somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গতিজড়তা (১)

০২ রা জুন, ২০১২ বিকাল ৪:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

***[][][][][][][][]***
রুমুর মন ভাল নেই। কতরকম চেষ্টা চরিত্র করেই না মানুষ ভাল থাকে। একেক জনের ভাল থাকা একেক রকম। সব ব্যাপারে আনন্দ পাওয়া মেয়েগুলোর কথা না হয় বাদ দেয়া যাক। রুমু তো সেরকম না। রুমু যখন খুব ভাল থাকে তখন যেমন তার দুঃখ হয়। তেমনি দুঃখ ডেকে কোলে বসাতেও তার ভাল লাগে। এটা ঠিক যে রুমু ঠিক সবার মত নয়। সে ভাল থাকতে চায়না। অনুভূতির তীব্রতা থাকে ভাল না থাকাতে! কে জানে রুমু হয়ত কাঁদতেই ভালবাসে। এখন আপাতত রুমু ভাল নেই এটিই মূল খবর।

জুরাইনের চিপা একটা গলির ভেতর এই শেষ বাড়িটা গত পঞ্চাশ বছরে ঠিক এরকমই আছে। মোটা মোটা দেয়াল। উঁচু ছাদ। নোনা ধরা। পলেস্তরা খসে গেছে বেশিরভাগ জায়গার। কার্নিশের কোন থেকে দু একটা কচি পাকুড় বেরিয়ে আসে। এতদিনে গাছ গজিয়ে বাড়ি ঢেকে ফেলার কথা। রুমুর বাবা মাঝে মাঝে ছুটির দিন গুলোতে বাড়ির ছোকরা ছেলেটাকে মানে নকুকে কার্নিশে চড়িয়ে নিচ থেকে সাবধানে ডিরেকশন দেন। হু ওইগুলা ছাইটা দে। ওই দিকে দেখ শিকড়। উপড়ায়া ফেল। দেখিস! সাবধান। পিছলা হইছে? আস্তে কইরা পা দিয়া রাখ।
নকু সাত বছর বয়স থেকে এ বাড়িতে। নকুর মা রুমুর ফুফু। আপন না। লতাপাতার গরিব ফুফু। একসময় দাদীর বাড়িতে কাজ করত। বছর পাঁচেক আগে মারা গেল। নকু সে সময় থেকে রুমুদের বাড়িতে।
গতকাল থেকে নকুর ভীষন জ্বর!

বাড়িটার উল্টোদিকে একটা কাঠ চেরাইয়ের মিল ছিল। আগে তো রুমুরা কাউকে বাড়ির ঠিকানা বলতে গেলেই মিলটার কথা বলত। কাঠের গুড়ি স্তুপ করে রাখা ছিল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো। আর একপাশে কাঠের গুড়ি। কি যে দারুন একটা গন্ধ! কাঠ চেরাইয়ের শব্দটাকেও রুমুর খুব মিষ্টি মনে হত। ছেলেবেলায় গুঁড়ির উপর বসে থাকাটা তার প্রিয় ছিল। একটা নরম পাহাড়! পাহাড় কখনো নরম হয়? সেসব থাক। রুমুর মন ভাল নেই।
শোবার ঘরের কাছটাতে রুমুর জন্য একটুকরো বারান্দা আছে।

দোতলারএ অংশটি পরে বাড়ানো। গ্রিল দেয়া বারান্দায় রুমু কখনো কাপড় শুকাতে দেয়না। একটা নীল অপরাজিতা টবে লাগানো। লতিয়ে উঠে গেছে, মাঝে মাঝে রুমু নতুন নরম শুঁড় গুলোকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে গ্রিলে জেঁকে বসার রাস্তা দেখিয়ে দেয়। নীল ভাইদের বাড়ি থেকে সেই কবে চারাটা এনেছিল!
পেছন দিকটাতে দুটো জমজ দেবদারু! পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। একটাও অন্যটাকে বেশী উঁচুতে যাবার সুযোগ দেবেনা। দেবদারু পাতার ফাঁক দিয়ে যখন রোদ ঢোকে বারান্দায় রুমুর মন খারাপ হয়ে যায়। এত বিষন্ন লাগে! কেন যে এমন রোদ্রের ফুল একা দেখতে হয়!

গলির শেষ বাড়িটা রুমুদের। বাড়তি জায়গাটুকু দিনকে দিন ইচ্ছেমত জঙ্গুলে গাছেদের ইজারা দিয়েছে। নির্ঘাত মাঝরাতে পোকামাকড় আর সাপেরা ওখানে আড্ডা জমায়। কতদিন রুমু ওদিকে যায়না! আগে দাদী বেঁচে থাকতে জায়গাটা রোজ বিকেলে ঝকঝকে করে তুলত নকুর মা। দাদী কাপড় পাল্টিয়ে রুকু আর রুমু দু বোন কে নিয়ে ওদিকটায় মাদুর পেতে বসত। চা খেতে গিয়ে রুমুকেও চায়ে দু একটা চুমুক দিতে দিত । একটু দুরের চিকন খালটার জলের ভেতর সূর্য ডুবত চারদিকে লজ্জার রং মাখিয়ে। দাদী রুকুকে বলতো দাদা দেখ এই আলোটাকে কনে দেখা আলো বলে!
রুমুর মন খারাপ হতে থাকে আবার! দাদী কে ভাবলেই রুমুর কান্না পায়। রুমুকে এমন আলোয় কি কেউ দেখেছে!
কেউ না দেখুক। কেউ কখনো না দেখুক খোদা। হাত দুটো বুকের কাছে নিয়ে বসে থাকে রুমু!
এক সন্ধ্যায় নীল ভাই বলেছিল। বাড়ি যা রুমু। এ সময় বাইরে থাকতে নেই।

খালটা তে পানি নেই। সমস্ত গলির নোংরা কাদা জল এখন গিয়ে ঐ খালে পড়ে। লাল-নীল পলিথিন আর কাপড় কাগজ গুলো থকথক করে ওদিকে। দূর থেকে দেখে মনে হয় এসব যেন দিগন্তে মিশেছে।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রুমুর বারান্দায় রুমুর সাথে এখন কয়েকশত জোনাকি। উড়ছে ঘুরছে! ওরা যে কত কি বলে। অন্যদিন হলে রুমু মন দিয়ে শুনত। কত কি বলত। আজ রুমু ভাল নেই। চুপচাপ বসে থাকে। অস্থির হয়ে উড়তে থাকা জোনাকি গুলোর দিকে আজ একবারও তাকাতে ইচ্ছে হয়না!
কোথা থেকে যে স্রোতের মত এত দুঃখ আসে! বানের জলের মত ভাসিয়ে নিতে চায়।

বড়পা বাড়ির ভেতর হৈ চৈ তুলে ঢুকছে। রুমু টের পায়। দুলাভাই নিচে থেকেই চিৎকার শুরু করছে । বিয়ে বাড়িতে এত অন্ধকার কেন! রুমু এ রুমু.. কই তুই? পাশ থেকে কেউ কিছু বললো মনে হয়। সবাই একসাথে হেসে উঠছে। রুমু এসবে কান দেয়না। অন্ধকারে বসেই থাকে। আর তো অল্পকিছুক্ষন। একা থাকার জন্য যে সুযোগ লাগে তাতো সত্যি। রুমুর নির্জনতা ভাল লাগে। ছোট্ট এই বারান্দাটা আর নীল অপরাজিতার আলতো নরম ফুল গুলোর জন্য তার কান্না আসতে থাকে।

গত কদিন রুমু একদম বাড়ির বাইরে যায়নি। বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর থেকেই তার বাইরে যাওয়া নিষেধ।
খামোখা রোদে ঘুরাঘুরি করে বিয়ের আগে গায়ের রঙ কালো করার মানে হয়না। বড়পা ফোনে এসব বলেছে। রুমু রা কাড়েনি। ঠিক ই তো।



***[][][][][]***

নীলের চোখ টকটকে লাল। মাথার দু পাশ দপদপ করছে। রাতে ভোঁতা ব্যাথা ছিল। এখন বাড়তে থাকবে ফনা তুলবে। সারারাত এক ফোটা ঘুম হয়নি। মাথার ভেতর আগুনের ভাপ। নীলের অসহায় লাগে। এ সময়টা ভয়ঙ্কর।
দুহাতে মাথা চেপে ধরে উঠে বসে একসময়। মুখ থেকে লালা বেরুতে থাকে। নিয়ন্ত্রন হারানোর আগে গলা ফাটিয়ে নিশাকে ডাকতে চাইলো। জ্ঞান হারানোর আগে টের পায় কেউ মাথায় পানি দিচ্ছে।

নিশার মা পাশের ঘরে। দু কামরার ছোট একটা বাসা। রুমুর বিয়ের কথা বার্তা শুরু হবার পর থেকে নিশাকে বাড়িতে খুব কম সময় ই পাওয়া যায়। বেশিরভাগ সময় রুমুর কাছে গিয়ে বসে থাকে। দু ধাপ ফেললেই রুমুদের বাড়ি।
মা শোকেসের থেকে সমস্ত কাঁচের জিনিসপত্র বের করেছেন। কবে থেকে ভাবা হয় জঞ্জাল গুলো ফেলে ঝেড়ে মুঝে রাখবেন। নিশা টা যদি একটু কাজের হয়। উফ! যখন যেখানে যা পেয়েছে সব এনে তার শোকেশ ভরানোতে যেন আনন্দ। একটা পুরোনো কাঁচের রঙীন টিউব দেখে হাসি এসে গেল। মেলা থেকে সাত আট বছর আগে নিয়েছিল নীল।আনতেই নিশা দখল নিয়ে নিল। পুরোনো একটা ছবি পেয়ে সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছেন। এরকম সময় গোঙানীর শব্দ পেলেন যেন। সারা শরীরের ভেতর কেমন করে উঠল। কোলের উপর একটা চিনেমাটির গামলা,তিনি উঠতেই গামলাটা মেঝেতে পড়ে প্রতিবাদ জানান দিতেই যেন ঝনঝন করে ভেঙে ছড়িয়ে গেল।
প্রথমটাতে হতভম্ব লাগে। নীলের শক্ত শরীরটা কেমন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির একটা বোতল খুঁজে খুঁজে বের করে আনেন দ্রুত। মাথায় দিতে থাকেন। গলা ফাটিয়ে ডাকেন নিশা নিশা...।
ব্যাকুল হয়ে ডাকতে থাকেন মা। তার পায়ের নিচে মাটি সরে যাচ্ছে যেন। নীল ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে যাচ্ছে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। সমানে পানির ছিটা দিতে থাকেন চোখে মুখে। কিছুতেই কান্না থামাকে পারছেন না মা। নীল আমার বাবা কি হয়েছে তোর? চোখ মেল। ও নীল...
তিনি নীল কে ছেড়ে যেতে পারছেন না। অসহায়ের মত বুকে নিয়ে চিৎকার করছেন। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে স্বাভাবিক হতে থাকে নীল। চোখ মেলে তাকায়। মায়ের কান্না দেখে বোধহয় একটু চমকায় ও। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কষ্ট হলেও উঠে বসে। বসতে গিয়ে কপাল কুঁচকে যায়। এ মা পানি দিয়ে তো পুরা ভিজিয়ে ফেলেছো। টাওয়েল টা আনো। বলেই পরে থাকা সবুজ রঙের গেঞ্জিটা খুলে ফেলে।
-এমন কেন হয় তোর? এখন কেমন লাগছে? কি হয়েছিল? একটু আগেও তো কিছু টের পাইনি।
- ওহ এত প্রশ্ন? হা হা। ঘাবড়ে গিয়েছিলে? কিচ্ছু হবেনা তোমার ছেলের। ড্রয়ার থেকে নোরিয়ামের পাতাটা দাও। আমার ই ভুল। আগেই খাওয়া উচিত ছিল।
তোমার গুনধরী মেয়ে কই? নিশ্চয় ধেই ধেই করে বান্ধবীর বাড়ি গিয়ে বসে আছে। ওর ও এবার একটা বিয়ে দিয়ে দাও মা। হা হা
মা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
-কি? অমন করে তাকিয়ে কি দেখছো? ব্যাথাটা আর নেই মা। এখন সেরে যাচ্ছে। আজ তোমার মেন্যু কি? ছোটোমাছের ঝোল খেতে ইচ্ছে করছে। শুকনো বরই দিয়ে রান্না করো।

-তুই আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি খোকা। হঠাৎ হঠাৎ এমন হয়। কেন ডাক্তার দেখাস না? নিজের প্রতি এত অবহেলা কেন তোর?

- মা! ভেবোনাতো। কিচ্ছু হবেনা। মাইগ্রেনের ব্যাথা। অনেকেরই হয়। তুমি যাও। গরম ভাত খেতে ইচ্ছে করছে। হারমোনিয়ামটা এগিয়ে দিয়ে যেও মা।

-এখন এই শরীর নিয়ে গান করতে বসবি? একটু চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাক বাপ। আমি এক গ্লাস শরবত করে আনি।

-কিচ্ছু লাগবেনা তো। আজই তো হলুদ তাইনা মা? কি গিফট নেবে ভেবেছো?
হা হা একটা রান্নার বই কিনে দিও। রুমু দেখে দেখে জামাইয়ের জন্য রান্না করবে!
হাসতে গিয়ে কাশি আসে নীলের। চোখে পানি এসে যায়! হাসি থামেনা।

মা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। অপ্রকৃতস্থের মত করে হাসছে ছেলেটা। ওর কি মন খারাপ? নীল কিছু লুকোচ্ছে হয়ত। মা হিসেবে তিনি কি করতে পারতেন এখন? এত অসহায় লাগে মায়ের। মনে হয় একা এই সংসারটাকে সামলাতে গিয়ে হয়ত কখন হাল ছেড়ে বলবেন আর পারছিনা। আবার মুঠো শক্ত করে ধরেন! ছেলে আর মেয়ে দুটোকে মানুষ করে যে দ্বায়িত্ব তার কাছে ছেড়ে গেছে তা পূরণ করে দেখিয়ে দেবেন, তিনি হাল ছাড়েন নি। নিশার বাবা সত্যিকারের ভাল মানুষ ছিলেন বলেই হয়ত শিক্ষা আর আদর্শ ছাড়া সন্তানদের জন্য কিছু রেখে যেতে পারেন নি।
রান্নাঘরে ঢুকতেই হারমোনিয়ামের শব্দ পেলেন। কেমন ঝড়ের মত বাজাচ্ছে নীল। হে খোদা মন ভাল করে দাও। ছেলেটার মন ভাল করে দাও। বুকের ভেতর ধ্বকধ্বক করতে থাকে মায়ের!



***[][][][][][][][]***

রুমুর নামে একটা চিঠি এসেছে আজ! একটু আগে। নকু চিঠিটা নিয়ে শুকনো মুখে রুমুর সামনে এসে দাঁড়ায়।

-কি রে মুখ শুকনা কেন? উম? নকিব সাহেব?
দেখি এদিকে আয়। জ্বর আছে এখনো? তুই তো আচ্ছা রে! আমার বিয়ে আর তুই কিচ্ছু করবিনা বলে জ্বর বাঁধিয়ে বসে আছিস!

-ছোটপা! তুমি যে কি না। মামা তোমারে চিঠি পাঠাইসে। ধরো। আমারে বাজারে যাইতে হবে।

-কে যাবেরে তোর সাথে? কি কিনতে? সবাই কি খুব খুশি? বিড়াল টার কি করলিরে নুকু?
কদিন আগে কোত্থেকে যে একটা মাদি বেড়াল আন্ডা বাচ্চা নিয়ে তাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। যেখান সেখান নোংরা করে ফেলছে। আজ যদি দাদী বেঁচে থাকতো! কিছুতেই একটা দিন ও রাখতে দিতনা। অবশ্য আম্মা আবার পশুপাখি খুব ভালবাসে। বলেন আমাদের নবীজি খুব ভালবাসতো বেড়াল কে। এই শুনে দাদী বলেছিল হ্যা নিজের খাবার খাওয়ায়ে শত্রু পুষিও বাড়িতে। বিড়াল এমন জাত খাইতে দিলেও ওই খাবারে মুখ দেয়া ওর স্বভাব।কখন কোন খাবারে মুখ দিবে সবাই মিলে ডিপথেরিয়া হয়ে তখন মরিও। রুমু আর বড়পা খুব হাসতো দাদীর সাথে মায়ের এমন বিড়াল নিয়ে টানাটানি দেখে।
রুমুও বিড়াল দেখতে পারেনা। দেখলেই গায়ের মধ্যে কেমন ঘিনঘিন করে। আর বেড়ালটা প্রথমে রুমুর খাটের তলেই এসে ঢুকেছিল। দুবার নকু দূরে হাটখোলার কাছে ফেলে এসেছে। বদ বেড়াল আবার এসে পড়েছে।
শোন নকু বেড়ালকে দূরে পাঠানোর একমাত্র উপায় কি জানিস? নীল ভাই বলেছে বিড়ালকে ট্রেনে চড়ায় দে। দেখবি দূরে চলে গেছে বেড়াতে বেড়াতে। হি হি
এইটা কিন্তু ঠিক বলিছে নীলদাদা। একদিন গিয়া ট্রেইনে চড়ায়া দিয়া আসব। পরিবারসুদ্ধ বেড়ায়া আসুক। দুজন মিলে কিছুক্ষন খুব হাসলো। বাড়িতে নকুর সবচেয়ে আপন এই ছোটপা। ছোটপা শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে নকুর একটুও ভাল লাগবেনা।
একটু পর হঠাৎ নকু বলে আপা আমারে নিয়া যাবা তোমার সাথে?
রুমুর চুপ করে যায়। নিয়ে যাব নকু। তুই গেলে আমারও ভাল লাগবে। তোর ময়না পাখি ছেড়ে কেমনে যাবি? বলেই মিটমিট করে হাসে রুমু। সে দেখা যাবে । পাখি নিয়াই যাব। তুমার বাড়ি আমার ময়না বেড়াইবেনা?
ওরে পাকনুটা। বলেই নকুর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় রুমু।
মনে পড়তেই বলে আম্মা কি করছেরে ?

-আম্মা নীল ভাইরে নিয়া আমারে বাজারে যাইতে বলছে। এখন যাব। লিস্টি দিয়া দিসে। তোমার বিয়ার খুশিতে আমার জ্বর কিন্তু এবার জলদি সাইরা যাইতেছে দেখছো? এখন আলুর ভাঙা বানাইতেছে আম্মা । অনেক মানুষ হবে। বল? সবাই রাইতে খাইব।

চুপ হয়ে যায় রুমু! হাতের চিঠিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে।
তুই যা।
মামা আসবেনা। ছুটি পায়নি। রুমুর খুব কান্না পায়! চিঠিটা আরো একবার পড়তে শুরু করে। এত ছোট একটা চিঠি!

রুম টুম টুম,
কেমন আছিস রে ছোট্ট মেয়েটা? এই দেখ তুই যে এখন কত্ত বড় আমি খালি ভুলে যাই। মনে হয় এক্ষুনি গুট গুট করে দৌড়ে আসবি। আমি তোর ডানা ধরে উড়িয়ে দেব আকাশে। তুই ভয়ে কেঁপে উঠবি। আর আমি কোলের মধ্যে যখনি নেব, রাগ করে আমার নাক কামড়ে দিবি।
হাহা!
এই দেখ নাকটার কি করেছিস আমার!
খুব ভেবেছিলাম তোর বিয়েতে যাব। হলনারে।
পাগলি আমার একদম কাঁদবিনা। তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি দেখছিস না?
ছুটি পেলাম নারে। এক সপ্তাহের মধ্যে যে কোন দিন বড় সাহেব ইন্সপেকশনে আসবে।
তুই নতুন জামাই নিয়ে চলে আসবি সুযোগ পেলেই। দেখিস জঙ্গল কেমন করে তোকে আপনের মত বুকে টেনে নেবে!
এখন বাইরে খুব অন্ধকার! তুই যে জঙ্গল টা দেখে গিয়েছিলি সেই জঙ্গল টা ঠিক ওরকমই আছে জানিস? জানালার বাইরে যে বকুল গাছটা। ও রোজ সকালে আমাকে কি বলে বলতো? বলে তোকে ওরা খুব মিস করছে। হা হা। তুই কিন্তু অনেকদিন আমাকে নতুন কবিতা লিখে দিস না। কেন বলতো? বুড়ো হয়েছি বলে কি আমাকে এমন অবহেলা?
সেদিন ডাহুকি এসেছিল শ্বশুরবাড়ি থেকে। তোর কথা জিজ্ঞেস করলো। বললাম তোর বিয়ে সামনে। শুনে খিলখিল করে হাসলো। কেন জিজ্ঞেস করলাম জবাব দিলনা। সিধুমালি তোর জন্য বাঁশের পাটি বানাচ্ছে। আমাকে বলেছে শেষ হলেই যেন তোর শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করি। কি যাদু করে গেছিস ওদের?
আমার ছোট্ট মেয়েটা। আমার হাতের তালুর উপর থাক। আমার পিঠে করে তোকে পৃথিবী ঘোরাবো বলতাম তোর মনে আছে মা? তখন তোর পৃথিবী ছোট ছিল ভীষণ। এখন তোর পৃথিবী বড় হয়েছে। দিন দিন আরো পরিধি বাড়বে। নতুন পৃথিবীটাকে খুব ভালবাসিস রুমু। দেখিস তুই সুখি হবি।
-তোর ঘোড়া মামা

রুমু কাঁদে! কত রকম কষ্ট যে এক হয়ে যায়।
বছর তিনেক আগে শেষ বার রুমু ট্রেনে উঠেছিল। ট্রেন ঘুম ঘুম বলতে বলতে সারারাত দুলে দুলে গেল। কি অদ্ভুত! মাঝে মাঝে রুমুর মনে হয়েছে এ ঠিক একটা ঘোড়া। বাধ্য আর ভীষন তেজী! থামতে চাইলে কত দূর থেকে তাকে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে হয়!

মামা নতুন একটা বাংলো পেয়েছে । শুনেই রুমু কত স্বপ্ন দেখে ফেলেছিলো। কাঠের দোতলা বাড়ি। ঠিক একটা উপন্যাসের মত। রুমু যখন ঘুমিয়ে থাকবে পেছনের জঙ্গল থেকে সিংহের গর্জন শোনা যাবে! হাতির পাল থপ থপ করে বাড়ির পাশ দিয়ে যাবে! আর ভোরে হরিনেরা জল খেতে যাবে যখন তখন দোতলার বেলকুনিতে দাঁড়ালে দেখা যাবে স্বচ্ছ জলের ঝিলটাকে। দূরে একটা ঝরনা থাকবে। রাত গভীর হলেই তার জল পড়ার শব্দ ধীরে ধীরে জঙ্গলের সব শব্দকে ছাপিয়ে শোনা যেতে থাকবে। বালিশে চুল ছড়িয়ে রুমু মাথা রাখবে। তার মনে হবে নিচেই পাতালে জল বয়ে যাচ্ছে কুলকুল!
নাহ এরকম টা বাস্তবে হয়না। আর বাংলোটাও ঠিক মনের মত হলনা রুমুর। পুরোনো একটা দু রুমের বাসা। প্লাস্টার খসা গায়ে কালিঝুলি আর মাথার উপর লাল রং এর মরচে ধরা টিন। কি অসহ্য! কিন্তু রাতে যখন বৃষ্টি হল রুমুর মন ভাল হয়ে গেল। টিনের ঘরে বৃষ্টির হিম শরীর কাঁপিয়ে গেল। আর কাঁচ নুপুরের শব্দ হল কানের কাছে সারারাত। অদ্ভুত ভাল লাগায় মন ভরে গেল রুমুর।
ট্রেনে চাপলেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়।ঠিক যেমন করে দুলে দুলে ঘোড়াটা মামার জঙ্গলে এনে দিল তাদের, ঘরের ভেতর একটা চৌকিতে বসে থেকেও সে দুলুনি টের পেতে থাকে রুমু।
মামার ঘরের কাজ টাজ করে বিধুমালি আর তার মেয়ে ডাহুকি। ডাহুকির সাথে রুমুর খুব ভাব হল। একদিন ডাহুকিদের গ্রাম থেকেও ঘুরে এসেছিল। সন্ধ্যা যখন হব হব কি সে তীব্র লাল মিলিয়ে যাচ্ছে মাটির বাড়িটার বারান্দায়,রুমু কোনদিন ভুলবেনা। ডাহুকি একটা পোড়া মাটির পুতুল দিয়েছিল রুমুকে। রুমুর কাছে দেবার মত কিছু ছিলনা । মামা বলল , তুই কবিতা লিখে দে ডাহুকি কে। আমি বাঁধিয়ে এনে দেব শহর থেকে। কি যে চার লাইন লিখেছিল রুমু আজ আর মনে নেই। ফুল লতা পাতা কিছু একটা হবে। কিন্তু ডাহুকির আনন্দিত মুখটা মনে পড়তেই রুমুর মন ভরে যায়। কেমন আছে ওরা!
ডাহুকি তার বিয়ের কথা শুনে কেন হেসেছে রুমু জানে। ওদের ছোট ঝাপড়া গুলোতে সেদিন বেড়াতে বেড়াতে গিয়েছিল রুমু। সেদিন ই একটা দেহাতী মেয়ের বাচ্চা হল। সবাই তা নিয়ে ব্যস্ত। রুমু বলেছিল আমার ছোট বাচ্চা ভীষণ পছন্দ। কেমন তুলার মত হয় তাইনা ডাহুকি? কুশি কুশি হাত পা দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। ডাহুকি বলেছিল তুমার বিহা হোলে এরাকোম গেঁদা হোবেগো। কেমন অদ্ভুত করে যে ডাহুকি কথা বলে। ঠোঁট উল্টে যায় আর উপরের মাড়ি দেখা যায় আর ঝকঝকে দাঁত গুলো বেরিয়ে আসে। কেমন অদ্ভুত করে বলল বিহা হোলে!
রুমু মনে করে আপন মনে হাসতে থাকে। বিয়ের কথা শুনে কি ডাহুকির সে কথাটা মনে পড়ে গেছে? কে জানে!
মামা বিয়ে করেনি। কেন করেনি রুমু তা জানে। সবাই জানে। রুমুর কাছে গল্প মনে হয়! অথচ সে টের পায় গল্পেরা তো জীবনের বাস্তবতার কাছে কবেই হার মেনে বসে আছে।

মামা দোলনের গল্পটা বলো! মামা হাসে। আর কত বার শুনবি পাগলি? মামা সুন্দর করে হেসে হেসে গল্পটা বলে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একই রকম। যেন একটা লিখিত গল্প তিনি পড়ে শোনান। যেন তাঁর মাথার ভেতর অহরহ যে নতুন গল্প আসে তা ঐ একটা গল্পের কাছে বড় বেশি ম্লান বলে কখনো পরিবর্তন হয়না।

মামা গল্পটা শেষ করে যুদ্ধে যাবার আগে শেষবার যখন দোলনের সাথে তার শেষ দেখা হয়। কি মিষ্টি আর আবেগি ছিল শেষ দেখাটা! মন ভাল হয়ে যায় রুমুর।
অথচ গল্পটা যেদিন ই শোনে রুমু সেদিন ই লুকিয়ে ঘরে এসে কাঁদে। আর মামাও ব্যাকুল হয়ে কাঁদে। রুমু জানে এসব।

দোলন কে ধরে নিয়ে গিয়েছিল যুদ্ধের সময়। দেশ স্বাধীনের ঠিক এগারো দিন আগে দোলন ফিরে আসে। স্বাভাবিক ছিল না সবকিছু। দোলন ফিরে এলে হয়ত অনেক কিছুই হতে পারতো। দেশ স্বাধীনের সাথে সাথে হারানো কুমারীত্ব ফিরে পেতো দোলন। অথবা অবাঞ্চিত হতে পারতো। অথবা আর অন্য কিছু। দোলন সেসবের সুযোগ দেয়নি। ট্রেন লাইনে দোলনের ছিন্ন ভিন্ন লাশ পাওয়া যায়।
কেন যেন আজও মামা বিশ্বাস করতে পারেনা। দোলন তার ফেরার অপেক্ষা না করেই চলে গেছে। কোন একটা ট্রেন আজও যাওয়া আসা করে এপার থেকে ওপারে। একটা স্টেশন একা মানুষদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। যখন প্রচন্ড দুপুর! যখন মাথার উপর ভীষন রোদ ট্রেন টা হয়ত সিগন্যাল দেয় ,আসবে আসবে করে আর গভীর রাতে এসে পৌঁছায়। দূরে তারাদের বাতি জ্বলে। লোকজন ঘুমিয়ে থাকে। টের পাবার আগেই জংশন ছেড়ে চলে যায়।
অপেক্ষা প্রতিদিন নতুন উদ্যমে শার্টের পকেটে জমতে থাকে।
এসব তো গল্পের মতই।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুন, ২০১২ বিকাল ৪:১৯
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৩:০৬

অবশেষে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেফতার করেছে ডিবি। এবং প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিবি জানিয়েছে সে ছোটবেলা থেকেই বদমাইশ ছিল। নিজের বাপকে পিটিয়েছে, এবং যে ওষুধের দোকানে কাজ করতো, সেখানেই ওষুধ চুরি করে ধরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×