১ ঘন্টা ধরে বাড়ির সামনে খাম্বার সঙে দাঁড়িয়ে একটা ফকির বকেই যাচ্ছে, ‘মাগো চাইট্রা খাইতে দিবেন , দান করিলে মাল কমে না ইত্যাদি ইত্যাদি।’ ৪০উর্ধো গৃহিনী রাবেয়ার কাছে বিষয়টা সাভাবিকই ছিল, যদি না কাজের মেয়েটা একটা নির্দিষ্ট সময় পড়ে কেঁদে উঠতো, তা হলে হয়তো রাবেয়া ফকিরের এই করুন আর্তনাদ শুনতেই পেত না। রাবেয়ার কথা হলো আমরা তো দিতে চাই, কিন্তু কত দেয়া যায়। তার তো দয়ার শরীর। এখনও কোথাও মার্কেটে বের হলে সে সামনের দোকান থেকে টাকা ভাংতি করে বের হয়, সে যে শুধু দোকানদাররা যাতে বলতে না পারে ভাংতি নাই, পাচঁ টাকা আবার আসলে নিয়েন, তা ঠেকানোর জন্য, তা কেবল নয়। রাস্তায় কোন নাছোড় বান্দা ফকির ধরলে কি হবে এই চিন্তাও তার থাকে। কিন্তু এই রাহেলা মেয়েটার যত নেকামি। বৃদ্ধ কোন ফকির দেখলেই নাকি তার বাবার কথা মনে পড়ে যায়।
কেন যে এমন করে মেয়েটা, রাবেয়া ঠিক নির্ণয় করতে পারে না। রাবেয়া রান্না ঘর থেকে হন হন করে বের হয়। আজব মেয়ে রুটি বেলতে বেলতে দুলে দুলে কাঁদছে। রাবেয়া বিরক্ত মুখে তার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ঐ কাঁদছিস কেন? নিচে যে লোকটা দাঁড়িয়ে, সে কি তোর বাপ নাকি ?’ রাহেলা মাথা নাড়ায়, অথবা তার মাথা রুটি বেলার ধাক্কায় এমনিতেই নড়ে। খোপাবাঁধা চুলগুলিও যেন নেচে নেচে ওঠে, গৃহকর্তী বলে- ‘তা হলে বসে আছিস কেন যা রাতের খাবার থেকে তোর বাপকে কিছু দিয়ে আয়, নইলে তো আর চিৎকারে থাকতে পারছিনা।’ রাবেয়া বলে, ‘যা ওঠ।’ হুকুম দেয়ার পরও গৃহকর্তীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাহেলা বলে। ‘আর দুইখান আছে, শেষ কইরা লই, বাইজানের তো অফিসের টাইম হয়া গেছে।’ রাবেয়ার মুখে এবার শান্তির ভাব চলে আসে। তাছাড়া রান্না ঘর থেকে বের হওয়ার পর সামান্য পূর্বে সে একবার মুখও মুছে ছিল। রাবেয়া বলে, ‘সে খেয়াল তোমার আছে নাকি। তোমার তো যত চিন্তা ঐ রাস্তার যত বুইড়া ফকিরগো নিয়া।’ আরেক বার আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে কর্তী চুলার কাছে চলে যায়। আর মুখে যেন কি বলতে থাকে। কিন্তু রাহেলা তা শুনতে পায় না। কেননা সে এখন পরম মমতায় খাম্বার নিচে বসে বৃদ্ধলোকটার খাওয়া দেখছে।
বৃদ্ধটা খাচ্ছে, হালুম হুলুম করে যে খাচ্ছে তা নয়। তার খাওয়া দেখে মনে হচ্ছে সে পূর্বে ভদ্রলোক গোছের কেউ ছিল। সহায় সম্পদ হাড়িয়ে পথে নেমেছে। তার বাবার খাওয়া এমন ছিল না। মাঠ খেকে ফিরে তার বাবা মোছলেউদ্দিন একটা অযথা হুনকার দিতো। ‘কই গেলা, পানি দেও, ভাতের ব্যবস্থা কর। ডালটা একটু বেশি দিও ।’ যে দিন বাবা হুংকার দিতো না, সেদিন মাও ভয় পেয়ে যেত। তখন বাবাকে দেখে মনে হতো পাহাড়ি কোন নদীর মুখে কেউ বাঁধ দিয়ে রেখেছে । কিন্তু সে বাঁধ তো কিছুতেই রক্ষা করতে পারবে না। খাওয়া শেষে মায়ের আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে বাবা হুংকার দিয়ে বলতো । ‘আমার পান কই, এতো বড় বাল পাকনা বেডিরে এহনো কইতে হয়। না আমার নতুন মাল লইতে হইবো। এই লক্কর ঝক্কর মেশিনে আর চলবো না।’ তখন হয়তো তার খেয়াল থাকতো না, ঘরে তার ১২/১৩ বছরের একটা মেয়ে আছে। সে সব শুনতে পাচ্ছে । এভাবে বলা ঠিক না । সেই ভালো বাবাটা কোথায় যে হারিয়ে গেল। কেউ জানে না । ততদিনে তার বিয়ে হয়েছে। বাচ্চা আছে। বাবা যদি বেচে থাকতো তা হলে কি আর তাকে এতো দুরে এসে পরের বাড়ি কাজ করতে হয়।
ফকির লোকটার খাওয়া শেষ হয়েছে । সে এখন পরম তৃপ্তিতে হাতের আঙলগুলো চুকচুক করে চাটছে কিন্তু তার দৃষ্টি চঞ্চল। ‘কান্দেন কেন মা ?’
রাহেলা খেয়ালই হয়তো করেনি যে বাপের কথা চিন্তা করতে করতে তার চোখে জল এসে গেছে। সে ফকির লোকটার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল। মুখের সামনে থেকে এক ঝামটায় চুলগুলো সড়িয়ে বললো। ‘আপনের মুখ চোখ দেখতে আমার বাপের মত।’
লোকটার মুখে হাসি। সে বললো ‘বাপের বয়সি সবাই তো বাপের মতই।’ হঠাৎ যেন রাহেলার কি মনে পড়লো সে লোকটার কাছে আরও একটু এগিয়ে গিয়ে বললো । ‘আপনে আমার সঙে উপরে চলেন । আপনের সঙে আমার কিছু কথা আছে।’
মজিদ মিয়া প্রফেশনাল ফকির। সে জানে এই সকাল বেলা বাড়ির বড় কর্তারা এখনও ঘর থেকে বের হয়নি । র্দীঘ ৩০ বছর ফকিরী জীবন পরিচালনার কারনে সে জানে যে পুরুষ মানুষদের চেয়ে মেয়ে মানুষকে মেনেজ করা অনেক সোজা। ফলে সে বাড়িতে ঢুকতে নারাজ। কিন্তু রাহেলা তাকে ছাড়লো না । রাহেলা তার হাত ধরে বসলো । ‘আপনে চলেন আপনাকে যেতেই হবে।সামান্য একটু কাজ, দুই মিনিট লাগবো ।’ লোকটা ভয়ে ভয়ে বাড়ির গেট পেরিয়ে গেল।
দোতলার দরজা খুললেই ডাইনিং টেবিল। নটা বাজতে আর মাত্র তিরিশ মিনিট দেরি। বাড়ির কর্তা মুলতঃ দুইজন । একজন মোছলেম তার বয়স পঞ্চাশ। আর তার ছেলে রকিব বয়স পচিশ। তাদের কাজের মেয়ের সঙে একটা ফকিরকে ঘরে ঢুকতে দেখে দুজনেরই খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু হুংকার নয় কোন প্রশ্নও না, তারা কেবল ফকিরটাকে ভালো করে দেখলো। তারা বুঝলো সব মিলিয়ে এই ফকিরটা খাটি । এটা একটা সাজানো ফকির। ফকির দরজার সামনে বসে, তার পিঠের সঙে লেগে খটাস করে বন্ধ হয়ে যায তা। তখন তারা আবার খাওয়া বন্ধ করে, তার দিকে তাকায়। সেই তাকানোটা হয়তো ভালো নয় বৃদ্ধ লোকটা মনে হয় অসম্বব ভয় পেয়ে যায়। কিন্তু তারা আবার যেমন খাচ্ছিল তেমন খেয়ে চলে। বিশাল খাবার টেবিলের দুই প্রান্তে দুটি প্রাণীর খাওয়া দেখে মনে হয় ‘এ ভোজন কোন দিন থামবে না।’
মিনিট ১৫ কি ১০ সময় চলে গেল। কাজের মেয়েটার পিছনে ঘরে প্রবেশ করলো রাবেয়া। রাহেলার হাতে একটা ডাক ঘরের খাম, তাতে ঠিকানা লেখা । তার চোখ মুখ আগের মতই বিষন্ন। বাড়ির গৃহকর্তী বললো ‘দেখি কি নিয়ে যাচ্ছিস। ওই কি নিয়ে যাচ্ছিস ?’ কিন্তু রাহেলা এবার থমকে দাঁড়ায় । তার চোখে মুখে উত্তেজনা আসে । সে এদিক ওদিক কি যেন খোঁজে আরও কয়েক বার চোখের পলক ফেলে। তারপর বাড়ির বড় ছেলে রকিবের দিকে তিক্ষè দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন। রাহেলার শরীর মনে হয় কাঁপছিল তখন। কেননা রকিব সরাসরি খামটার দিকে তাকিয়েও ঠিকানাটা উদ্ধার করতে পারেনি। মেয়েটার চোখ রক্তবর্ন হয় সে সরাসরি রকিবের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে। ‘আপনে না আমারে গত কাল রাতেও আবার লিপিষ্টিক দিছিলেন, কেমনে পারলেন আমার বাপরে তারিয়ে দিতে।’ রকিব কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে যেন তার মুখের উপর ঠাসঠুস দরজা খুলে পথে বেরিয়ে যায়।
গলিতে নেমে রাহেলা বড় বাস্তার দিকে গেল না, গেল গলির আরও ভেতরের দিকে। সে প্রায় ছুটে গেল, তার চুল শাড়ি বাতাসে উড়লো কিছুক্ষন। এবং সে ফকিরকে দেখতে পেল। সে দেখলো যে আরেকটা বাড়ির সামনে, আরেকটা খাম্বার নিচে, একই ভাবে দাঁড়িয়ে, একই কান্না কান্না সুরে, সে বলছে ‘মাগো চাইট্রা খাইতে দিবেন। দান করিলে মাল কমে না ইত্যাদি ইত্যাদি।’ রাহেলা ত্রীক্ষè দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো । তার খুব রাগ হলো। দৌড়ে আসার কারনে সে হয়তো হাপাচ্ছিলও তখন। মাথার উপর রোদও ছিল খুব করা। হঠাৎ হলুদ খামটা ফকিরের পায়ের কাছে ছুড়ে দিয়ে করকশ কন্ঠে বললো ‘আমি আপনেরে এইটা দিতে চাইছিলাম। আপনে কিনা চোরের মত চইলা আইলেন । হায় রে আমার পুরুষ মানুষ।’ তারপর কিছুক্ষন চুপ। তারপর এক ঝামটায় মুখে চলে আসা চুলগুলি সড়িয়ে সে আবার উল্টো দিকে হাঁটা দেয়। তার খুব রাগ হচ্ছে। রাগে চোখে জল চলে আসতে চাইছে। আগের মত দৌড়ে দৌড়ে আবার ঝড়ের বেগে সে বাসার মধ্যে প্রবেশ করলো।
ডাইনিং টেবিলে মুর্তির মত সেই দুইজনের সঙে এখন গৃহকর্তীও আছে। তারা এমন ভাবে বসে আছে যেন তারা টেবিলের সঙে লাগানো। তারা যেন পুতুল। রাহেলা খটাশ করে দরজা লাগালো। ফলে পুতুলেরা প্রাণ পেয়ে গেল হয়তো। পুরুষ দুজন উঠে দাঁড়ালো। কর্তা ব্যক্তিটি কর্তীর দিকে তাকিয়ে শুধু বললো, ‘বিষয়টা রাতে এসে সমাধান করা যাবে, চল রকিব।’ পরুষ দুজন চলে গেলে রাহেলা একটা চেয়ার টেনে কর্তীর মুখমুখি বসলো। এখন তাদের দেখা যাচ্ছে আগের পুরুষ দুজনের মতোই। কিন্তু রাহেলা যদি গুনগুনিয়ে না কাঁদতো আর সেই কান্নার সঙে খোপা খুলে যাওয়া তার চুলগুলো সব সময়ের মত নেচে না উঠতো, তাহলে হয়তো সে ওদের মতই পুতুল হতে পারতো। কিন্তু সে নাকি সুরে বলে- ‘আমি আর এই বাড়িতে থাকমু না।’ গৃহকর্তী বিস্মিত হয় না। তবে সে রুটিতে কামড় দিতে দিতে প্রশ্ন করে ‘কেন ?’ তারপর রাবেয়া মাংশের একটা টুকরা রাহেলার পাতে উঠিয়ে দেয়। আর অত্যান্ত কোমল স্বরে বলে, ‘আগে পেট ভরে খাও, তারপর চিন্তা করা যাবে কি করবা। আর তুমি পিতার শেষ স্মৃতিটা যে ফকিরকে দিয়ে আসলা। কোন লাভ হবে বলে তো মনে হয় না। মাঝখান থেকে মাঝে মধ্যে যে একটু দেখতে পাইতা তাও হাড়াইলা। যাক সে কথা । খাও।’ কিন্তু রাহলো খায় না। সে কান্নার সুর আরও একটু উচ্চ করে। আঁচল দিয়ে বার বার ঠোঁট মোছে। আর গৃহকর্তী দিকে করুন চোখে তাকায়। রাবেয়া ভাবে, যে করেই হউক মেয়েটাকে ধরে রাখতে হবে। একটা কাজের মেয়ে পাওয়া সোজা নয়, সেটা আসল কথা না, রাবেয়া জানে তার ছেলে রকিবের সঙে মেয়েটার একটা লটর পটর সম্পর্ক আছে, বিষয়টা যে তার খুব ভালো লাগছে তা কিন্তু নয়। সে জেনেও না জানার ভান করে নিজের মুখ চেপে ধরে আছে । এর কারণ আছে, পাশের বাড়ি মুটকির মেয়ে শান্তা খাতুনের লগেও হেই ছোট বেলা থেকেই তার ছেলের আরও একটা লটরপটর ছিল । বিষয়টা রাবেয়া কখনোই মেনে নিতে পারেনি। মুটকি তার জানের শত্র“, প্রানের দুশমন । সে জানে কাটা দিয়ে কাটা তুলতে হয়। আগে যেখানে তার ছেলেকে বেধেও রাখা যেত না, সেখানে এই মেয়েটা বাড়িতে ঢোকার পর রকিব বাপের সঙে নিয়মিত এখন কারখানায় যাচ্ছে। মেয়েটাকে ছাড়া যাবে না। ওকে ধরে রাখতে হবে । রাবেয়া মাংশের টুকরায় টান দেয়, আর ছোল ছিটকে পড়ে রাহেলার মাথার চুলে। রাহেলা জানতেও পারে না। সে কেঁদেই চলে। রাবেয়া বলে ‘কোথায় যাবা তুমি। তুমি একটা সমত্য মেয়ে, তোমার এই রূপ যৌবন হইলো সম্পদের মত । তাকে রক্ষা করতে হইলে কোন ঘর দরকার। কঠিন দেয়ালে ঘেরা কোন মজবুত ঘর। এখানে তো তোমার একটা আশ্রয় আছে। বাইরে বের হলে তো তোমাকে শিয়াল কুকুর ছিড়ে খাবে।’ রাহেলা চুপ করে থাকে, শুধু তার দৃষ্টিতে উদ্ভেগ বারে। সে আরও দ্রুত চোখের পলক পেলে। সে কেমন যেন চঞ্চল হয়ে ওঠে। রাহেলা কান্না জড়ানো কন্ঠে বলে, ‘আমি এখানে থাকবো না, বাড়ির ছেলে আমারে জোর জোর করে লিপিষ্টিক কিনে দেয়, আমি সহ্য করেছি। কিন্তু গতকাল রাতে বাড়ির কর্তা, যারে আমি বাপের সমান দেখি সেও আমারে লিফিষ্টিক দিতে চাইলো, আমার ভালো লাগেনা। আমি এখানে থাকবো না।
গৃহকর্তী মিলানোর চেষ্টা করে। চুপকরে গভীর মনোযোগে ভাবে। অভিযোগটা গুরুতর। কিন্তু মিলাতে পারে না, কাল রাতে বাড়ির কর্তা! না মেয়েটা মিথ্যা বলে। কিন্তু পুরুষ মানুষের বিশ্বাস কি, এমন একটা অভিযোগ শোনার পর মেয়েটাকে তো আর বাড়িতে থাকতে দেয়া যায় না । তবু রাবেয়া ভাবে আগামি রাত থেকে অবশ্যই শাড়ি আর লুঙিতে গিট দিয়ে ঘুমাতে হবে। কঠিন গিট।
২৬/৪/২০১০
(অপ্রকাশিত)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ দুপুর ১২:১৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



