অফিস হয়ে পরেছে এখন এক বিশ্রী রকমের বাধ্যবাধকতা। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত একজন মানুষ যে কিভাবে একটা ল্যাপটপের সামনে রেখে চেয়ারে বসে অলস সময় কাটাতে পারে সেটার চাক্ষুষ প্রমাণ পেতে হলে ঢাকার বিদ্যুত ভবনের পাঁচলায় পূর্তকর্ম বিভাগে আসার আমন্ত্রন থাকল। আজও সে রকম একটা একঘেয়ে দিন ছিল। সন্ধ্যায় ক্লাসে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) যাব বলে উঠব ভাবছি, এমন সময় খবর পেলাম শিক্ষিকা মহোদয়া আজ আর ক্লাস নিবেননা। ভাবলাম স্যার এর সাথে গাড়ীতে বাসায় ফিরব। কিন্তু আরও ঘন্টাখানিক জবর কাটলেও উনার ওঠার কোন লক্ষন না দেখে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম আজ তার অনেক রাত হবে। বসে বসে আর মাছি মারতে ইচ্ছা করল না। ভাবলাম আজ বাসায় বাসেই যাই। বিদ্যুত ভবন থেকে নেমে দেখি লোকে লোকারন্য। ঢাকায় আজ সমাবেশ। দশ বছর বাসে ওঠার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েও আজ আর বাসে উঠতে পারলাম না। অগত্যা বুয়েটের শহীদ স্মৃতি হলে ভোলা থেকে আসা এক ছোট ভাইয়ের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে আসার পরিকল্পনা করলাম।
হাইকোর্টে মোড় হতে কার্জন হল পর্যন্ত প্রায় বিশটা রিকশাওয়ালাক জিজ্ঞাস করতে করতে মুখে ব্যথা ধরলেও কেউ যাইতে রাজি হইল না। আজব ব্যপার। অবশেষে শহীদ স্মৃতি হল পর্যন্ত একটা রিকশা পেলাম । বুয়েটের মাঠের সাথে লাগানো পিছনের গেটটা দিয়ে রিক্সাটা যখন ঢুকল, তখন হঠাৎ করেই মনটা কেমন জানি হয়ে গেল। এই রাস্তা, এই মাঠ, নিরিবিলি পরিবেশ বহু পরিচিত। কত স্মৃতি এর সাথে যে জড়ানো! যতবার যাই ততবারি নিজেকে খুঁজে পাই এখানে। ইএমই আর সিভিল বিল্ডিংয়র মাঝখান দিয়ে যাবার সময় কি জেন মনে করে হঠাৎ রিক্সাওয়ালাকে থামিয়ে দিয়ে নেমে পড়লাম। সিভিল বিল্ডিং এর নিচতলার দুইটা লিফট ততক্ষনে বন্ধ হয়ে গেছে। মাঝখানের লিফটাটা দিয়ে পাঁচতলায় দেখি দেখি বেশ কয়েকজন স্যার। মাগরিবের নামাজ শেষ করে বের হয়েছেন। পরিচিত কয়েকজন স্যারের সাথে দেখা হল, কিছুক্ষন হাল্কা কথাবার্তা । এরপর সিভিলের এক সিনিয়র স্যারের সাথে দেখা। আমি এখানে আসলে এই স্যারের সাথে দেখা করে অন্তত একটা সালাম দিয়ে যাই।স্যার আমাকে দেখে স্বভাবসুলভ হাস্য ভঙ্গিতে বললেন, “কি খবর তোমার ? কেমন আছ ?” আমি বললাম, স্যার ভাল। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ নেমে পড়লাম।
স্যার আমাকে তার রুমে নিয়ে গেলেন। এরপর গল্প। এটাকে গল্প বললে ভুল বলা হবে। বাস্তবতা। বদলে যাবার বাস্তবতা। ছাত্রদের বদলানোর বাস্তবতা, শিক্ষকদের বদলানোর বাস্তবতা, এই প্রতিষ্ঠানের বদলানোর বাস্তবতা। অনেক পুন্জীভূত ক্ষোভ, হতাশা আর আশঙ্কা। ঘন্টারও বেশি সময় স্যার এর দিকে চেয়ে কথা শোনা। বদলানোর গল্প, অসহিষ্ণুতার গল্প, অশ্রদ্ধার গল্প । আবেগপ্রবন আমাদের এই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক গ্লাসের ফাকে বার বার কেন যে তার চক্ষু মুচছিলেন, আমি বুঝতে পারলাম না, হয়ত নিজের অজান্তেই। দেড় ঘন্টারও বেশি সময় আমি শুধু শুনেছি, বলিনি তেমন কিছুই । এর আগেও এই শিক্ষকের ক্লাস করেছি, কথা শুনেছি, কিন্তু আজকের মত এত গভীর মনজোগ কোনদিনি ছিলনা।
বাইরে তখন ঝুমঝাম বৃষ্টি হচ্ছে। স্যারের গাড়ীর ড্রাইভার এসেছেন। যেতে হবে। ওঠার আগে আমি শুধু একটা কথা বলেছিলাম, স্যার! দুঃখে-কষ্টে, রাগে বিতৃষ্ণায় কাউকে যদি বকা দিয়ে থাকি, কেউ যদি রাতের ঘুম হারাম করে থাকে, কারও উপর যদি ক্ষোভও থাকে তাহলে এই প্রতিষ্ঠানটির উপরই ছিল। কিন্তু এটা চরম সত্য যে, জীবনে যদি পাওয়ার মত কিছু পেয়ে থাকি তাহলে এখান থেকেই পেয়েছি, যদি গর্ব করার মত কিছু এখনও থাকে, বুক ফুলিয়ে চিৎকার করে বলার মত আমাদের কিছু থেকেও থাকে, তাহলে এই প্রতিষ্ঠানটিই আছে। আমরা উপাচার্য বুঝিনা, সহ-উপাচার্য বুঝিনা, শিক্ষক সমিতির প্রেসিডেন্ট, সম্পাদক বুঝিনা, কর্মচারি, কর্মকর্তা বুঝিনা, আমরা শুধু এই প্রতিষ্ঠান বুঝি। আমরা এভাবে এই প্রতিষ্ঠানের ধ্বংস দেখতে পারি না।
স্যার শুধু বললেন, “দোয়া কর” ।
বৃষ্টি তখন থেমে গেছে। বাইরে হাল্কা বাতাস। ইএমই আর সিভিল বিল্ডিংয়ের মাঝখান দিয়ে আমি হাটতে থাকি পলাশীর দিকে। শহীদ মিনারে সোডিয়াম লাইটগুলো ততক্ষনে জ্বলে উঠেছে, হলের রুমগুলো আলোকিত হচ্ছে ধীরে ধীরে। আহসান উল্লাহ হল, তীতুমির হল, সোহারাওয়ার্দি হল.......
পলাশীর ভাঙ্গা স্যাঁতসেতে কাঁচাবাজারটা এখন আর নেই। সেখানে এখন দোতালা সুরম্য বাজার গড়ে উঠেছে। একটু সামনেই পলাশী মোড় থেকে আজিমপুর পর্যন্ত বিস্তৃত বুয়েটের বিশাল নতুন একাডেমিক বিল্ডিংটা মাথা উঁচু করে এই প্রতিষ্ঠানের গর্ব,আভিজাত্যকেই জানান দিচ্ছে। পরিবর্তন হয়েছে, বদলে গেছে বুয়েট, তার চাকচিক্যতা আর আধুনিকতা।
শুধু ভিতরটায় ঘুনে ধরেছে ভীষণভাবে।
আমরা বুয়েটকে বদলাতে দিব না। বুয়েট যে আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





