মাহবুব মিঠু।।
কিছুদিন বিরতী যাবার পরে আবারো বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের দ্বারা রক্তাক্ত হয়েছে। সর্বশেষ বলি হোল, জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাস তার এক ছাত্রকে হারিয়ে। প্রতিদিনই সেখানে ছাত্র শিক্ষকেরা জুবায়ের হত্যাকান্ডের শাস্তি দাবী করে মিছিল সমাবেশ করে চলেছে।
হঠাত করেই ছাত্র রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠেনি। বরং ছাত্র রাজনীতি তার গতি এবং প্রকৃতি হারিয়েছে অনেক আগেই। ছাত্র রাজনীতি নিয়ে আলোচনা অনেকটা ফোলা বেলুনে আলপিনের খোচা দেবার মতো বিপদজনক। প্রচন্ড শব্দে চারিদিক থেকে গেল গেল রব উঠতে থাকবে। শুরু হয়ে যাবে ঐতিহ্য খোয়ানোর চিতকার। একটা কথা ভুলে যাই যে, কোন কোন ঐতিহ্য সময়ের বিবর্তনে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানের প্রয়োজনের সাথে তাল মিলিয়ে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করে। সেটা করতে না পারলে কিংবা আদৌ তার কোন প্রয়োজন না থাকলে তা পুরানো ঐতিহ্য হয়ে ইতিহাসের খাতায় নাম লিখিয়ে অতীতের গৌরব হয়ে বেচে থাকে। স্বাধীনতার পরে বিশেষ করে নব্বইয়ের আন্দোলনের পরে ছাত্র রাজনীতির গতি প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে, এক সময়ের গৌরবগাথা ছাত্র রাজনীতিকে সেই ঐতিহ্যের আলমারীতে রাখার সময় হয়েছে কিনা অথবা বর্তমানের চাহিদার সাথে তাল রেখে কিভাবে ছাত্র রাজনীতির প্রকৃতিকে বদলানো যায় সে ব্যাপারে স্বিদ্ধান্ত নেবার সময় এসেছে।
আমার এক বছরের অনুজ দীপু নামের ছেলেটির কথা আজো ভুলতে পারিনা। অসম্ভব রকম সুদর্শন ছিল। ক্যাম্পাসে তার প্রেম ছিল, ছিল ভবিশ্যত সুন্দর জীবন যাপনের একটা স্বপ্নও। কিন্তু ছাত্র রাজনীতি তাকে সব ফেলে পৃথিবীর মায়া ছাড়তে বাধ্য করে। সেই একই ক্যাম্পাসে সর্বশেষ বলি হোল জুবায়ের। এ রকম কতো শত দিপু, জুবায়ের ছাত্র রাজনীতির বলি হয়েছে এবং ভবিশ্যতেও হবে তার কোন ইয়ত্তা নেই।
আমি ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে নই। আমি বিপক্ষে বর্তমান যে ধারায়, যে লেজুড়বৃত্তিক ধারার ছাত্র রাজনীতি হচ্ছে সেটার বিপক্ষে। দেশের যুব সমাজ দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাদেরকে অবশ্যই দেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে হবে। কিন্তু সেটা লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে নয়। ছাত্ররা স্বতন্ত্র ধারায় নিজ দাবী আদায়ে আন্দোলন করবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কথায় কথায় জাতীয় রাজনীতি নিয়ে নেতাদের ইশারায় ক্যাম্পাস রক্তাক্ত করা ছাত্র রাজনীতি নয়। যারা বর্তমান ধারায় দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতির পক্ষে কথা বলছেন, তারা বলবেন কি, আমাদের জাতীয় বা আঞ্চলিক পর্যায়ের কয়জন নেতা তার সন্তানকে ছাত্র অবস্থায় রাজনীতিতে উতসাহিত করেছেন। এক সময় হাসিনা বলেছিলেন, “একটার বদলে ১০টা লাশ ফেলতে হবে”। এই দশটা লাশের মধ্যে তার বা তাদের (নেতাদের) কোন ছেলে মেয়ের লাশ কি কখনো পড়েছে? ক্ষমতায় যাবার জন্য কিংবা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অস্থিতিশীল করে, নিজেদের সন্তানদের বিদেশে লেখাপড়ার জন্য পাঠায়। চর দখলের মতো দেশ দখলে তরুণ সমাজকে পাঠিয়ে গরীব মধ্যবিত্তের সন্তানদের রক্তে ক্যাম্পাস লাল করে। এদেরই সন্তানরা বিদেশে থেকে লেখাপড়া শেষ করে এসে উত্তারাধিকার সূত্রে নেতা হয়। এই সব নেতারা ছাত্র রাজনীতির পক্ষে কথাতো বলবেই। মৃত লাশটাতো তার সন্তান নয়।
দেশ পরিচালনায় রাজনৈতিক জ্ঞান লাভের জন্য নাকি ছাত্র অবস্থাতেই মানুষকে রাজনীতির সাথে জড়িত থাকতে হয়। ওবামা কিংবা অষ্ট্রেলিয়ার জুলিয়া গিলার্ড সে রকম ছাত্র রাজনীতি করেছিলেন কিনা জানা নেই। উন্নত বিশ্বের কোথাও এমনটির নজীর নাই। হ্যা, সেখানে শিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত সবাই রাজনীতি সচেতন থাকেন। কিন্তু রাজনীতিবিদ নন। অথচ তারাই আজ উন্নত।
দেশ চালাতে হলে মন্ত্রী দরকার হয়। কেউ হবেন স্বাস্থ্য মন্ত্রী, কেউ হবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেউ হবেন আইন মন্ত্রী এবং অন্যরা অন্যান্য প্রয়োজনীয় দপ্ততর পাবেন। এখানে প্রত্যেকটি দপ্তর চালাতে কিন্তু সেই দপ্তরের বিশেষ জ্ঞান লাগে। সেখানে রাজনৈতিক জ্ঞানের জন্য কাউকে ছাত্র বেলা থেকে রাজনীতির চোঙা ফুকাতে হয় না। আমাদের মতো পরিবারতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় (সেটা হতে পারে আঞ্চলিক কিংবা জাতীয় পর্যায়ে) যে পরিবারের সন্তানেরা রাজনীতিতে আসবেন তারা কেউ দেশে বসে জয় বাঙলা কিংবা জিন্দাবাদ দেয়নি। কেউবা দেশে কেউবা বিদেশে বসে লেখাপড়া করে নিজেদের আখের গুছিয়েছে। এরপর সময় এবং সুযোগ মতো এরাই ক্ষমতায় জাকিয়ে বসেছে এবং ভবিশ্যতেও বসবেন। এদের বেলায় কিন্তু আমরা আমজনতা বলি না যে, কৈ তুমি ছাত্র অবস্থায় রাজনীতি করনি কেন? তুমি আমাদের নেতা হবার যোগ্য নও। সেই সব আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ে জেকে বসা সামন্ততান্ত্রিক পরিবারের লোকেরা এবং তার চামুন্ডিরা যাদেরকে ছাত্র অবস্থায় রাজনীতি করতে বলেন সেখান থেকে কোটিতে ক’জন নেতা হতে পেরেছেন? দেশের নেতা হওয়া মানে কিন্তু ভাল বক্তৃতা দেয়া কিংবা বিরোধী দলকে গালি দেবার ক্ষমতা থাকা নয়। দেশের নেতা মানে তাকে জ্ঞান গরীমায় যোগ্য হতে হবে। লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি যেখানে পেশীশক্তিই প্রধান যোগ্যতা, সেই রাজনীতির ভিতর থেকে আসা নেতারা দেশকে কোন পথে নিয়ে যাবে আমাদের মতো দেশের হাল হকিকত দেখলেই সেটা বুঝা যায়।
ছাত্র রাজনীতি কিসের জন্য? সমাজ পরিবর্তনের জন্য? তাহলে তো ছাত্রদের প্রধান রাজনীতি হওয়া উচিত “ছাত্রনং অধ্যয়ন তপঃ”। দেশের উপকার করতে হলে তাকে যোগ্য হতে হবে। সমাজের পরিবর্তন করতে হলে তাকে তৈরী হতে হবে। সেই যোগ্যতার মাপকাঠি কি? নিশ্চয়ই হানাহানি বা মারামারি নয়। মেধার বিকাশ। সেই মেধার বিকাশ ঘটাতে চাই নিয়মিত ক্লাশ করে, সঠিক সময়ে পড়ালেখা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে ঝাপিয়ে পড়া।
তাছাড়া ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্ব কি ছাত্রদের হাতে আছে? আমি সেই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছি ১৯৯৬ সালে। এখনো কোন কোন ছাত্র নেতাকে আমারও ভাই ডাকতে হয়। কারণ তারা আমার চেয়েও বয়সে অনেক বড়। এই সব আদুভাই মার্কা ছাত্র নেতারা ছাত্রদের মেধার বিকাশে কতোটুকু ভূমিকা রাখবে? যে সব ছাত্র নেতার ঘরে হয়তো বিবাহযোগ্য কন্যা সন্তানও রয়েছে এবং যারা জীবন চালাতে চাদাবাজীসহ টেন্ডারবাজরীর মতো বিভিন্ন বৈধ অবৈধ ব্যবসার সংগে জড়িত তাদের সংগে শিক্ষার কি সম্পর্ক থাকতে পারে?
সেই ৫২, ৬৯ এবং একাত্তরে ছাত্র রাজনীতি সমাজ পরিবর্তনে প্রয়োজনীয় ছিল। তখনকার সামাজিক পরিস্থিতি ছিল আলাদা। কিন্তু এখন? সমাজ পরিবর্তনের নামে ছাত্ররা নেতাদের ক্ষমতায় যাবার হাতিয়ার হয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করে নেতাদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটাচ্ছে। সেই সময়গুলোতে এমনকি নব্বইতে স্বৈরচারী হঠাতে ছাত্রদের অংশগ্রহণ প্রয়োজন ছিল। ঔপনেবিশিক শাসক কিংবা স্বৈরাচার হঠাতে ছাত্ররাজনীতির দরকার হয়েছিল। কিন্তু এখনতো আমরা স্বাধীন এবং স্বৈরাচারমুক্ত। তবে কেনে এখনো ছাত্রদের জাতীয় রাজনীতির সংগে সম্পৃক্ত করতে হবে? তারমানে আমরা প্রকারান্তরে স্বিকার করে নিচ্ছি যে, স্বিকৃত ঔপনিবেশিক কিংবা স্বৈরাচার হটে গেলেও ঔপনিবেশিক শাসনের স্থানে পরিবারতন্ত্র টিকিযে রাখতে এখনো ছাত্রদের ব্যবহার করার দরকার আছে?
আমি পৃথিবীর বহু দেশ না ঘুরলেও অনেক দেশ ঘুরেছি এবং মিশেছি, বন্ধু হয়েছি প্রায় সব দেশের মানুষের সাথে। বাঙলাদেশ এবং আশেপাশের দু একটা দেশ বাদে পৃথিবীর কোন দেশে আমাদের মতো ছাত্র রাজনীতির অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যাবে না। এমনকি পাশের দেশ ভারতেও আমাদের মতো লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি থাকলেও সেটা লাগামহীন নয়। দেয়ালে দেয়ালে চিকা কিংবা ক্লাশ রেখে আমরা যে রকম কথায় কথায় মিছিলে শ্লোগানে আগুন জ্বালাই, সে রকমটা খুব কমই দেখা যায়।
যারা ছাত্র রাজনীতির এই লেজুড়বৃত্তিক ধারাকে বিভিন্ন যুক্তিতে সমর্থন যুগিয়ে যাচ্ছে তারা নিজেরা কি তার সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করতে পাঠাবেন? কিংবা আপনারা ছাত্র রাজনীতি প্রেমিক যারা তাদের কতোজন বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক কলহে মারা পড়া ছাত্রদের পরিবারের খবর রেখেছেন? সেই দিপুর পরিবারের খবর কি কেউ রাখে? হ্যা রাখে। শুধু তার পরিবারের সদস্যরা। যারা কখনো চায়নি দিপু রাজনীতি করুক। কিন্তু যারা চেয়েছিল সেই সময়ে আমাদের রাজনীতিতে জড়াতে সেই সব নেতারা কিন্তু দিপুর নামটিও তখন জানতো কিনা কে জানে! কেননা দিপুর মতো তরতাজা ছেলেরা তো তাদের কাছে এক একটা ক্ষমতায় যাবার ইনস্ট্রুমেন্ট। একটা নষ্ট হয়েছে তাতে কি! বদলিয়ে ফেলো। এরপরে ছাত্র রাজনীতির নামে কতোশত দিপু নামের ক্ষমতায় যাবার ইনস্ট্রুমেন্ট যে জীবন হারানোর কারণে বদল হয়েছে তার হিসেব কয়জন রাখে!
Click This Link
ছাত্র রাজনীতির এই কলুষিত প্রভাব সারা জীবনই থেকে যায়। কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পরেও সেই হিংসা, প্রতিহিংসা বিদায় নেয় না। ছাত্র রাজনীতির প্রভাবে তাই পেশাজীবীদের মধ্যে ”সাদা দল”, ”নীল দল” কিংবা নানা নামে বিরাজ করে সেখানেও পেশাকে কলুষিত করছে। আমি নিজে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত থাকলেও আজ এই পরিণত বয়সে বলবো, আমি ভুল করলেও আমার সন্তানকে ও পথ থেকে ফেরাবো। আমার সন্তান দেশের সঠিক নেতৃত্ব দেবার যোগ্যতা রাখুক পিতা হিসেবে অবশ্যই চাইবো। এবং সেটা অবশ্যই ছাত্র রাজনীতি করে। যে রাজনীতির মূল মন্ত্র হবে “ছাত্রনং অধ্যয়ন তপঃ”।
লেখাটা শেষ করবো আবারো একটা কৌতুক দিয়ে। কৌতুকটি কে বানিয়েছে আমার জানা নেই। এটা পেয়েছি আমার একজন প্রিয় মানুষ ডেস্টিষ্ট মনির ভাইয়ের ফেইসবুকের পোষ্ট থেকে।
দেবদূত কহিলেন, 'শুনেছ নাকি, সাতক্ষীরায় ধর্ষন চেষ্টার অভিযোগে ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে দল থেকে বহিস্কার করা হইয়াছে।'
আমি উদাস হইয়া বলিলাম, ' ধর্ষণ চেষ্টার জন্য বহিস্কার হইয়াছে মনে হয় না। বরং বেকুবের মতো ধরা খাওয়ার জন্য সম্ভবত বহিস্কার হইয়াছে । এই নেতারা আগেও ধর্ষনের অভিযোগে অভিযুক্ত। কিন্তু তখন বহিস্কার করে নাই। এখন হাতেনাতে ধরা খাওয়ায় বহিস্কার হইল।'
দেবদূত কহিলেন, 'হইতে পারে। ধর্ষন চেষ্টার জন্য বহিস্কার করিলে তো ছাত্রলীগের অধিকাংশরেই বহিস্কার করিতে হয়। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে এরা গণতন্ত্র, সহনশীলতা, সহমর্মিতা আর ছাত্র রাজনীতির চেতনাকে প্রতিদিন ধর্ষন করিয়া চলিয়াছে।'
আমি বলিলাম, "সুশীল হইতে চান বলিয়া হয়তো কিছু কিছু পত্রিকা এবং পুলিশ প্রশাসন অসভ্য ধর্ষন শব্দটা পরিহার করিয়া ‘ধর্ষনের চেষ্টা’ বলিয়া দলের ইজ্জত কিছুটা রক্ষার চেষ্টা করিয়াছেন। সরকারের পুলিশও 'চেষ্টা'র অভিযোগে মামলা নিয়েছে মনে হচ্ছে।
কিন্তু খবর হচ্ছে, পুলিশ নির্যাতিতা মেয়েটিকে দেড় ঘন্টা পরে উদ্ধার করিয়াছে। দেড় ঘন্টা ধরিয়া শুধু 'চেষ্টা' করিয়া যাইবে, ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদক পদে এত দুর্বল লোককে নিশ্চয়ই নিয়োগ করা হয় নাই।"বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে কৌতুকের
বিষোদগারটা হয়তো ছাত্রলীগের উপর দিয়েই গিয়েছে। কিন্তু কমবেশী সব ছাত্র রাজনীতিরই একই অবস্থা। শুধু পার্থক্য কার দল কখন ক্ষমতায় গেল, এই যা!