মন ছুঁয়ে যায় এমন কিছু না,মনটাকে হয়তো একটু দোলা দিয়ে যেতে পারে এমনি একটা কাহিনী বলব আজ।মেডিকেল কোচিং করতে এসে শুক্রাবাদের একটা বাসায় উঠেছিলাম। সেই সুবাদে বাড়িওয়ালার ছেলে জাহিদভাইয়ের সাথে পরিচয়।দেখতে সাধারন কিন্তু অসাধারন মানসিকতার এই মানুষটিরই গল্প বলব আজ। জাহিদভাইয়ের সাথে পরিচয়ের সুত্র ধরেই ওনার ভাললাগার মানুষ সানজু আপুর সাথে আমার পরিচয়।গল্পটার কিছুটা অংশ ওনাদের মুখেই শোনা যাক।
সানজুআপু
সানজিদা ইসলাম। সবাই আমাকে সানজু নামেই চেনে।বাবা আমাকে আদর করে এই নামেই ডাকতো।ছোটবেলা থেকে আমার বাবাই ছিল আমার পৃথিবী।বাবাকে আমি প্রচণ্ড ভালবাসতাম।পরহেজগারি বাবা এক কথার মানুষ ছিলেন।যা বলবেন তাই করতেন।আপনারা ভাবছেন বাবার এতো গল্প করছি কেন?কারণ পরমপূজনীয় বাবা আমার ২২ বছরের জীবনে ঝড় বইয়ে তছনছ করে দিয়েছিলেন।
ধানমণ্ডি লেক ঘেঁষেই আমাদের বাসাটা।বিকেলবেলায় কফি হাতে লেক-অভিমুখি জানালা দিয়ে বাইরের জগতটাকে দেখা আমার বহু পুরনো অভ্যাস।একটা লম্বাচুলো সদ্যজাগ্রত দাড়ির ছেলেকে প্রায়ই দেখতাম আমাদের বাসার কাছেই মাছ ধরত।সিগারেট মুখে হেঁড়ে গলার ইংলিশ গান গাওয়া ছেলেটাকে দেখলেই আমার গাটা ঘৃণায় রি রি করত।আস্তে আস্তে সেটাও চোখ সইয়ে গেল।কেমন যেন একটা ভাল লাগা অনুভুতি তৈরি হল।অনেক কষ্টের পর ছেলেটা যখন একটা মাছ পেত তখন আমার কিযে খুশি লাগতো তা ভাষায় বোঝাতে পারব না।ভালই কাটছিল দিনগুলো।হঠাত একদিন দেখি ছেলেটা নেই।আমার অস্থিরতা দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম।১৫দিন পার হয়ে গেল,আমার মনের খচখচানি কিছুতেই দূর হচ্ছে না।নিজের উপর নিজেই বিরক্ত হচ্ছিলাম,একটা চেংড়া ছেলের জন্য আমি কেনো অস্থির হচ্ছি।প্রতিটা বিকাল আমার চোখ শুধু ছেলেটাকেই খুজে বেড়াতো।দীর্ঘ ২২ দিন পর এক বৃষ্টিস্নাত বিকালে ওকে ছাতা মাথায় মাছ ধরতে দেখে আমার চোখের বৃষ্টি আটকাতে পারলাম না।মনটা কেমন অদ্ভুত শান্তিতে ভরে গেল।ওইদিনই ঠিক করলাম ওকে কাছ থেকে দেখবো।তারিখটা আজও মনে আছে।৩রা জুন২০০৬...খুব ভাল করে না দেখলে ছেলেটাকে বখাটে মনে হবারই কথা। তার চোখ কিন্তু অন্য কথা বলে।কিছুটা মায়া কিছুটা লজ্জা মিশানো চোখ দুটিতে তাকিয়ে চোখের পলক ফেলতে যেন ভুলেই গিয়েছিলাম।বেচারা লজ্জা পেয়ে নিজেই চোখ নামিয়ে নিল।বিশ্বাস করুন প্রতিটা বিকালে শুধুমাত্র ওইদুটি চোখ দেখার জন্য ওখানে ছুটে যেতাম।বেচারা প্রতিবারই লজ্জায় কুঁচকে যেতো।মাঝে মাঝে মনে হতো ও যেন কিছু একটা বলতে চাচ্ছে।
এরপরই ঘটল আসল ক্লাইম্যাক্স।আমার নামে প্রায়ই কাজিনদের পাঠানো কুরিয়ার আসতো।একদিন কুরিয়ার রিসিভ করে ডেলিভারিম্যান এর দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম।ও যে কুরিয়ার নিয়ে আসবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি।রিসিট উল্টে দেখি লেখা ,জাহিদ-০১৭১৭৬৪৬৩...ততক্ষনে সে হাওয়া।নয়-নয়টা দিন নিজের সাথে যুদ্ধ করে নিজেই হেরে গেলাম।একবিকালে ওই জানালায় দাড়িয়ে ওকে ফোন দিলাম।আমার
ফোন ধরে যেই বুঝল আমি ফোন করেছি,তখনি ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের জানালার দিকে তাকাল।সে যেন জানত আমি ওখানেই দাড়িয়ে আছি।এরপর থেকে প্রতি বিকালেই জানালায় দাড়িয়ে মোবাইলে তার সাথে কথা বলতাম।একটা মাছ পেলেই আর কথা নেই,আমাকে দেখানো চাইই চাই।ওর শিশুসুলভ মনটাই আমাকে বেশি টানত।
ভালোয় ভালোয় দেড় বছর পার হল।বাসার সবাই আমার প্রেমের কথা জেনে গেল।যে বাবা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় বন্ধু,সেই বাবাই আমার জীবনটাকে চুরমার করে দিলেন।বাবার একটাই কথা তিনি প্রেমের বিয়ে মানবেন না।তাই ছেলেকে দেখার প্রয়োজন ও বোধ করলেন না।অথচ এই বাবা জীবনে আমার কোন আবদার ফেলেন নাই। আমার পছন্দটাকে বাবা কোন গুরুত্বই দিলেন না।বাবা যেরকম মানুষ তাতে তিনি কখনোই এই বিয়ে মানবেন না।একবার ভাবলাম পালিয়ে বিয়ে করি কিন্তু জাহিদ রাজি হল না।তার কথা,মানুষ বিয়ে করে সুখী হবার জন্য,কিন্তু এভাবে বিয়ে করে কখনো সুখী হওয়া সম্ভব না।এখন ভাবি,এমন বাবার মেয়ে হয়ে কেন প্রেম করতে গেলাম।আপনারাই বলুন প্রেম ভালোবাসা কি যুক্তির উরধে নয়? আমি যেন জিন্দালাশ হয়ে গেলাম।এখনো আমার দুটো বিকাল কাটে লেকের মাছ ধরা দেখে।শুধু চোখ আমার খুজে বেড়ায় সেই লজ্জা ও মায়া মেশানো চোখ দুটো কে.........
জাহিদ ভাই
সানজু যে প্রতিটা বিকালে জানালা দিয়ে আমাকে দেখত তা কখনো টের পাইনি।টাইফয়েডের জন্য তিন সপ্তাহ পর যেদিন ফিরলাম,সেইদিনই দেখলাম একটি মেয়ে অপলক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ।এরপর প্রতিদিনই মেয়েটাকে হাঁটতে দেখতাম।প্রতিদিনই ভাবতাম ওর সাথে কথা বলব,কিন্তু সাহসে কুলাতো না। একদিন মরিয়া হয়ে কন্টিনেন্টাল কুরিয়ারের মজিদ ভাইকে ১০০ টাকা ঘুষ দিয়ে সানজুর কুরিয়ারটা দিতে গেলাম।ওকে এবারও কিছু বলতে পারলাম না। কোনমতে মোবাইল নম্বর দিয়ে পালিয়ে এলাম। এরপরের একটা সপ্তাহ যেন জাহান্নামে কাটালাম।মোবাইল প্রতিটা কল এলেই চমকে উঠতাম,এই বুঝি সানজুর কল এল। ৯ দিন পর এক বিকালে ওর কল পেলাম।এরপর স্বর্গীয় দেড় বছর কাটালাম।কিন্তু আমাকে চুরমার করে দিলেন সানজুর বাবা।একরোখা মানুষটা আমাদের স্বর্গীয় প্রেমকে নিজ হাতে গলা টিপে মারলেন। সানজু বলেছিল পালিয়ে বিয়ে করতে কিন্তু আমি রাজি হইনি। অযথা দুঃখ বাড়িয়ে লাভ কি।তাছাড়া এরকম বিয়েতে আমার পরিবারও রাজি ছিল না ।এখনও মাছ ধরি তবে সানজুর বাসার কাছে না। মাঝে মাঝে গভীর রাতে সানজুর বাসার সামনে দাড়িয়ে আমার ভালবাসার মানুষের মুখটা কল্পনা করি।কল্পনা করে বুঝতে চেষ্টা করি ভালবাসার মানুষটা কেমন আছে।
আমার কথা
এই কথাগুলো ২০০৮ এর আগের।জাহিদভাই এখন একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মের CEO হিসাবে আছেন।তার জন্য বিয়ের পাত্রী খোজার দায়িত্ব পড়ল আমাদের উপর।২০১০ সালের ফেব্রুয়ারির কোন একটা বিকালে জাহিদভাই আমাকে আর রাতুলকে ডেকে বললেন আজ ওনাকে পাত্রীপক্ষ অফিসেই দেখতে আসবে।বিকালে পাত্রিপক্ষের যে মুরুব্বী আসলেন তাকে দেখার জন্য জাহিদভাই প্রস্তুত ছিলেন না।স্বয়ং সানজু আপুর বাবা। সম্ভবত উনি জাহিদভাইকে আগে দেখেননি, আর দেখলেও চুল ছেঁটে ফেলায় জাহিদভাইকে চেনেন নাই।সবদিক বিবেচনা করলে জাহিদভাই এখন সত্যিকার যোগ্য পাত্র।উনি জাহিদভাইকে পছন্দ করলেন। আমার আর রাতুলের প্ল্যানটা ভালই কাজ দিল।জাহিদভাই অবশ্য কিছুই জানতেন না। সবচেয়ে মজা হল যেদিন জাহিদভাই পাত্রি দেখতে গেল। আমি অবশ্য সানজুআপুকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম,যাতে কোন ঝামেলা না হয়। বিশ্বাস করুন বিয়ের আগ পর্যন্ত আমরা চরম টেনশনে ছিলাম,কখন কি হয়ে যায়।বিষয়টা গাঁজাখুরি মনে হতে পারে,কিন্তু ব্যাপারটা সত্যি।২০১০ সাছের ১৯মার্চের রাতে আমাদের সব টেনশন নিভিয়ে দিয়ে একটি শ্বেতসুভ্র ভালবাসা বিয়েতে রুপ নিল।
শেষ কথা
এখনো ধানমণ্ডির জাহাজবাড়ির সামনে হাঁটতে গেলে প্রায়ই জাহিদভাই ও সানজুআপুকে পা ঝুলিয়ে লেকের পারে বসে থাকতে দেখা যায়। দেখলেই মনে হবে এরা যেন একে অপরের জন্য সৃষ্টি। অদ্ভুত ভাললাগায় মনটা ভরে যাবে আপনার। তখন মনে হবে ভালবাসা আসলেই মহান..... ভালবাসা আসলেই পবিত্র...
(এই দম্পতির জন্য আপনারা ভাল করে দোয়া করবেন।কারন তারা আগামী ২০শে ডিসেম্বর একজন রাজপুত্রকে এই দুনিয়ায় আনতে যাচ্ছে। রাজপুত্রের নাম ঠিক করার দায়িত্ব কিন্তু আপনাদের !!!!)