২১শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩। সকাল ৬:০০টা, বান্দরবান।
আমরা নাস্তা ও কিছু শুকনো খাবার নিয়ে রওনা হলাম নীলগিরি’র উদ্দেশ্যে।
নীলগিরি। সে এক স্বপ্নের রাজ্য। মেঘের রাজ্য। এক স্বতন্ত্র পৃথিবী। প্রকৃতির অপরুপ লীলাভূমি। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এবং বান্দরবান শহর থেকে দূরত্ব প্রায় ৫২ কিলোমিটার। রাস্তা সম্পূর্ণই পিচ করা। বাট্, সিলোটি রাস্তাকেও হার মানিয়ে এইসব রাস্তা কখনো কখনো ৯০ডিগ্রি পর্যন্ত বাঁক নিয়েছে। সে এক নূতন অভিজ্ঞতা।
আমি সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বসলাম। ড্রাইভার চালাচ্ছেন আর আমি দু’চোখ মেলে প্রাণভরে দেখছি। পথিমধ্যেই মেঘদূতের সাক্ষাৎ- কয়েক দফা। গাড়ির জানালা দিয়ে হাত বাড়ালাম- সে এক অপূর্ব অনুভব। কোমল স্পর্শে পরম মমতা বুলিয়ে গেলো- মেঘ। আর পেছন থেকে সোল্লাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে- লাইফ ইজ সাকসেস। উই আর হ্যাপি..। অত:পর, বারোয়ারি গানে তুমুল হৈ হুল্লোড়..। আহ্, সে কি আনন্দ।
আমি এ ভ্রমণের আগ পর্যন্ত ঝাঁকে ঝাঁকে কুয়াশা দেখেছি। ছুঁয়েছি। চা বাগানের বাংলোতে বসে বৃষ্টিবন্দি রাত-দিন কাটিয়েছি। বৃষ্টি ছুঁয়েছি। বৃষ্টিতে ভিজেছি। খালি পায়ে হেঁটেছি। সবুজ ঘাসের উপর। মাঠের উপর। দেখেছি বৃষ্টিজলের অপার রহস্য। দেখেছি রাস্তার উপর নেমে পড়া বৃষ্টিজল- পাহাড়ি ধল । যেনবা ছোট্ট ‘ছড়া-গাঙ’। চা পাতার উপর টুপুর-টাপুর বৃষ্টিফোঁটা। আবার কখনো কখনো ‘শিয়াঁলবৃষ্টি’র অপার রহস্যময়তা। কিন্তু কখনোই এভাবে মেঘ ছুঁইনি। ছুঁয়ে দেখিনি।
শ্রীমঙ্গলে যদি কখনো আপনারা যান নভেম্বর কিংবা ডিসেম্বর কিংবা জানুয়ারী ইভেন ফেব্রুয়ারীতেও, তাহলে দেখবেন কুয়াশা কত প্রকার ও কি কি..! আর শীত, সে তো বাংলাদেশের মধ্যে রেকর্ড। বলা নেই কওয়া নেই, হর-হামেশা শুন্য ডিগ্রিতে চলে আসে। আবার কখনো কখনো শুন্যেরও নিচে..! শীতপিষ্ট শ্রীমঙ্গলবাসী এবং ‘চা-শ্রমিক’দের জীবন-যাপনও দেখার মতোই..।
কথা প্রসঙ্গে ড্রাইভার বললো, এই ক’দিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী নীলগিরি যাবার পথে গাড়ি উল্টে সোজা গিরিখাঁদে..। মনে প্রচন্ড এক ভয়, আতঙ্ক গ্রাস করে নিল। স্বপ্নের সলিল সমাধি..! থুক্কু..! না ভাবাই ভালো। তবে, ড্রাইভার খুব ভালো এবং অভিজ্ঞ। যদিও বয়সে খুব নবীন। বয়স- ২০ কিম্বা ২২ হবে। ছোটবেলা থেকে হেলপারি করতে করতেই স্টিয়ারিং ধরেছেন। সো, নো প্রবলেম। এখন ঠিকঠাকমতো পৌছুঁতে পারলেই হয়..
গাড়ীতে বসে বসেই আমরা ‘নাস্তা’ করে নিলাম। ওখানে পৌছুঁতে প্রায় দেড়ঘন্টা সময় লাগলো। ‘টিকিট’ করে সিড়ি বেয়ে উঠতেই টের পেলাম, এখানে এসে সমাধিস্থ হলেও সার্থকতা..। বলে রাখা ভালো, নীলগিরিতে প্রবেশ মূল্য (উন্নয়নের জন্য) জনপ্রতি ৫০ টাকা এবং চান্দের গাড়ির পার্কিং চার্জ ৩০০ টাকা। গাড়ি ভেদে পার্কিং চার্জ ভিন্ন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত ‘নীলগিরি হিল রিসোর্ট’ পরিপাটি সাজানো, গোছানো। ছোট ছোট ফুলের বাগান ও ভেষজ বৃক্ষরাজি। পাহাড়ের সীমান্ত ঘেঁষে রেলিং দিয়ে আটকানো সীমান্ত রেখা। বসার জন্য টাইলস মোড়া গোলঘর। তার সাথেই ওপর প্রান্তে ধবধবে সাদায় পরিপূর্ণ মেঘ। ঝাঁকে ঝাঁকে। যেদিকে তাকাই, দেখি- শুধুই মেঘ। মেঘ আর মেঘ। মেঘে মেঘে খেলা করছে। কোথাও উঁচু আবার কোথাও নিচু। যেনো কোন আইসল্যান্ডিক দেশ। বরফাচ্ছাদিত। অসীম সাদা।
৪/৫টা ‘কটেজ’ চোখে পড়লো। সবুজ কালারের টিন দিয়ে ছাউনি দেয়া, খুব সুন্দর। কোথাও ময়লা আবর্জনার স্তূপ বা ছড়াছড়ি দেখা গেলো না। আমাদের সামনেই সেনাবাহিনীর একজন ‘অফিসার’ কয়েকজন ‘স্টাফ’কে পরিচ্ছন্নতার দিক-নির্দেশনা দিচ্ছেন। আর বাকিরা হুকুম তামিলের জন্য জ্বি স্যার, জ্বি স্যার করছেন..। ভাগ্যিস, এটি সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত। নইলে ঢাকার রমনা পার্ক, জিয়া উদ্যান, বোটানিক্যাল গার্ডেন-এর মতো ‘ভাগাড়’-এ পরিনত হতো। যাক্, সে অবস্থা হয়নি..
‘নীলগিরি’র ওপর প্রান্তে নেমে গেছে আরেক পথ। কিছুদূর এগোলে চোখে পড়ে একটি ‘হ্যালিপ্যাড’। এটি ‘নীলগিরি’র একটি ‘শাখা-পাহাড়’। পাহাড়টির উপরিতল কেটে সমান করে তাতে ইট, সুড়কি, সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই করা হয়েছে। মধ্যিখানে বড়সড় করে একটি ইংরেজি ‘এইচ’ হরফ। আর চারপাশে লম্বা লম্বা কাঁশফুল ও কাঁশফুলজাতীয় কিছু চিকন পাতার ঝোঁপ। কাঁশফুল ফোটেনি (সম্ভবত: এখন কাঁশফুলের সময় নয়)। ফুটলে হয়তো আরো বেশি সুন্দর দেখাতো। তাতেও সৌন্দর্য্যের একটুখানি শ্রী হানি হয় নি..
হ্যালিপ্যাডের একটু উপরের দিকে, ডানপ্রান্তে আরেকটি রাস্তা নেমে গেছে। ওখানে ‘দোলনা’ এবং বাচ্চাদের খেলার বেশ কিছু সামগ্রী রয়েছে। একদিনের জন্য আমরাও দিব্যি ‘শিশু’ হয়ে গেলাম। দোলনায় দোল খাচ্ছি, আর সমস্বরে গাইছি-
মায়বন বিহারিনী হরিণী / গহন স্বপন সঞ্চারিনী
কেন তারে ধরি বারে করি পন / অকারণ
মায়াবন বিহারিনী / থাক থাক নিজ মনে দূরেতে
আমি শুধু বাসরীর সুরেতে / পরশ করিব ওর তন মন
অকারণ / মায়াবন বিহারিনী / চমকিবে ফাগুনেরো পবনে
বসিবে আকাশবাণী শ্রবনে / চমকিবে ফাগুনেরো পবনে
চিত্ত আগুনে হবে অনুভব / অকারণ
দূর হতে আমি তারে সাধিব / গোপনে বিরহডোরে বাধিব
বাধনবিহীন সেই যে বাধন / অকারণ
মায়াবন বিহারিনী / মায়বন বিহারিনী হরিণী
গহন স্বপন সঞ্চারিনী /কেন তারে ধরিবারে করি পন
অকারণ /মায়াবন বিহারিনী
কলকাতার সোমলতা’র রবীন্দ্ররিমিক্স বা রবীন্দ্র সংগীতের আধুনিকায়ন। মোদ্দাকথা, রবীন্দ্রসংগীত।
আমরা চষে বেড়ালাম। ‘বন্দী জীবন’ থেকে উন্মুক্ত হওয়া কোন ‘পাখির মতো’। খাঁচা ছাড়া, খোঁপ ছাড়া। পুরো নীলগিরি-ময়দানে। এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। যেখানেই গিয়েছি সবাই সাধুবাদ জানিয়েছে। বলেছে, আপনারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের না..?
সমস্বরে আমরাও বলি, হ্যাঁ।
-গতকালকেই নীলাচলে দেখা হয়েছিলো। মনে আছে?
আমরাও বলি, হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে আছে।
‘আপনারা নীলাচলে পুরো জমিয়ে দিয়েছেন’- স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় আরেকজন বলেন।
প্রত্যুত্তরে বলি, ধন্যবাদ ভাই।
আরো অবাক করা ব্যাপার হলো, আমাদের সাথে কথোপকথনকৃত এই ভদ্রলোকগণ আমাদেরকে দাঁড় করিয়ে রীতিমতো অটোগ্রাফ নেয়ার মতো করে সবার ছবি তুললেন। বললেন, আপনারা সবাই খুবই ‘এনারজেটিক’। আহ্। সেই যে হরলিক্স, মনে আছে তো..? না থাকলে প্রথম কিস্তিটা ভালো করে পড়ুন..
এরপর আবার আমরা নীলগিরির মূল পাহাড়ে আসলাম। তখন আবার ধেঁয়ে আসলো একগুচ্ছ মেঘ। কে যেনো বললো, ‘মেঘ খেলে নাকি সুখ-শান্তি বর্ষিত হয়’- এজাতীয় কোন মন্তব্য। অত:পর আমরা ‘রিউমারাক্রান্ত’ হয়ে যে যার মতো বড়সড় করে মুখ হা করে আছি আর মেঘ আসামাত্র গোগ্রাসে গিলছি..। সত্যিই অবাক করা ব্যাপার..। আমি ছোটবেলা থেকেই একটু বাস্তববাদী। কখনো পাত্তা দিইনি এজাতীয় কথাবার্তায়। অথচ সেই মুহুর্তে আমিও মুখ বড়সড় করে হা করে ছিলাম...
পাশ ফিরে দেখি, ‘সাইফুল’ ভাই নেই। সবাই হৈ হুল্লোড় শুরু করে দিল। কি ব্যাপার, কি ব্যাপার? সাইফুল ভাই কোথায়?
পাঠক, আপনারা নিশ্চয়ই জানেন- প্রত্যেকটা খেলায় শুধু খেলায় নয় ইভেন সর্বত্র ‘টেকনিক্যাল ভিজিটর/টেকনিক্যাল কমিটি’ শব্দের প্রচলন রয়েছে। তো, তাদের কাজ কি জানেন? যেমন: ক্রিকেট খেলায় ‘সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না..’ সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করেন টেকনিক্যাল কমিটির লোকজন। এছাড়াও আরো বিবিধ কাজের সাথেই জড়িত থাকেন..। এই কমিটির সদস্যদের ‘টেকনিক্যাল ভিজিটর’ বলা হয়। তেমনি আমাদের সাথে রয়েছেন নানামাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ভিজিটর মো: সাইফুল ইসলাম। চট্টগ্রামের আদর্শিক ‘ওয়াটার সাপ্লাইয়ার’ (আপনাদের কারো পানি লাগলে যোগাযোগ করতে পারেন, বাট ইয়াং লেডিস এন্ড নাইস গার্লস আর স্ট্রিক্টলি প্রোহিবটেড..!)।
আরেকটু বিষদভাবে বলি, দক্ষতা এবং জ্ঞান গরিমায় সাইফুল ভাই অতুলনীয়। প্রত্যেকটা জিনিসই সূক্ষাতিসূক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। সাইজ, শেপ, হাইট, ভঙ্গিমা এমনকি ড্রেস..। যাক্, শেষতক পাওয়া গেলো। নীলগিরি’র ‘টেকনিক্যাল ভিজিট’-এ ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন। ওনার পর্যবেক্ষণের কথা শুনলে আপনার ‘শিরদাঁড়’ নিশ্চিত ‘আইফেল টাওয়ার’ স্পর্শ করবে...। কারণ ঘটনাবলি আমার ‘চাক্ষুষ’... (বিশেষ কারণবশত: বিবরণ দেয়া থেকে বিরত থাকলাম। ভুলত্রুটি মার্জনীয়। অমার্জনীয় হইলে- নিজগুণে গুণান্বিত করিবেন)
যেখানে আমাদের গাড়ী পার্ক করা আছে তার ঠিক উপরে ডান প্রান্তে দেখলাম স্থানীয় দু’জন ‘ম্রো আদিবাসী’ কিছু ফলমুল বিক্রি করছে। কমলা, জাম্বুরা, হরিতকি, কলা, পেঁপে, চিনারকুলা/গুলা ইত্যাদি ইত্যাদি। কোন কিছু যেমন: দাম জিজ্ঞেস করলে তার উত্তরটুকু বুঝতে আপনার অন্তত কয়েক মিনিট এমনকি কয়েক বার জিজ্ঞেস করতে হতেও পারে। ওদের দু’জনের বাংলা বলা’টা একেবারেই অস্পষ্ট। শ্রেয় উপায় হচ্ছে হাত দিয়ে ‘ইঙ্গিত’ করা। অর্থাৎ ‘ইশারা-ইঙ্গিত’। তবে ভালো দিক হচ্ছে, বার বার জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও তারা দু’জন কিন্তু রাগান্বিত হয় নি।
আমরা ওখান থেকে কমলা, জাম্বুরা ও কলা নিলাম। শেষে কয়েকটা ‘চিনারকুলা/গুলা’। এটি দেখতে টকটকে লালচে গোলাপী রঙের। সাইজ শঁসার মতো, কোনটা আবার কমলার মতো। খেতেও শঁসার মতো কিন্তু আলাদা একটা স্বাদ পাওয়া যায়। অনেকটাই ‘বাঙ্গি’র মতো। প্রথম প্রথম না বুঝে কেনায় এটি কি কাঁচা খাবো নাকি রান্না বান্না করে খাবো- কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তবে, ঐ দুজনের একজনের কাছ থেকে খুব কষ্টেসৃষ্টে যা উদ্ধার করলাম, তা হলো- কাঁচাও খাওয়া যায় আবার রান্না করেও খাওয়া যায়। নানামাত্রিক কৌতুকচ্ছলে আমরা কিছু দাম কমানোর চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু একেবারেই নাছোড়বান্দা। আমরাও নাছোড়বান্দা। বেচারি, উপায়ান্তর না দেখে শেষমেশ একটা কমলালেবু গিফট..! হ্যাঁ হ্যাঁ...
সূর্য উঠছে, তেঁতিয়ে। ঘাম ঝরছে। ক্লান্তি ধরেছে, পা আর চলছে না। সুতরাং এবার ফিরতে হবে। তবে, ফেরার আগে ম্রো আদিবাসী সম্পর্কে একটুখানি জেনে নিই-
‘ম্রো’ আদিবাসীরা দীর্ঘদিন যাবৎ পার্বত্যাঞ্চলে বসবাস করছে। ১৯৯১ সালের আদমশুমারী মতে, ম্রোদের জন্যসংখ্যা ২২১৭৮জন। যদিও কারো কারো মতে এই সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজারের মতো। ‘মেনলে ম্রো’ নামে একজন ধর্মীয় নেতা ‘ক্রামা ধর্ম’ নামে নতুন একটি ধর্মের প্রচলন করেন ম্রো সমাজে এবং একই সাথে তিনি ‘ম্রো বর্ণমালা’র প্রবর্তন করেন। উল্লেখ্য যে, ম্রোরা নিজেদেরকে ‘মারুসা’ বলে। জর্জ গ্রিয়ারসন তার বহুল প্রচলিত লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া গ্রন্থে, ম্রো ভাষাকে একটি ‘জটিল’ ভাষা হিসেবে চিত্রায়িত করেছেন এবং ভাষাগোত্রের দিক থেকে ‘বর্মী’ দলের অন্তর্ভূক্ত করেছেন।
রচনাকাল: ২৬শে অক্টোবর, ২০১৩, ঢাকা।
পরবর্তী গন্তব্যসমূহ: পিক-৬৯, চিম্বুকপাহাড়, শৈলপ্রপাত, স্বর্ণমন্দির
চলবে..
পূর্বের দুই কিস্তি দেখুন এখানে পয়লা কিস্তি দ্বিতীয় কিস্তি