অনেক দিন থেকেই ভাবছিলাম ব্লগিং শুরু করব। কিন্তু খোমাখাতায় আমি যে পরিমাণ সময় ব্যয় করি, তাতে আমার ভয় হয় ব্লগিং আর খোমাখাতায় একসাথে নাম থাকলে পরে জীবন ধারণ এর জন্য যেসব কাজ না করলেই নয় সেগুলার জন্য সময় পাব কিনা???
যাই হোক....শেষ পর্যন্ত ব্লগিং এর খাতায় ও নাম লিখাইয়া ফেল্লাম।
এবার মূল প্রসংগ........
নাম নিয়া হয়ত অনেকেই বিভিন্ন বিড়ম্বনার শিকার হইছেন । এজন্য আমার বিশ্বাস যে আমি কিছু মানুষ এর সহমর্মিতা পেতে পারি..আবার অনেকেই হয়ত শুধু বিদ্রুপের হাসি হাসবেন। ব্যাপার না.....
জন্মের পর থেকেই শুরু আমার নাম এর বিড়ম্বনা । আমাদের পরিবার এ আমার বড় এক ভাই আর এক বোন এর পর আমার বাবা মা চাইছিলেন আরেকটা ছেলে হবে।
(কারণ, গ্রামে এখন কি অবস্থা সেটা জানি না।কিন্তু সেই সময় যত ছেলে তত জোর......অন্যদের কথা বাদ ই দিলাম, আমার দাদারাই গ্রামে মাতব্বরি ফলানোর জন্য একাধিক বিয়া করেছিলেন আর তাদের ছেলে মেয়ের সংখ্যা ( ছেলে সংখ্যা> মেয়ের সংখ্যা) অনেক বেশী ছিল। যদিও আমার বাবা চাচা দের একাধিক বিয়ার কোন নজির আমার জানা নাই।)
কিন্তু আমার বাবা মার সেই আরেকটি ছেলে পাবার স্বপ্ন আর সফল হচ্ছিল না। এক এক করে আমার বড় ভাই এর পর তিন বোন হল....তারপর ও উনারা নিরাশ হলেন না। অনেক মানত করলেন, অনেক দোয়া দুরুদ মিলাদ হল যাতে একটা আরেকটা ছেলে হয়। এবার পরম করুণাময় আল্লাহ তাদের কে হতাশ করলেন না। বাবা মার অনেক আকাংক্ষিত একজন ছেলের জন্ম হল। আমার বাবা মা এতই খুশি হয়েছিলেন যে....নতুন সন্তান এর হাত এ টাকা না দিয়া কেও বাচ্চা দেখতে পারে নাই। এমনকি আমার বড় ভাই বোনদেরকেও টাকা দিয়া আমার মুখ দর্শন করতে হয়েছিল। আর এই আদর আর আহ্লাদ এর বশে আমার একটা অদ্ভুত বাজে নাম দেয়া হল!!!!! আমার যদি সেটা প্রতিবাদ করার মত বয়স হত, তাহলে এই নাম কোনভাবেই আমি মানতে পারতাম না। যাই হোক, কপাল খারাপ থাকলে যা হয়....শেষ পর্যন্ত সেই ডাক নামেই পরিচিত হলাম। এর পর আমার ভাগ্য ভাল যে আমার আব্বু চাকরির পদন্নতির সুবাদে গ্রাম থেকে শহরে বদলি হয়ে গেলেন। আর আমি পেলাম আমার বাজে নাম ধামাচাপা দেবার সুযোগ। এর পর শহরে এসে আমি আমার ডাকনাম মাহবুবুর রহমান এর সাথে মিল রেখে মাহবুব করে ফেললাম। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে বেঁচে গেলাম....কিন্তু এই নাম ও যে পরবর্তিতে বুমেরাং হতে পারে সেটা আন্দাজ করতে পারলেও আমি ভিন্ন কোন নামই হয়ত নিজেকে পরিচয় করাইতাম..
(আমি আমার সেই নাম এখানে প্রকাশ করতে চাই না.. যারা নাম টা আন্দাজ করতে চান....তাদের জন্য Hints: আমার বাবা মা আমাকে আল্লার কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছেন, যেমন করে ফকির ভিক্ষা চেয়ে নেয়......)
এরপর মাধ্যমিকে সন্তোষজনক ফলাফল করে ঢাকার নটর ডেম কলেজ এ ভর্তি হলাম।মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিক এ নাম সংক্রান্ত তেমন কোন বিড়ম্বনার শিকার হতে হল না। কিন্তু বুয়েট এ এসে আমার ক্লাস এ মাহবুব ডাক নামের কাউকে পেলাম না বটে......মাহবুবুর রহমান নামের আমার আরেকজন সহপাঠি পেলাম যার ডাকনাম শাওন।
নাম নিয়া বড় ধরনের সমস্যা হল যখন আমি বুয়েট পাস করে একটেল এ চাকরি শুরু করলাম। কারন আমি যে ইউনিট এ কাজ করতাম সেই ইউনিট এ ১৫ জন এর মাঝে ৫ জনই হল মাহবুব নামধারী!!!!!
আমাদের ম্যানেজার মাহবুব নাম এ কাউকে ডাকলে আমরা একসাথে হাজির হইতাম প্রথম দিকে। পরে আমরা মিটিং এ এই সমস্যার সমাধান নিয়া আলোচনা করলাম। একজন এর নাম মাহবুব হাসান সে হাসান নাম এ পরিচিত হল, আরেকজন মাহবুব-এ-খোদা...যেহেতু খোদা নামে ডাকা টা ধর্মীয় দৃষ্টিতে অস্বস্তিকর ..তাই তার আনঅফিসিয়াল নাম "রুমেল" নামটাই ব্যবহৃত হল। আরেকজন মাহবুবুর রহমান মান্না...সুতরাং সে মান্না নাম পেল। কারার ফয়সাল মাহবুব নামের আরেকজন পরিচিতি পেল ফয়সাল নামে। আর আমার যেহেতু কোন আনঅফিসিয়াল নাম তাদের জানা নাই (কারন, আমার সেই বাজে নাম টা তো কোনভাবেই অফিস এ বলি নাই..
তাই আমার মো: মাহবুবুর রহমান কেটে শুধু "রহমান" করা হল। সুতরাং অফিস এ "রহমান" আর অফিস এর বাইরে "মাহবুব".....এই দ্বৈত নাম চলতে থাকল।
এখানে কথা প্রসংগে বলে রাখা দরকার...গুলশান-১ এ একটেল এর অফিস উদয় টাউয়ার আর সিলভার টাউয়ার এ ছিল। আমরা টেকনিক্যাল ডিভিশন এর আন্ডার এ হলেও সিলভার টাউয়ার এর ১৫ তলা তে বসতাম।
তো একদিন এক ভদ্রলোক এসে আমাদের দাড়ওয়ান কে বলল যে সে মাহবুব নামের একজন কে খুজছেন। অফিস এ আমার রুমটা ছিল অফিস এ ঢোকার শুরুতেই। সুতরাং দাড়ওয়ান এসে আমাকে বলল, "স্যার, আপনাকে এক ভদ্রলোক খোঁজতেছেন"।
আমি কাজ ফেলে বাইরে এসে দেখলাম সেই লোকটা আমার পরিচিত কেউ না। উনাকে বললাম, "আপনি কাকে চান?"
সেই লোক, "আমি মাহবুব সাহেবের কাছে এসেছি"
আমি বললাম, "বলুন কি বলবেন। আমার নাম মাহবুব"
সেই লোক, "আসলে আমি আপনার কাছে আসিনি। আপনাদের এখানে কি মাহবুব নামে আর কেউ আছেন?"
আমি বললাম, "মাহবুব নামে আর কেউ আছেন মানে?...এখানে এই নামের মানুষ এর কোন অভাব নাই। দাড়ান, আমি আরেকজন কে ডেকে দেই।"
এরপর একে একে মাহবুব হাসান, মাহবুব-এ-খোদা সহ সব মাহবুব কেই উনার সামনে হাজির করলাম। কিন্তু আফসোসের ব্যাপার হল....সেই লোক আমাদের কোন মাহবুব কেই চিনতে পারল না এবং সে খুবই বিচলিত হয়ে পড়ল।কারন সে আসলে ঐ মাহবুব এর কাচে আসছে পাওনা টাকা নিতে। উনার খারাপ অবস্থা দেখে আমি বললাম, "আপনি যে মাহবুব এর কাছে এসেছেন সে একটেল এ জব করে ভাল কথা.......সে কি সিলভার টাউয়ার এ নাকি উদয় টাউয়ার এ?"
উনি বললেন "উদয় টাউয়ার এ"
তখন আমার কাছে বিষয় টা পরিষ্কার হয়ে গেল। উনি ভুল করে উদয় এর বদলে সিলভার টাউয়ার এ চলে এসেছেন এবং উদয় টাউয়ার এর ১৫ তলা তেও মাহবুব নামের একটেল এমপ্লয়ি আছেন।
দুই বছর চাকরি করার পর কেমন জানি একা একা মনে হতে লাগল। কারন, ততদিনে আমার ৭০% এরও বেশি বুয়েট ক্লাসমেটরা আমেরিকার মত নামি দামি দেশের ইউনিভার্সিটি তে ফান্ডিং (স্কলারশিপ...যাই বলি) নিয়া পড়তে গেছে। তাদের সাথে যোগাযোগ বলতে ফেসবুক, ইয়াহু, গুগুল.....বুকের মধ্যে কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগা শুরু হল। দেশে থেকেও বন্ধুদের দেখা পাই না তাহলে দেশে থেকে কি হবে? তার থেকে বাইরে থেকে দুই একটা ডিগ্রি নিতে পারলে খারাপ হয় না। অবশ্য এই ব্যাপারে আমার পরিবার থেকেও একটা প্রচ্ছন্ন চাপ ছিল। পরে সিদ্ধান্ত নিলাম পরিবার এর মুখ আমাকেই উজ্জ্বল করতে হবে। সুতরাং শুরু করলাম জি আর ই, টোফেল এর হ্যাপা। এরপর বুয়েট দৌড়াদৌড়ি বিভিন্ন কাগজ সংগ্রহের জন্য।
বুয়েট এর কাগজ সত্যায়িত করার জন্য আলাদা শাখা আছে।ওখানে কয়েকদিন আগে কাগজ জমা দিলে সব সত্যায়িত করে রাখে।সবাই আগে জমা দিয়া যায় আর ওখানকার মামারা সব সিল গালা করে রাখে। হাজার হাজার কপি এক সাথে থাকে। আমিও যথারীতি আমার নাম (মো মাহবুবুর রহমান) আর ব্যাচ মিলিয়ে আমার সত্যায়িত কাগজের বান্ডিল নিয়া বাসায় আসলাম। এরপর একটা বান্ডিল এর সিল গালা খুলে দেখি যে আমার সি জি পি এ বেড়ে গেছে । ভাবলাম পরীক্ষা দিয়া সি জি পি এ বাড়াইতে পারি নাই আর কাগজ সত্যায়িত করে বাড়িয়ে ফেললাম। খারাপ না। কিন্তু ব্যাপার বুঝতে খুব বেশি সময় লাগল না।বুঝলাম সেই মো মাহবুবুর রহমান (যার ডাকনাম শাওন) তার কপি আমাকে ধরাইয়া দিছে।পরে আমি আবার গিয়া পরিবর্তন করছি। তবে এটা বুঝছি সি জি পি এ বেশি হলে বেশ ভালই লাগে। চিন্তা করলাম, আমেরিকা তে যদি ফান্ডিং সহ সুযোগ পাই তাইলে গবেষণার পাশাপাশি সি জি পি এর দিকেও নজর দিতে হবে। আমেরিকা তে এসে যেটা বুঝলাম পি এইচ ডি তে সি জি পি এর থেকে গবেষণামূলক পেপার বের করাটাই আসল। আর এটাও বুঝছি সি জি পি এ ভাল করার জন্য খুব বেশি পড়াশুনার ও দরকার হয় না।
যাই হোক, যখন আমেরিকা আসার উদ্দেশ্যে যখন একটেল এ রিজাইন দিলাম , ভাবলাম দূরদেশে নিশ্চই নাম নিয়া অন্তত ঝামেলা হবে না।
কিন্তু বিধি বাম। যখন ভিসার জন্য অনেকের পরামর্শ নিলাম তখন জানতে পারলাম যাদের নামের শুরুতে মোহাম্মদ (মো
কিন্তু এখানে এসেই দেখলাম "আ ক ম মাহবুবুর রহমান" নামের এক বাংলাদেশি ছাত্র আগে থেকেই এখানে আছে যার ডাকনাম "মাহবুব" ।
দূর্ভাগ্য বশত: আমরা এক সেমিস্টার এ একি কোর্স নিলাম । সেই কোর্স এর টিচিং এসিস্ট্যান্ট আমাকে মাহবুব নামে চিনত কিন্তু ঐ মাহবুব কে চিনত না। আমাদের প্রথম যে এসাইনম্যান্ট দেয়া হল সেটা আমি হাতে লিখে জমা দিলাম আর ঐ মাহবুব কম্পিউটার প্রিন্ট কপি দিল। এরপর সবার এসাইনম্যান্ট grading করে ফেরত দেয়া হল, আমার টা মিসিং।
আমি professor কে গিয়া ধরলাম...সে উল্টা আমাকে সন্দেহ করতেছে যে আমি আসলেই জমা দিছি কিনা। কিন্তু আমার boldness দেখে বলল যে তুমি তাইলে এই কোর্স এর টিচিং এসিস্ট্যান্ট এর সাথে যোগাযোগ কর। পরে গিয়া জানলাম যে সে মনে করছে আমি দুই কপি জমা দিছি। একটা rough copy (যেটা আমি হাত এ লিখে জমা দিছি) মনে করে ফেলে দিছে.।...আর প্রিন্টেড কপি টা মেইন কপি মনে করে মার্কিং করছে যেটা আসলে আরেক মাহবুব এর। পরে তাকে বুঝাইলাম যে হাত এ লেখাটাই আমার মেইন কপি আর প্রিন্টেড কপি টা আরেক মাহবুব এর। পরে সে অনেক খুজে ট্র্যাশ থেকে বের করে মার্কস দিছে। এরপর professor কে বলার পর আমাদের দুইজন এর নাম নিয়া গভীর চিন্তায় পরে গেল।এখানকার নিয়ম হল লাস্ট নেম টা হল ফ্যামিলি নেম। সেক্ষেত্রে আমাদের ফ্যামিলি ভিন্ন হওয়ার পরেও কিভাবে আমাদের ফ্যামিলি নাম একই হল। কিছুতেই সে হিসাব মিলাতে পারল না। ক্লাশ এর সবার নাম ই তার মুখস্ত হইছে শুধু আমাদের দুইজন এর টা পারে নাই।
আমার English name হল Md. Mahbubur Rahman...আমেরিকা তে Md মানে হল Doctorate in Medicine মানে মেডিসিন এ পি এইচ ডি। সুতরাং এদের মতে Md কারো নাম হতে পারে না। এটা নামের টাইটেল হতে পারে। এরা মনে করে যে আমি মেডিসিন এ পি এইচ ডি করে এখন কম্পিউটার সাইন্স এ পি এইচ ডি করছি।
কাকতালীয়ভাবে আমার রিসার্চ মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত।এতে তারা আর দিধান্বিত হওয়াটা স্বাভাবিক। Credit Card এর কম্পানি গুলো অনেক চিঠি পাঠায় বিভিন্ন ঠিকানায়, যাতে তারা নতুন কাস্টমার ধরতে পারে। তারা এক চিঠিতে আমাকে address করল Dear Dr. Rahman হিসেবে। তারা আমাকে ডক্টর মনে করল নাকি Doctorate in Medicine মনে করল সেটা পরিস্কার না। কিন্তু একটা ব্যাপার আমার কাছে পরিস্কার, তা হল নামের আগে Dr. ব্যবহার এর যোগ্যতা অর্জন এত সহজ না।
গত সেমিস্টার এ আমি English department এর Technical and professisonal writing একটা কোর্স নিলাম। প্রথম দিনই কোর্স professor সবার নাম জিগাইল। আমি বললাম my name is mahbub..আমার উচ্চারণ সে ঠিকমত বুঝে নাই।এরপর পুরো সেমিস্টার জুড়ে আমাকে সে "Mabu" নামেই ডেকে গেল। English department এর সেই কোর্স এ আমি আর এক চাইনিজ স্টুডেন্ট ছাড়া সবাই আমেরিকান। এরা আবার উচ্চারণ একটু এদিক ওদিক হলেই কিছু বুঝে না।
এই বিশ্বকাপ ফুটবল এর সময় সামার ভ্যাকেশন থাকাতে ভাল মত শুধু খেলা দেখালমই না নিজেরও নিয়মিত মাঠে ফুটবল খেললাম। আস্তে আস্তে চীন, সেনেগাল, ইন্ডিয়ান, নেপালি, বাংলাদেশি, ত্রিনিদাদ, আমেরিকান খেলোয়াড় যোগাড় হয়ে গেল। কিন্তু চাইনিজ খেলোয়াড় গুলো আমার নাম কখনই ঠিকমত উচ্চারণ করতে পারল না। তাদের ইংরেজি most funny আর সর্বজনবিদিত। আমি শত চেষ্টা করেও কিছু করতে পারব বলে মনে হয় না।
পরিশেষে সুমনের সেই বিখ্যাত গান দিয়া শেষ করতে চাই..
"হাল ছেড় না বন্ধু
বরং কন্ঠ ছাড় জোরে
দেখা হবে তোমায় আমা্য়
অন্য গানের ভোরে.."

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




