অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে এত বিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাবান মানুষ থাকা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে তাদের সিদ্ধান্তগুলো অবিশ্বাস্যভাবে অপরিণত বলে মনে হয়। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে একচেটিয়াভাবে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে—এটা যেমন সত্য, তেমনই এটাও অস্বীকার করা যায় না যে স্বাধীনতা আন্দোলনে শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল অপরিহার্য। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বেশ কিছু জাতীয় দিবস, যেগুলো মূলত শেখ হাসিনার পরিবারের বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে সম্পর্কিত, সেগুলো বাদ দিলেও ৭ই মার্চকে বাদ দেয়া হবে ভুল সিদ্ধান্ত।
৭ই মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রশাসনিক ব্যর্থতা কিংবা তার খেয়ালখুশি মতো করে রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশল নিয়ে যতই সমালোচনা থাকুক না কেন, দেশের জন্য তার অবদানকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার সময়ে তিনি বহু ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেটা সত্য। বাকশাল প্রতিষ্ঠা, রক্ষী বাহিনীর অত্যাচার, আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং দুর্ভিক্ষের জন্য তিনি দায়ী ছিলেন। তার পারিবারিক কায়দায় নির্দেশনা দেওয়ার স্টাইল—'তুমি এটা করো, তুমি ওটা দেখো'—একটি দেশের প্রশাসনিক কাঠামোর জন্য মোটেও উপযুক্ত ছিল না। এর পরিণামে দেশ একাধিক সংকটে পড়েছিল, যা আজও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক জটিলতাগুলো অনেকাংশে সেই সময়ের ভুল সিদ্ধান্তের ফল।
এখন, উপদেষ্টারা যখন শেখ মুজিবকে এককভাবে জাতির পিতা হিসেবে মানতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন, তখন তারা কোনো বিকল্প সমাধানের প্রস্তাবও দিচ্ছেন না। পৃথিবীর অনেক দেশে যেমন একক ‘জাতির পিতা’ নেই, বরং একাধিক ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ আছে। আমেরিকার উদাহরণই ধরা যাক। আমাদের দেশেও একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা যেতে পারে। শেখ মুজিবের পাশাপাশি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, এম. এ. জি. ওসমানী, জিয়াউর রহমান— এদেরও আমাদের জাতির প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশ বলতে শুধু ১৯৭১ সাল নয়; আমাদের ইতিহাস ১৯৪৭ থেকে শুরু, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত। ১৯৪৭ না হলে আমাদের দেশ আলাদা হতো না, আর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছাড়া আমাদের নিজস্ব ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠা করা যেত না, যার ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা অর্জন ঘটে।এটাও মাথায় রাখা জরুরী যে ৭৫ পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমান শক্তভাবে দেশের হাল না ধরলে আমাদের স্বাধীনতা রক্ষা করাটাও কঠিন হয়ে যেতো।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও বারবার বলেছেন যে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা কেবল একজন ব্যক্তির সাথে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়, বরং বহু নেতার সম্মিলিত অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। যদি বর্তমান সরকার শেখ মুজিবকে জাতির পিতা হিসেবে মেনে না নেয়, তবে তাদের অবশ্যই স্পষ্ট করতে হবে কাদেরকে তারা এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান এই বিতর্কের এখন সমাধান হওয়ার সময় এসেছে। নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করার প্রয়োজন নেই। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গঠিত এই সরকার চাইলে রাজনৈতিক প্রভাব উপেক্ষা করে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে ইতিহাস পুনর্লিখনের সুযোগ পেতে পারে। কিন্তু শুরুতেই বিতর্কের জন্ম দিয়ে সেই সুযোগ নষ্ট করা উচিত হবে না।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১১:৩২