্পর্কে শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার (জহির রায়হানের ভাবি) দৈনিক বাংলার বাণীতে ১০ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৯৯ (১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দ) তারিখে প্রকাশিত তার ‘কবিতা মিলনকে মিথ্যা সান্ত্বনা’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেন, ‘৩০ জানুয়ারি (১৯৭২) জহির রায়হান একটি ফোন পেয়ে মিরপুর ছুটে গিয়েছিলেন। এ কথা বহুবার লেখা হয়েছে, বলা হয়েছে। কিন্তু বলা হয়নি সেলিমের (প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরীর স্টাফ অফিসার) কথা। সেদিন সেলিমও সে রকমেরই একটি ফোন পেয়ে প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরীকে না বলেই জহির রায়হানের সঙ্গে মিরপুর ছুটে গিয়েছিলেন। তারপর দুজনের ভাগ্যের একই নিষ্ঠুর পরিণতি। দুজনই নিখোঁজ। সেলিমের মা এ সংবাদ পেয়ে প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। সেলিম বঙ্গভবনের যে ঘরটিতে থাকতেন, ইত্যবসরে সে ঘর থেকে সব কাগজপত্র, কাপড়-চোপড় উধাও। শহীদ সেলিমের মা অনেক চেষ্টা করেও কোনো রহস্য উদঘাটন করতে পারেননি। রহস্য রহস্যই থেকে গেল। জহির রায়হানও নিখোঁজ হওয়ার পর বুদ্ধিজীবী হত্যার কোনো ধরনের কাগজপত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। কাগজপত্রগুলো কোনো হদিসই পাওয়া গেল না। শহীদ সেলিমের মায়ের মতে, বঙ্গভবনের ওর ঘর থেকে যে প্রয়োজনীয় কাগজগুলো উধাও হয়েছিল, সেগুলো সম্ভবত তদন্ত কমিটির গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রই হবে। খোদ বঙ্গভবন থেকে জিনিসপত্র উধাও হয়ে যাবে, তা ভাবতেও বিশ্বাস হয় না। শহীদ সেলিম বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্তের কাজে সরাসরি জড়িত ছিলেন, এ কথা আমি আগে থেকে জানতাম না। আমি কেন আর কেউ জানে কি না, তাও জানি না। সেলিমের নিখোঁজ রহস্য যেমন গুরুত্বের সঙ্গে উদঘাটিত হয়নি, তেমনি জহির রায়হানের নিখোঁজ রহস্যও গুরুত্বের সঙ্গে উদঘাটিত করার প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করেনি। অথচ এটা একটা গভীর ষড়যন্ত্র।’ ...পান্না কায়সার আরো বলেছেন, ‘খোদ বঙ্গভবন থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র উধাও হয়ে যাবে, সেটা ভাবনারও অতীত। স্বধীন বাংলাদেশে প্রেসিডেন্টের ভবন থেকে কাগজপত্র উধাও করতে পারে কারা? রাজাকার বা পাকিস্তানপন্থিরা অবশ্যই নয়। এটা করা সম্ভব একমাত্র তাদের পক্ষে, যারা ক্ষমতার আশপাশে ছিলেন।’ কাগজপত্র, দলিলাদি উধাও করা এবং জহির রায়হান ও সেলিমকে গুম করার কাজে ক্ষমতার আশপাশের লোকরা জড়িত থাকতে পারেন, আবার ক্ষমতার মাথার ওপরের লোকরাও হতে পারেন। তারা শেখ মুজিব ও তার সরকারের চেয়েও শক্তিমান হতে পারেন। একটা ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের সন্ধানে মিরপুর গিয়ে জহির রায়হানও গুম হয়ে গেলে তার বড় বোন নাফিসা কবির এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় হইচই শুরু করেন। তখন ক্ষমতাসীন শেখ মুজিব তাকে ডেকে বলেন, ‘জহিরের নিখোঁজ নিয়ে এ রকম চিৎকার করলে তুমিও নিখোঁজ হয়ে যাবে।’ (আজকের কাগজ, ৮ ডিসেম্বর, ১৯৯৩) এরপর নাফিসা কবির নীরব হয়ে যান। (‘রাহুর কবলে বাংলাদেশ’, সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদ)

জহির রায়হানের বড় বোনকে শেখ মুজিবের এই শাসনের অর্থ হতে পারে—তিনি জানতেন কারা কিডন্যাপকারী, যাদের ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অথবা হতে পারে তারা তার সরকারের চেয়েও শক্তিশালী কেউ। এই ‘কেউ’ যে ভারত হতে পারে, সেটাই তখনকার জন্য স্বাভাবিক। তবে অনেকেই মনে করেন, বুদ্ধিজীবী হত্যা, জহির রায়হানের নিখোঁজের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকারের যে উটপাখিতুল্য ভূমিকা, তাতে মনে হয়—বুদ্ধিজীবী হত্যা ও জহির রায়হানের নিখোঁজ বা হত্যার সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকার কিংবা আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো মহল জড়িত থাকতে পারে। এর পেছনে দুটি বড় কারণ রয়েছে বলে মনে করা হয়। প্রথমত, কলকাতার প্রবাসী আওয়ামী লীগার এবং আওয়ামী সরকার জহির রায়হানকে ভালো চোখে দেখত না। স্বাধীনতাযুদ্ধকালে জহির রায়হান কলকাতায় গিয়ে খেয়ে-বসে আয়েশি জীবন কাটাননি। তিনি মুক্তিযুদ্ধের গ্রিন রুম হিস্ট্রি তৈরি করেছিলেন।’ কলকাতার বিলাসবহুল হোটেলে মেয়ে নিয়ে পড়ে থাকা শুধু নয়, রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষ, আওয়ামী আদর্শে বিশ্বাসহীন বাঙালিদের নির্মূল করার ষড়যন্ত্র, প্রভৃতির প্রামাণ্য দলিল জহির রায়হান সংগ্রহ করেন। ঢাকায় এসে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে জড়িত প্রচুর প্রভাবশালী লোকের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। ১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি ঢাকা প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে জহির রায়হান ঘোষণা দেন—বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পেছনে নীলনকশা তার কাছে আছে, যা প্রকাশ করলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই নেওয়া অনেক নেতার কুকীর্তি ফাঁসহয়ে পড়বে। ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় এই প্রেস ক্লাবে ফিল্ম শো প্রমাণ করে দেবে কার কী চরিত্র ছিল।’ (‘ভাসানী, মুজিব, জিয়া’; জীবলু রহমান, পৃষ্ঠা : ২৬)
কিন্তু জহির রায়হানের জীবনে প্রেস ক্লাবে আসা আর হয়নি। ৩০ জানুয়ারি সকালে কায়েতটুলীর বাসায় জহির রায়হানের কাছে টেলিফোন আসে, শহীদুল্লাহ কায়সার মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে আছে। তিনি মিরপুরে ছুটে যান। সেই গেলেন আর ফিরে আসেননি।
দ্বিতীয়ত, ‘শহীদুল্লাহ কায়সার, মুনির চৌধুরী, গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবেরসহ অনেক শহীদ বুদ্ধিজীবী মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করলেও আওয়ামী লীগের অনুসারী ছিলেন না। এদের দৃষ্টিতে আওয়ামী লীগ ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উঠতি পুঁজিপতি শ্রেণির প্রতিভূ, চূড়ান্ত বিচারে শ্রম-শোষক বা শ্রেণিশত্রু।... দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে হবে। আওয়ামী লীগের মতো পেটুবুর্জোয়া সংগঠন দিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম হবে না।এখানেই ছিল আওয়ামী লীগারদের ভীতি।’ (‘ভাসানী, মুজিব, জিয়া’, জিবলু রহমান, পৃষ্ঠা : ৩১-৩২) এই ভীতির ভূরি ভূরি প্রমাণ পাওয়া গেছে মুক্তিযুদ্ধকালে বাম ও আওয়ামী বৈরিতা ও প্রাণঘাতী সংঘাতের মধ্যে। এ ছাড়া শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কারো কারো সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর সুসম্পর্ক ইত্যাদি কারণেও তারা মুক্তিযোদ্ধাদের রোষানলে পড়েছিল। ঢাবি শিক্ষক অধ্যাপক মুনির চৌধুরী এবং ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনের বিষয়টি এখানে উল্লেখ করা যায়।পরলোকগত ‘ড. নীলিমা ইব্রাহিম এক নিবন্ধে বলেন, ৭১ সালের শেষদিকে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তাকে বলে গেল; যেন মুনির স্যারকে সতর্ক করে দেয়।’ এ থেকে নিশ্চিত বোঝা যায়, অধ্যাপক মুনির চৌধুরীর ওপর মুক্তিযোদ্ধারা সন্তুষ্ট ছিলেন না। কিন্তু পরে খবর যা রটল, তাতে দেশবাসী জানে অধ্যাপক মুনির চৌধুরী আলবদরদের হাতে নিহত হয়েছেন। সম্প্রতি ১০ মে (২০০৩) দৈনিক অবজারভার-এর সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে অধ্যাপক মুনির চৌধুরীর ভাই শামসের চৌধুরী ‘মাই ফ্রেন্ড ক্যাপ্টেন নাসের বারী’ নামে যে স্মৃতিকথামূলক নিবন্ধ লেখেন, তাতে সন্দেহ ঘনীভূত হতে পারে। ওই নিবন্ধের লেখক শমসের চৌধুরী বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন বাসের বারী চৌধুরীর পরিবারের কত ঘনিষ্ঠ ছিল। সেই ক্যাপ্টেন মুনীর চৌধুরীর বাসায় নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন, ডাল-ভাত খেতেন, বাংলা শিখতেন, জয় বাংলা বলতেন।এই সম্পর্ক ১৬ ডিসেম্বরের আগে পর্যন্ত ছিল। এ অবস্থায় অধ্যাপক মুনির চৌধুরীকে রাজাকার-আলবদর কীভাবে হত্যা করতে পারে বুঝে আসে না। ৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সামান্যতম পরিচয় (থাকা) ছিল আত্মরক্ষার নিশ্চিত ব্যবস্থা। পাকিস্তানি বাহিনীর পরিচিত কেউ অন্তত সেনাবাহিনীর হাতে মারা পড়ত না। বরং এসব লোক মুক্তিবাহিনীর সন্দিহান দৃষ্টিতে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে অনেকে অনেক সময়। ড. নীলিমা ইব্রাহিমের কথা যদি সত্য হয়ে থাকে, তবে অধ্যাপক মুনির চৌধুরী মুক্তিবাহিনীর কারো প্রতিহিংসার শিকার হতে পারেন।... (আরেকজন শহীদ বুদ্ধিজীবী) সিরাজুদ্দীন হোসেন ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক। প্রথমদিকে আর্মিরা তার বাড়ি তছনছ করলেও পরে রাও ফরমান আলীর নির্দেশে সিরাজুদ্দীন হোসেন প্রদত্ত তালিকা অনুযায়ী তার ক্ষতিপূরণ করা হয়। সেই তালিকায় নাকি লুণ্ঠিত মালামালের দশ গুণ দ্রব্যাদি দাবি করা হয়। সব তাকে দেওয়া হয়। পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে তার এমন দোস্তি হলো যে, তাদের দৌলতে তিনি নাকি প্রভূত সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন।’ (আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল, সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদ, পৃষ্ঠা : ৫৬৮) অতএব, সেই পাকিস্তানিরা এবং রাজাকার-আলবদররা তার মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য দায়ী হতে পারে না।

বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী এবং পরিকল্পক কারা ছিল, ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে ভারতের ‘দি নিউ এইজ’ পত্রিকায় বলা হয়, বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটির সভাপতি চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান আমাদের জানিয়েছেন, ‘আলবদরদের কার্যকলাপ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা একই সঙ্গে অপরাধীদের প্রকৃত উদ্দেশ্য বোঝার জন্য নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে যখন নিহত বাবা ও ভাইয়ের দেহের অবশেষ ঢাকার বধ্যভূমিতে খুঁজে ফিরছিলেন, তখন আমাদের ধারণা ছিল যে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর নিশ্চিত পরাজয় উপলব্ধি করে পশুরা ক্রোধান্ধ হয়ে কাপুরুষোচিত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতিহিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করেছে। কিন্তু পরে বুঝেছি ঘটনা তা ছিল না।’ ঘটনা কী ছিল জহির রায়হানের নিখোঁজ বা হত্যার পর, তা আর জানা যায়নি। জানা যায়নি জহির রায়হানের কথিত হত্যাকারী রফিককে সপরিবারে আমেরিকায় কে পাঠিয়েছিল। আজকের কাগজের ৮ ডিসেম্বর ৯৩ সংখ্যায় ‘জহির রায়হানের হত্যাকারী রফিক এখন কোথায়’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে শহিদুল ইসলাম মিন্টু লেখেন, ‘জহির রায়হানের প্রথমা স্ত্রী সুমিতা দেবী বলেছেন, আমার বিশ্বাস জহির মিরপুরে মারা যায়নি। ঘাতকরা তাকে অন্য কোথাও হত্যা করেছে। সেদিন সকাল ৮টার দিকে জহিরের একটি ফোন আসে। ফোনটা ধরেছিল সুরাইয়া নিজে। রফিক নামে কেউ একজন টেলিফোন করেছিলেন। আমরা যে রফিককে চিনতাম, তিনি ইউসিস-এ চাকরি করতেন। কেন তড়িঘড়ি করে জহির রায়হানের কথিত হত্যাকারী এই রফিককে সপরিবারে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো।’ এই রফিক কে ছিলেন, কী তার রাজনৈতিক পরিচয় ছিল; এসব প্রশ্ন সবই ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। বুদ্ধিজীবী হত্যা বিষয়ে মানুষের দৃষ্টিকে একদিকে রাজাকার, আলবদরদের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় করা হয়েছে। অন্যদিকে তেমনি বুদ্ধিজীবী হত্যার নেপথ্য কারিগরদের আড়াল করার জন্য বুদ্ধিজীবী হত্যা-সংক্রান্ত সব বিষয়কে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা হয়েছে। ড. নীলিমা ইব্রাহিমসহ কয়েকজন শেখ মুজিবরকে পীড়াপীড়ি করছিল বুদ্ধিজীবীদের জন্য আলাদা স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য। বিরক্ত হয়ে শেখ সাহেব বললেন, ‘আপা এত বেশি মিনার বানালে এসবের ভেতরে গরু বেঁধে রাখবে।’ (বাংলাবাজার, উপ-সম্পাদকীয়, ১৬ মার্চ, ১৯৯৮)
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শেখ সাহেবদের এমন এড়িয়ে চলার মানসিকতাই দেখা গেছে তদানীন্তন আওয়ামী লীগ সরকারে সর্বত্র। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা-বিষয়ের অনুসন্ধান কীভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বারা কবরস্থ হয়েছে, তার একটা উদাহরণ দিয়ে আমি আমার এই আলোচনা শেষ করছি : ‘জহির রায়হানের অন্তর্ধানের পর (বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড তদন্ত) কমিটির অন্য সদস্যরা প্রাপ্ত সব তথ্য নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে যান। বঙ্গবন্ধু সব তথ্য এনএসআইয়ের তৎকালীন প্রধান নুরুল মোমেন খান মিহিরের কাছে দিতে বলেন। সে অনুযায়ী জমা দেওয়া হয়। এ সম্পর্কে ৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির একজন সদস্য জানিয়েছেন, ড. কামাল হোসেন সর্বশেষ সেগুনবাগিচায় একটি সরকারি অফিসে তিন ট্রাংকভর্তি সেসব দলিলপত্র দেখেছেন। কিন্তু এখন আর বুদ্ধিজীবী হত্যা অনুসন্ধানে দেশের প্রথম এবং শেষ তদন্ত কমিটির সেসব দলিলের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।’ (‘আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল’ দ্বিতীয় খণ্ড, সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদ, পৃষ্ঠা : ৫৭২-৫৭৫) (এ নিউজটি ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৫ তারিখে একটি আওয়ামী লীগ সমর্থক জাতীয় দৈনিকেও ছাপা হয়।)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:২৮
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কথা: দাদার কাছে—একজন বাবার কিছু প্রশ্ন

লিখেছেন সুম১৪৩২, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৫



দাদা,
কেমন আছেন? আশা করি খুবই ভালো আছেন। দিন দিন আপনার ভাই–ব্রাদারের সংখ্যা বাড়ছে—ভালো তো থাকারই কথা।
আমি একজন খুবই সাধারণ নাগরিক। ছোটখাটো একটা চাকরি করি, আর নিজের ছেলে–মেয়ে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×