১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর বিজয়ের আনন্দে উল্লসিত ঢাকার মানুষ দলে দলে এসে প্রথমেই ভিড় জমালেন বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে । এই বাড়ি থেকেই তাদের প্রিয় নেতা পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে এক মহাকাব্যিক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিলেন। প্রিয় নেতা তখনও পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকলেও সেই বাড়িটি হয়ে উঠেছিল মুক্ত বাংলাদেশের প্রতীক। উল্লসিত জনতার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন মোহম্মদপুরের আওয়ামী লীগের উর্দুভাষী বিহারি নেতা মোহম্মদ আলাউদ্দিন। পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগ করার কারণে স্বজাতি বিহারিদের কাছ থেকে তাকে লুকিয়ে-পালিয়ে থাকতে হয়েছিল। আজ মোহাম্মদ আলাউদ্দিনের চোখে-মুখে মুক্তির আনন্দ। প্রিয় নেতার বাসায় তিনি এসেছেন সেই আনন্দ সহযোদ্ধাদের সঙ্গে উদযাপন করতে। সকল অবরুদ্ধ আবেগমুক্ত হয়ে গগণবিদারী শ্লোগানে মূর্ত হয়ে উঠছে। মোহাম্মাদ আলাউদ্দিনের কণ্ঠে সকলের মতোই উচ্চকিত শ্লোগান: জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু !!

৩২ নম্বর থেকে ফেরার পথে হঠাৎ নরক নেমে এলো তার উপর, চড়াও হলো উন্মত্ত জনতা। শত্রুজ্ঞানে প্রকাশ্যেই হত্যা করা হলো মোহম্মদ আলাউদ্দিনকে। যাদের সতীর্থ মনে করতেন আলাউদ্দিনের জীবনপ্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে তিনি অবাক বিস্ময়ে তাদের বর্ণবাদী জিঘাংসা দেখে অবর্ণনীয় কষ্ট নিয়ে চিরতরে চোখ মুদলেন। এরপর থেকেই শুরু হলো বাংলাদেশের ১১০টি শহরে পরিকল্পিতভাবে হাজার-হাজার উর্দুভাষীকে হত্যা, ধর্ষণ আর তাদের সহায়-সম্পদ লুণ্ঠনের ঘটনা। অনেক বাঙালি পরিবার কিছু ভীত-বিহ্বল আর পলায়নপর অবাঙালিকে আশ্রয় দিয়েও অসংখ্য উর্দুভাষীর নির্মম হত্যা-মৃত্যুকে রুখতে পারেনি। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে এই নির্মম আর বীভৎস হত্যাকাণ্ড বিষয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে এখনও কেউ তা স্বীকার করে লজ্জা বা দুঃখ প্রকাশ করেনি । এমনকি বামপন্থিরাও নয়। যদিও এই নিহত আর অত্যাচারিত বিহারিরা ছিল মূলত বামপন্থি দলের ট্রেড ইউনিয়নভুক্ত রেলওয়ে ও পাটকলের শ্রমিক আর নিম্নপদস্থ কর্মচারী।আজ কেউ কি স্মরণ করেন, ‘পাক ফ্যাশন টেইলার্স' নামের দোকান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা সেলাই করা হয়েছিল, সেই দোকানের অবাঙালি দরজি মোহাম্মদ হোসেন, নাসির উল্লাহ ও আবদুল খালেক মোহাম্মদীর কথা !
ঢাকা শহরে সেই সময় তিন লাখের মতো বিহারি ছিল। মূলত মিরপুর আর মোহম্মদপুরে বেশি বিহারি জনগোষ্ঠী থাকলেও সারা শহরেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিহারিরা বসবাস করতো। সংখ্যাগরিষ্ঠ বিহারি পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে যাক সেটা চায়নি। প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছে বেশির ভাগ বিহারিই । রাজাকার বাহিনীতেও বিপুলসংখ্যক বিহারিকে রিক্রুট করা হয়েছিল । নয় মাসে তারা বিপুল উৎসাহে লুট, খুন এমনকি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে গণহত্যায় অংশ নিয়েছে। এই জনগোষ্ঠীর ওপর বাঙালিদের ঘৃণা সৃষ্টির মতো উপাদান অবশ্যই ছিল ।

রমনার আত্মসমর্পণের মাঠ থেকে ফেরা উল্লসিত জনতার মিছিলগুলো থেকে শ্লোগান উঠতে থাকলো— ‘একটা দুইটা পাকিস্তানি ধরো, সকাল-বিকাল নাতা করো'। এই সম্মিলিত ঘৃণা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বা বিহারি রাজাকারদের কিছু করতে না পারলেও নিরস্ত্র বিহারিদের ওপর সকল জিঘাংসা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সেই রাতেই বিহারিদের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হতে শুরু হলো সব জায়গায়। খুন, লুট ও বিহারি নারীদের ধর্ষণে মেতে উঠলো উন্মত্ত জনতা।
মিরপুর এক ও দুই নম্বরে বিহারি বসতি এলাকায় বিপুল অস্ত্রে সজ্জিত মুক্তিযোদ্ধারা ঢুকে পড়লো। অস্ত্রধারী বিহারি রাজাকারেরা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও কুলিয়ে উঠতে পারেনি। মুক্তিবাহিনী ৩০টি বাড়ি ডিনামাইটে উড়িয়ে দেয় আর যত্রতত্র গুলি ছুঁড়তে থাকে। মাইকে ঘোষণা করা হয়: বিহারিরা বাঁচতে চাইলে ঈদগাহে জড়ো হও। সবাই ঈদগাহে জড়ো হয়। তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি ছুঁড়ে অসংখ্য নিরস্ত্র বিহারিকে হত্যা করা হয়। ঈদগাহ্ মাঠের সবুজ ঘাসের রঙ পরিবর্তিত হয়ে যায় উজ্জ্বল লাল রঙে।
একটি বীরোচিত রাষ্ট্র-বিপ্লবে অংশ নেয়া গণমানুষের বাহিনীর এমন নির্দয়, নির্মম ও অসৈনিকোচিত গণহত্যায় বাঙালির বিজয়ের পালকে যে কালিমা লেপন হয়ে গেল তার দায় কেউ কখনো স্বীকার করেনি। বাংলাদেশের সকল ইতিহাস থেকে এই গণহত্যার ঘটনা মুছে দেয়া হয়েছে কিংবা মুছে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:১৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



